সিরিয়ার আয়নাঘর
সিরিয়ার আয়নাঘর
দেশের নাগরিকদের উপর নির্যাতন এবং গুম-খুন স্বৈরাচারদের একটি চিরচেনা বৈশিষ্ট। বাংলাদেশের স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর, যেমন একের পর এক তার নানা কুকীর্তি বেরিয়ে আসছিল। তেমনিভাবে সিরিয়ার স্বৈরাচার বাশার আল আসাদ পালিয়ে যাওয়ার পরও তার শাসনামলের নানা অন্যায়ের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে।
সিরিয়ার আয়নাঘর
আসাদ পরিবার ১৯৭১ সাল থেকে দীর্ঘ ৫৪ বছর সিরিয়ায় অন্যায়ভাবে রাজত্ব করেছে। সম্প্রতি দেশটির পতিত স্বৈরাচার বাশার আল আসাদের বাবা হাফিজ আল আসাদের সময় থেকেই সাধারণ জনগনকে গ্রেফতার করে বিভিন্ন গোপন করাগারে আটকে রাখা হত। সিরিয়া জুড়ে প্রায় একশর কাছাকাছি গোপন বন্দীশালা ছিল, যার মধ্যে প্রায় ২৩ টি পূর্ণাঙ্গ কারাগার রয়েছে। যেখানে প্রায় ৩০ হাজার নিরপরাধ মানুষকে একসাথে বন্দী করে রাখা যেত।
এসব কুখ্যাত কারাগার নিয়ন্ত্রন করত মূলত সিরিয়ার চারটি গোয়েন্দা পরিদপ্তর। এগুলো হল:
১. এয়ার ফোর্স ইন্টেলিজেন্স ডিভিশন ২. মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ডিভিশন ৩. জেনারেল ইন্টেলিজেন্স ডিভিশন এবং ৪. পলিটিক্যাল সিকিউরিটি ডিভিশন।
২০১১ সালে সিরিয়ায় সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু হবার পর, প্রায় দুই লক্ষ লোককে গুম করে ফেলা হয়েছিল। সেকারণে, বাশার আল আসাদ পালিয়ে যাবার খবর পাওয়ার পর, বিদ্রোহী সেনারা রাষ্ট্রপতির বাসভবন দখলে নেওয়ার আগে, এসব কারাগার উন্মুক্ত করার জন্য ছুটে গেছেন।
এসব কারাগার থেকে এমন লোককেও জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, যাদেরকে দীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ এখানে আটকে রাখা হয়েছিল। তবে কোন কোন কারাগার থেকে কোন মানুষকেই জীবিত উদ্ধার করা যায়নি।
বাশার আল আসাদের কারাগার গুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল, আন্ডারগ্রাউন্ড সেল। মাটির নিচের এসব অন্ধকার কুঠুরিতে বহু মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে। ছোট্ট এসব কয়েদখানা কফিন সেল হিসেবে পরিচিত। কাউকে এখানে বন্দী করা, সত্যিকার অর্থে জীবন্ত কবর দিয়ে দেওয়ার চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার। কফিন সেলগুলো এতটাই ছোট যে, এখানে েশাবার মত কোন জায়গা নেই। তাছাড়া এসব আন্ডাগ্রাউন্ড সেলগুলো এতটাই ঘুটঘটে অন্ধকার যে, রাতের আধারও এতটা কালো হয় না। এই রকম অন্ধকারে বন্দী করে রাখাও অত্যাচারের একটি অংশ। দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিরাও এখানে অন্ধত্বের স্বাদ ভোগ করে।
কারাগারে থেকে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে যারা মারা যেত, তাদের মৃতদেহগুলো কফিন সেলের বাইরে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হত। যাতে করে লাশ পঁচা গন্ধে এখানে থাকা বাকি বাসিন্দাদের জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। আন্ডারগ্রাউন্ড জেলের অনেকগুলো অংশ ডিজিটাল লকের মাধ্যমে বন্ধ করা। সেসব দরজার পাসওয়ার্ড না জানার কারণে, সেখানে বন্দী থাকা অনেককেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
সেডনায়া কারাগার
সমগ্র সিরয়াজুড়ে যতগুলো বন্দীশালা রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হল সেডনায়া কারাগার। এখানে এত বেশি মানুষ কে হত্যা করা হয়েছে যে, সেডনায়া কে বলা হয় মানুষের কশাইখানা। প্রায় ৪০ বছর আগে রাজধানী দামেস্কাস থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে কারাগারটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
