পাকিস্তান কি বাংলাদেশের পাওনা দিবে

maxresdefault (56)
জীবনযাপন

পাকিস্তান কি বাংলাদেশের পাওনা দিবে

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও, পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনার হিসাব আজও অমীমাংসিত। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দীর্ঘ দুই যুগে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে উৎপাদিত সম্পদে গড়ে উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি।

১৯৭১ সালের আগে সমগ্র পাকিস্তানের সম্পদের বড় একটি অংশই ছিল পূর্ব-পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের। কিন্তু একসাথে থাকতেও আমাদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে এবং দেশ আলাদা হয়ে যাওয়ার পর, পাকিস্তান আমাদের সম্পূর্ন টাকা আত্নসাৎ করেছে।

পাকিস্তানের কাছে কত টাকা পায় বাংলাদেশ ?

বৈষম্য

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত, পূর্ব পাকিস্তান থেকে উৎপাদিত সম্পদ এবং আয় মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা হয়। বৈদেশিক ঋণ, রাজস্ব, এবং শিল্প খাতে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের অবদান বেশি থাকলেও, আমাদেরকে বরাবরই ঠকানো হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান শুধু বাংলাদেশের অস্তিত্বই ধ্বংস করতে চায়নি, সেই সাথে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করারও সকল পদক্ষেপ নিয়েছিল।  

প্রথমত, তৎকালীন পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৭০% আসত পূর্ব পাকিস্তানের পাট এবং পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে। সেসময় পাট ছিল বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান রপ্তানি পণ্য, যা পাকিস্তানে শুধুমাত্র বাংলা অঞ্চলেই উৎপাদিত হত। পশ্চিম পাকিস্তানে কোন পাট উৎপাদন হত না। সম্পূর্ণ এই অঞ্চলের অবদানে রপ্তানি আয় সম্বৃদ্ধ হলেও, বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যাংকিং সিস্টেমে জমা হতো। এবং পূর্ব পাকিস্তান তার খুব সামান্যই ব্যবহার করতে পারত। এই বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ক্ষোভের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছিল।

১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪.৩২ বিলিয়ন ডলার। জনসংখ্যার ভিত্তিতে যদি এই রিজার্ভ ভাগ করা হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অংশ প্রায় ২.৪ বিলিয়ন ডলার হওয়া উচিত ছিল।

দ্বিতীয়ত, অবকাঠামো এবং শিল্প খাতেও পূর্ব পাকিস্তানের অংশীদারিত্ব ছিল। রেলওয়ে, বিমান পরিবহন, বন্দর, এবং টেলিযোগাযোগসহ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলিতে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান ছিল বিশাল। তবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা এবং মুনাফা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে থাকত।

তৃতীয়ত, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে উচ্চহারে ট্যাক্স প্রদান করলেও সেই টাকার বেশিরভাগই পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হতো। রাজস্ব এবং ব্যয়ের এই বৈষম্যও পূর্ব পাকিস্তানকে আর্থিকভাবে দুর্বল করে তোলে।

পাওনা

পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের যে পাওনা, ৫৩ বছর পর হিসাব করলে বার্ষিক ৬ শতাংশ সুদসহ সেই সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৯৪.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ১১ লাখ ৩২ হাজার ৩৬ কোটি টাকারও বেশি।

১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভূট্টোর বাংলাদেশ সফরে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কাছে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার পাওনা দাবি করেন। কিন্তু ভূট্টো সেই দাবি কৌশলে এড়িয়ে যান।

সম্প্রতি ২০২৪ সালের ডি-৮ সম্মলনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেও, ১৯৭১ সালের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো মীমাংসা করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু শেহবাজ শরীফও বিষয়টি অত্যন্ত কৌশলে এড়িয়ে যান।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, যখন একটি রাষ্ট্র বিভক্ত হয় বা কোনো অঞ্চল নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন সম্পদ এবং দায়-দেনার সমান ভাগাভাগি নিশ্চিত করার একটি নৈতিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় State Succession বা রাষ্ট্রের উত্তরাধিকার।

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের সময়, দুই রাষ্ট্রের সম্পদ এবং দায়-দেনার ভাগাভাগি আন্তর্জাতিক নীতির ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়েছিল। তেমনিভাবে, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর একই নীতি প্রয়োগ করা উচিত ছিল। কিন্তু পাকিস্তান সেই সম্পদ বাংলাদেশকে হস্তান্তর করেনি, যা আন্তর্জাতিক নীতির লঙ্ঘন।

