এয়ার কন্ডিশন আবিষ্কার
এয়ার কন্ডিশন আবিষ্কার
ভূমিকা
প্রচণ্ড গরমে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, তখন এক বোতাম চাপলেই শীতল বাতাসে ঘর জুড়িয়ে যায়। আমাদের সবার পরিচিত এই যন্ত্রটির নাম এয়ার কন্ডিশনার বা এসি, যা আধুনিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, মানুষের শরীরকে ঠান্ডা করার উদ্দেশ্যে এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করা হয়নি। এর পেছনের গল্পটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
১৯০২ সালে উইলস ক্যারিয়ার নামের একজন প্রকৌশলী নিউইয়র্কের এক ছাপাখানার সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে এমন এক যন্ত্র তৈরি করে ফেলেন, যা পরবর্তীতে গোটা পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রাকেই বদলে দিয়েছে।
এসি আবিষ্কার
বিশ শতকের শুরুর দিকে, নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের একটি ছাপাখানা ভীষণ সমস্যায় পড়েছিল। তাদের প্রধান সমস্যা ছিল গরম বা তাপমাত্রা নয়, বরং বাতাসের আর্দ্রতা। অতিরিক্ত আর্দ্রতার কারণে কাগজের আকার সামান্য বেড়ে বা কমে যেত, যার ফলে রঙিন ছবি ছাপার সময় এক রঙের উপর অন্য রঙ নিখুঁতভাবে বসতো না। ছবির রঙগুলো কিছুটা গুলিয়ে যেত, যার ফলে ছাপাখানার বিশাল লোকসান হচ্ছিল।
এই সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব পান ২২ বছর বয়সী তরুণ প্রকৌশলী উইলস ক্যারিয়ার। তিনি বুঝতে পারেন যে, বাতাস থেকে যদি জলীয় বাষ্প বা আর্দ্রতা বের করে নেওয়া যায়, তাহলেই কাগজের আকার ঠিক থাকবে। এই চিন্তা থেকে তিনি একটি যন্ত্র ডিজাইন করেন। তার যন্ত্রটি বাতাসকে ঠান্ডা পাইপের ওপর দিয়ে চালনা করতো। এর ফলে বাতাসের জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে পানিতে পরিণত হতো এবং পাইপের গায়ে জমা হতো, ঠিক যেমন এক গ্লাস ঠান্ডা পানির বাইরে ফোঁটা ফোঁটা পানি জমে সেভাবে। এই প্রক্রিয়ায় বাতাস থেকে আর্দ্রতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি বাতাস ঠান্ডাও হয়ে যাচ্ছিল। ক্যারিয়ারের মূল উদ্দেশ্য সফল হলো, ছাপাখানার ছাপার মানও উন্নত হলো। কিন্তু তিনি নিজেও হয়তো তখন বুঝতে পারেননি যে, তার এই আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রটিই একদিন বিশ্বজুড়ে মানুষের আরামের জন্য ব্যবহৃত হবে।
উইলস ক্যারিয়ার প্রথম এসি আবিষ্কারের আগেই; ১৯০৬ সালে স্টুয়ার্ট ক্রেমার নামের একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার; তার কারখানার বাতাসকে আর্দ্র করার একটি পদ্ধতির পেটেন্ট নেওয়ার সময় প্রথম ‘এয়ার কন্ডিশনিং’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ক্যারিয়ার পরবর্তীতে এই নামটিই জনপ্রিয় করে তোলেন।
পরবর্তীতে 1920-এর দশকে এসি বাড়িতে এবং গাড়িতে ব্যবহারের উপযোগী হয়, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমকিকার এসিগুলো একটি ট্রেনের কামরার সমান বড় ছিল।
এসি কীভাবে কাজ করে?
এয়ার কন্ডিশনার কীভাবে ঘর ঠান্ডা করে, তা বুঝতে হলে আমাদের একটি সহজ উদাহরণ মাথায় রাখতে হবে। যখন আমাদের শরীর ঘেমে যায় এবং সেই ঘাম বাতাসে শুকিয়ে যায়, তখন আমাদের শরীর শীতল অনুভব করে। কারণ, তরল ঘাম বাষ্পে পরিণত হওয়ার সময় আমাদের শরীর থেকে তাপ শোষণ করে নেয়। এসি ঠিক এই পদ্ধতিতেই রেফ্রিজারেশন সাইকেল নামের একটি চক্রের মাধ্যমে ঘর ঠান্ডা করে, তবে এখানে ঘামের বদলে ব্যবহৃত হয় ‘রেফ্রিজারেন্ট’ নামের এক বিশেষ রাসায়নিক গ্যাস।
এয়ার কন্ডিশনার মূলত চারটি প্রধান অংশ নিয়ে কাজ করে: কম্প্রেসর, কনডেনসার, এক্সপ্যানশন ভালভ এবং ইভাপোরেটর।
বিষয়টিকে সহজভাবে বুঝতে এর কাজকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—এসি’র ভেতরের অংশ বা ইনডোর ইউনিট এবং বাইরের অংশ বা আউটডোর ইউনিট।