এখানে ছোট ছোট সেলের মধ্যে এতজনকে গাদাগাদি করে রাখা হত যে, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এখানে কেউ শুতেও পারত না। এখানে বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার পর অসুস্থ অবস্থায় ফেলে রাখা হত, এক পর্যায়ে তাদের শরীরে পচন ধরে মারা যেত।
সেডনায়া কারাগারে পুরুষদের পাশাপাশি বহু নারীকেও মিথ্যা অভিযোগে আটকে রাখা হত। অনেক সময় নারীদের সাথে তাদের ছোট্ট শিশু সন্তানকেও ধরে নিয়ে আসা হত। বিদ্রোহীরা কারাগার উন্মুক্ত করার পর ৪/৫ বছরের শিশুদেরও এখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। কাউকে এখানে আটকে রাখা আর জীবন্ত কবর দেওয়া একই কথা। মানুষ কতটা পাষন্ড হলে শিশুদেরকেও এমন ভয়ংকর জায়গায় আটকে রাখতে পারে।
সেডনায়া কারাগারের রেড বিল্ডিং এ বন্দীদের আটকে রাখা হত এবং হোয়াইট বিল্ডিং এ বন্দীদের হত্যা করা হত। এখানে প্রতি সপ্তাহে বন্দীদের নিয়মিত হত্যা করার রীতি প্রচলিত ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া তথ্য মতে একসাথে প্রায় ৩০০ জনকে পর্যন্ত হত্যা করা হত। ধারণা করা হয় ২০১১ সাল থেকে প্রায় ১৫ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে। এত লাশ গুম করাটা ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। তাই বন্দীদের হত্যা করার পর এই ধরনের ক্রাশার মেশিনের মাধ্যমে লাশ পিষে ফেলা হত। এরপর লাশগুলো শ্মশানের চুল্লিতে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হত। তাছাড়া গোপন বন্দীশালার বহু জায়গায় লাশ গলানোর জন্য মজুদকৃত এসিডের বিশাল ভান্ডারও পাওয়া গেছে।
যাদেরকে এখান থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, তারাও মানসিকভাবে অনেকটাই মৃত। সেডনায়া কারাগারে মানসিক অত্যাচারের তীব্রতায় অনেকে সত্যি সত্যি নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে গেছে। এখান থেকে উদ্ধার হওয়া অনেকেরই মুক্তির আনন্দ উপভোগ করার মত মানসিক শক্তিটুকুও নেই।
কারাগারে আটক, নিহত বা গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে তাদের সম্পর্কে কোন তথ্য দেওয়া হত না। এখানে হত্যাকান্ডের শিকার অধিকাংশ ব্যক্তির বিরুদ্ধেই কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল না। জনমনে ভীতি সঞ্চার করা জন্যই আসাদ সরকার গণ-গ্রেফতার এবং গুম-খুন করেছে। যাতে করে তারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস না পায়।
কারাগার গুলো উন্মুক্ত করা হলেও, হাজার হাজার লোকের এখনও কোন খোঁজ নেই। গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা কারাগারের বন্দীদের তালিকায় তাদের স্বজনদের নাম খুুঁজতে খুঁজতে পাগল পারা হয়ে গেছে। যাদের অনেকেরই হয়ত ঠাই হয়েছে কোন না কোন গণকবরে।
আসাদের গণকবর
শুধু গোপন কারাগার আর বন্দী শালাই নয়, আসাদ সরকার সিরিয়া জুড়ে গড়ে তুলেছিল বহু গণকবর। রাজধানী দামেস্কাস থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে আসাদ সরকারের সবচেয়ে বড় গণকবর। বিগত এক দশকের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে, গণকবরের ভয়াবহতা সম্পর্কে আঁচ করা যায়।