অতিরিক্ত পাওনা

উত্তরাধিকার সূত্রের বাইরেও, পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ আরো বহু টাকা পাওনা রয়েছে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের ভোলায় ঘূর্ণিঝড় গোর্কি আঘাত হেনেছিল। যা এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এবং এটি ছিল সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। সেসময় পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু ও শত কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতির পরও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কোনো সহায়তা দেয়নি। বরং, আন্তর্জাতিক ত্রাণ হিসেবে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য এসেছিল; সেই ত্রাণের টাকাও আত্মসাত করার উদ্দেশ্যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঢাকা শাখা থেকে পাকিস্তানের লাহোর শাখায় স্থানান্তর করা হয়।

এসবের বাইরেও, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের আয় এবং সম্পদের প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করা হয়েছিল। এছাড়াও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ এবং লুটপাটের ক্ষতিপূরণও পাওনার অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। এই পাওনা কেবল অর্থনৈতিক হিসাব নয়, এটি পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য অধিকার।

আদায় করা সম্ভব?

পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের পাওনা তিনটি উপায়ে আদায় করার সম্ভব। উপায়গুলো হল: ১. কূটনৈতিক আলোচনা ২. আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনা এবং ৩. ইতিহাস ও নথিপত্রের প্রমাণ উপস্থাপন।

প্রথমেই পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করে দাবিগুলো জোড়ালোভাবে উত্থাপন করা উচিত। যদি কূটনৈতিক আলোচনা ব্যর্থ হয়, তবে আন্তর্জাতিক ফোরাম যেমন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) অথবা জাতিসংঘ-এর মাধ্যমে এই দাবির বিষয়ে আইনি লড়াই করা যেতে পারে। তথ্য-উপাত্ত, হিসাব এবং নথি ব্যবহার করে প্রমাণ করা যেতে পারে যে পাকিস্তানের এই সম্পদ আদতে বাংলাদেশের।

বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের এ ধরনের দাবির বিষয়ে আদালতে হাজির হওয়ার নজির রয়েছে। যেমন: ইরাক কুয়েত দখল করার পর জাতিসংঘের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল কুয়েত। ইরিত্রিয়া ও ইথিওপিয়া দেশদুটি বিভক্তির পর, তাদের সীমান্ত, সম্পদ ও দায়-দেনার ভাগাভাগিও আন্তর্জাতিক ফোরামের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল।

কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হল, একটি দেশের সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ই তাদের কোন ভূল সহজে শুধরাতে চায় না। সেখানে আজ থেকে ৫৩ বছর আগের পাকিস্তানী সরকারের লুটপাটের দায় বর্তমান পাকিস্তান সরকার কিছুতেই নিতে চাইবে না। সেই সাথে এ ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করার মত রাজনৈতিক ঐক্যও পাকিস্তানের নেই।

বাংলাদেশের পাওনা পরিশোধ করা তো দূরের কথা, ২০১৬ সালে পাকিস্তান সরকার উল্টো বাংলাদেশের কাছ থেকেই পাওনা দাবি করে। পাকিস্তানের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, তৎকালীন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের কাছে যে পরিমাণ অর্থ পাওনা ছিল, বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী তার মূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশের একটি হিসেব থেকে জানা যায়, পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছ থেকে ১০.৮৮ কোটি টাকা পাওনা ছিল।

পাকিস্তানের অর্থনীতি

পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক। দেশটি উচ্চ ঋণ, মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতিসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন।

বর্তমানে পাকিস্তানের জিডিপি ৩৩৮.৪ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশের জিডিপি ৪৩৭.৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ সরকারের নজিরবিহীন লুটপাট এবং ভারতের অর্থনৈতিক আগ্রাসনের পরও বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়েও অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে আছে।

তাছাড়া পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের পরিস্থিতিও অত্যন্ত গুরুতর। ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে দেশটিকে ৭৭.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া, ২০২৪ সালে আইএমএফের কাছ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে পাকিস্তান। সেই অর্থ পরিশোধেরও একটি বাড়তি চাপ আছে।

বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে, পাকিস্তানের পক্ষে ৯৪ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা অত্যন্ত কঠিন। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কম, ঋণের বোঝা বেশি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীরগতির কারণে, এত বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব।

পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে তারা হয়তো সরাসরি ক্ষতিপূরণ দিতে সক্ষম হবে না। তবে পাওনা আদায়ের দাবি নিয়ে বাংলাদেশের উচিত পাকিস্তানের ওপর একটি কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা। এর মাধ্যমে ভারতের আগ্রাসন মোকাবিলায় পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতার একটি অংশ, কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের নিরাপত্তায় ব্যবহার করার জন্য আলোচনা হতে পারে। যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এবং দূরদর্শী একটি পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।