ইনডোর ইউনিটের ভেতরে থাকে ইভাপোরেটর কয়েল। এই কয়েলের ভেতর দিয়ে যখন ঠান্ডা এবং তরল রেফ্রিজারেন্ট প্রবাহিত হয়, তখন ঘরের ভেতরের গরম বাতাস একটি ফ্যানের মাধ্যমে টেনে এনে এই ঠান্ডা কয়েলের ওপর দিয়ে চালনা করা হয়। ঘরের বাতাস তার তাপ ওই ঠান্ডা কয়েলে থাকা রেফ্রিজারেন্টকে দিয়ে দেয় এবং নিজে ঠান্ডা হয়ে আবার ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে, ঘরের বাতাস থেকে তাপ শোষণ করে তরল রেফ্রিজারেন্ট গরম হয়ে গ্যাসে পরিণত হয়।
অন্যদিকে বাইরের অংশের কাজ হল, ঘরের গরম বাতাস বাইরে নিয়ে আস। ঘরের ভেতর থেকে আসা গরম গ্যাসীয় রেফ্রিজারেন্ট পাইপের মাধ্যমে চলে যায় এসির বাইরের অংশে থাকা কম্প্রেসরে। কম্প্রেসরের কাজ হলো একটি পাম্পের মতো, যা গ্যাসকে প্রচণ্ড চাপে সংকুচিত করে। এই অতিরিক্ত চাপের কারণে গ্যাস আরও অনেক বেশি গরম হয়ে যায়। এরপর এই উত্তপ্ত গ্যাস কনডেনসার কয়েলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় বাইরের ফ্যানের বাতাসে তার সব তাপ পরিবেশে ছেড়ে দেয় এবং নিজে ঠান্ডা হয়ে আবার তরলে পরিণত হয়।
এই তরল রেফ্রিজারেন্ট এরপর এক্সপ্যানশন ভালভের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় এর চাপ কমে যায় এবং এটি আবারও অত্যন্ত ঠান্ডা তরলে পরিণত হয়ে ইনডোর ইউনিটে ফিরে যায় নতুন করে ঘরের তাপ শোষণ করার জন্য।
এভাবেই এই চক্রটি অবিরত চলতে থাকে। অর্থাৎ, এসি কোনো ঠান্ডা বাতাস তৈরি করে না; এটি কেবল ঘরের ভেতরের তাপ শোষণ করে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাইরে বের করে দেয়।
এসির টন কী ?
এসি ক্ষেত্রে ‘টন’ শব্দটি নিশ্চয়ই শুনেছেন? আমরা অনেকেই এই টনের সঠিক অর্থ জানি না। এই টন আসলে এসির সাইজ বা ওজনকে বোঝায় না। টন দিয়ে এসির তাপ শোষণ ক্ষমতা বোঝায়। টন এর ধারণাটি, বরফ গলিয়ে বাতাস ঠান্ডা করার রীতি থেকে এসেছে।
আরও সহজ করে বলতে গেলে, এক টন বরফ এক ঘণ্টায় একটি ঘরের তাপমাত্রা যত ঠান্ডা করবে, এক টন এসির কার্যক্ষমতাও ঠিক সেই পরিমাণ। তার মানে এসির টন যত বেশি হবে; সেই এসি তত বেশি ঘর ঠান্ডা করতে পারবে।
এক টনের একটি এসি প্রতি ঘণ্টায় ঘর থেকে ১২০০০ বিটিইউ তাপ শোষণ করতে পারে। দেড় টনের এসি ঘণ্টায় ১৮০০০ বিটিইউ তাপ ঘর থেকে বের করে দিতে পারে, এভাবে টন অনুযায়ী তাপ শোষণ ক্ষমতা বাড়তে থাকে।
এয়ার কন্ডিশনিং’ কিভাবে পৃথিবী বদলে দিল
১৯২০-এর দশকে গরমকালে সিনেমা হলগুলো দর্শক টানার জন্য প্রথম এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহার শুরু করে। প্রচণ্ড গরমে ঠান্ডা পরিবেশে সিনেমা দেখার জন্য মানুষ হলে ভিড় জমাতো, যা ‘সামার ব্লকবাস্টার’ সিনেমা ধারণার জন্ম দেয়।
এয়ার কন্ডিশনার আবিষ্কারের আগে বড় বড় দালান তৈরি করা হতো উঁচু ছাদ এবং মোটা দেয়াল দিয়ে, যাতে প্রাকৃতিকভাবে ঘর ঠান্ডা থাকে। কিন্তু এসির আগমনের পর থেকে কাঁচের তৈরি বহুতল ভবন বা স্কাইস্ক্র্যাপার নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে, যা আধুনিক শহরগুলোর চেহারা পাল্টে দিয়েছে। এয়ার কন্ডিশনার না থাকলে, কাঁচের এসব বিল্ডিংগুলো একেকটা গ্রীন হাউজের মত গরম হয়ে থাকত।
এয়ার কন্ডিশনার আবিষ্কারের ফলেই আমেরিকার ‘সান বেল্ট’ নামে পরিচিত ফ্লোরিডা, অ্যারিজোনা বা টেক্সাসের মত উষ্ণ অঞ্চলগুলোতে মানুষের বসবাস সহজ হয়ে উঠেছে। এর ফলে ঐসব অঞ্চলে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়ে।
সুতরাং, একটি ছাপাখানার সাধারণ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা থেকে জন্ম নেওয়া এই যন্ত্রটি আজ কেবল আরামদায়ক জীবনযাপনের উপকরণই নয়, এটি আধুনিক শিল্প, স্থাপত্য এবং এমনকি মানব বসতির বিন্যাসকেও প্রভাবিত করেছে।