২০১০ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনের আগে জায়গাটি ছিল একটি সাধারণ ক্ষেত। তবে এখানে একটি টাওয়ার এবং দুটি বিক্ষিপ্ত ভবনও দেখা যাচ্ছে। ২০১১ সালে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর একটি ভবন ভেঙে ফেলে জায়গাটি পরিষ্কার করা হয়।
পরবর্তী বছর গুলোতে এখানে একাধিক খাল খনন করা হয়। এবং কয়েক দিন পর পর তা আবার মাটি দিয়ে ভরাট করা হতে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় এসব গর্তে শত শত মানুষের লাশ গুম করা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু ট্রাক এবং মাটি খোড়ার যন্ত্রও দেখা গেছে। হঠাৎ ২০২২ সালে পুরো জায়গাটি মাটি দিয়ে ভরাট করে সুন্দর করে মিশিয়ে দেওয়া হয়। যাতে করে গণকবরের কোন আলামত না থাকে। একই রকমের গণকবর সমগ্র সিরিয়া জুড়েই রয়েছে বলে ধারনা করা হয়।
বাশার পালানোর পরও সরকারি হাসপাতালের মর্গে লাশের স্তূপ পাওয়া গেছে। যাদেরকে সরকার পতনের আগ মুুহর্তে হত্যা করা হয়েছিল। এদেরও হয়ত কোন না কোন গণকবরে ঠাঁই হত।
রাসায়নিক হামলা
সিরিয়ার বিগত সরকারের সময় নিরীহ নাগরিকদের গ্রেফতার করে শুধু গোপন কারাগারে নির্যাতনই নয়, যারা কারাগারের বাইরে ছিল, তারও নির্মম অত্যাচারের হাত থেকে রেহায় পায়নি। বাশার আল আসাদ এমনই এক নরপিশাচ যে, নিজ দেশের নাগরিকদের উপর ৩০০ বারের অধিক, নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র হামলা চালিয়েছে। যার মাধ্যমে নারী পুরুষ সহ ছোট ছোট শিশুদেরকে নির্বিচারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট আসাদ দামেস্কাসের পার্শ্ববর্তী গোউটা এলাকায় রকেটের মাধ্যমে সারিন গ্যাস হামলা করে, এক দিকে ১ হাজার ৪০০ লোক কে হত্যা করেছিল। যার মধ্যে শত শত শিশুও ছিল।
রাসায়নিক হামলা ছাড়াও, সরকার বিদ্রোহীদের ভয় দেখানোর জন্য নিজ দেশের মানুষের উপর বিমান থেকে বোমা হামলা করাটা ছিল আসাদ সরকারের রুটিন মাফিক কাজ। যার মাধ্যমে সিরিয়ার সরকারই নিজ দেশে বোম হামলা করে শহরের পর শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।
চীনা সমরবিদ ও দার্শনিক সান জু ক্ষমতালোভী শাসকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “একজন দুষ্টুু লোক তার জাতিকে পুুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিবে, তারপরও সে ছাই এর উপর রাজত্ব করবে।” বাশার আল আসাদ সেই দুষ্টু শাসকদের আদর্শ চরিত্র। যে সত্যি সত্যি সিরিয়াকে ধ্বংসস্তূপে পরিনত করে, রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় সেই ধ্বংসস্তূপের উপর রাজত্ব করতে চেয়েছিল। সত্যিকার অর্থে বাশার আল আসাদ যেন ইবলিশ শয়তানের আরেক রূপ। বর্তমানে সিরিয়ানরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে যদি শয়তানও এসে সিরিয়া শাসন করে, তবে তার শাসনও আসাদের চেয়ে ভালো হবে।
আসাদ সরকারের ২৪ বছরের শাসনামলে দীর্ঘ ১৩ বছরই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সে নিজ দেশের জনগণের সাথে যুদ্ধ করে গেছে। যে ইরান ফিলিস্তিনে নিরীহ মানুষদের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করে, মানবতার বড় বড় বুলি আওড়ায়। সেই ইরানই আবার সিরিয়ায় শিয়া আধিপত্য বজায় রাখার জন্য, আসাদ সরকারকে সহায়তার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ সিরিয়ানদের উপর চরম নির্যাতনে সরাসরি অংশ নিয়েছে।
সত্যিকার অর্থে সমগ্র পৃথিবীতে কোথাও কোন ভালো শাসক নেই। সিরিয়ার আয়নাঘর মুক্ত হয়েছে, কিন্তু আরব বিশ্বেরই অন্যান্য দেশে নিশ্চই এরকম আরো বহু আয়নাঘর এখনও রয়ে গেছে।