স্পেসএক্স স্টারশিপ
স্পেসএক্স স্টারশিপ
ভূমিকা
মানব ইতিহাসে মহাকাশ জয়ের পথে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হলো SpaceX-এর Starship রকেট। এটি এখন পর্যন্ত তৈরি হওয়া সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী রকেট, যার লক্ষ্য শুধু স্যাটেলাইট বহন করা নয়, বরং মানুষকে আবার চাঁদে নিয়ে যাওয়া এবং একদিন মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপন করার যানবাহন হিসেবে ব্যবহার করা। বিশাল আকার, রেকর্ড ভাঙা শক্তি আর পুনঃব্যবহারযোগ্য নকশার কারণে Starship আজ মহাকাশ প্রযুক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে।
Starship এর আকার ও শক্তি
SpaceX-এর Starship কেবল একটি রকেট নয়, বরং এটি মহাকাশ প্রযুক্তির এক বিশাল অগ্রগতি। Starship এবং তার বিশাল বুস্টার মিলে এটি এখন পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে উঁচু, ভারী এবং শক্তিশালী রকেট ব্যবস্থা। এটি সম্পূর্ণ পুনঃব্যবহারযোগ্য (reusable) রকেট, যা একসাথে মানুষ ও মালামালকে পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে চাঁদ, মঙ্গল এমনকি আরও দূর মহাকাশে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী করা হয়েছে।
Starship আকারে ও শক্তিতে আগের সব রকেটকে ছাড়িয়ে গেছে। এই রকেটের বুস্টার Super Heavy এবং ওপরের Starship মহাকাশযান একত্রে দাঁড়ালে এর উচ্চতা হয় প্রায় ১২০ মিটার (৩৯৪ ফুট)। এটি Apollo যুগের Saturn V রকেটের চেয়েও প্রায় ১০ মিটার উঁচু, আর NASA-র নতুন SLS রকেটের থেকেও বড় । সহজ করে বললে, Starship প্রায় ৪০ তলা বিল্ডিং-এর সমান উঁচু; যা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে উঁচু রকেট হবার মর্যাদা লাভ করেছে।
Starship রকেটের শক্তি আরও বিস্ময়কর। Super Heavy বুস্টারের ৩৩টি Raptor ইঞ্জিন মিলিয়ে লঞ্চের সময় প্রায় ১৬ মিলিয়ন পাউন্ড বা ৭২ মেগা নিউটন thrust উৎপাদন করে। যা অতীতের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট Saturn V তুলনায় দ্বিগুণ শক্তি। অর্থাৎ একেকটি লঞ্চে এই রকেটের ইঞ্জিন প্রায় ৭৩ লক্ষ কেজি ওজনের সমান ঠেলা দেয়। এর তুলনায় Saturn V দিতে পারত প্রায় ৩৪ লক্ষ কেজি। আর NASA-র বর্তমান সময়ের সবচেয়ে সেরা রকেট SLS দিতে পারে প্রায় ৪০ লক্ষ কেজি। তাই রকেটের শক্তির দিক থেকে Starship সকল রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
২০২৩ সালের প্রথম পরীক্ষামূলক উড্ডয়নে Starship ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী রকেট হিসেবে লঞ্চপ্যাড ছাড়ে । যদিও কয়েক মিনিট পর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিস্ফোরিত হয়, তবুও এত বড় রকেটকে আকাশে তোলাটাই ছিল বিশাল এক মাইলফলক।
Starship এত আলোচিত কেন
SpaceX-এর প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক বহুদিন ধরে বলছেন, Starship-এর মূল লক্ষ্য হলো মানুষকে মঙ্গলগ্রহে বসতি স্থাপন করতে সহায়তা কর। এর মাধ্যমে মানবজাতি একদিন একাধিক গ্রহে বসবাস করার মত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও বাস্তব রূপ পেতে যাচ্ছে। আর সেকারণেই মহাকাশ প্রেমী সবার নজর এখন Starship-এর দিকে।
SpaceX তাদের প্রতিটি টেস্ট উন্মুক্তভাবে লাইভ সম্প্রচার করে। Starship-এর প্রথম পরীক্ষামূলক ফ্লাইট যখন হয়, তখন কোটি মানুষ সরাসরি দেখেছে।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে প্রথমবার স্টারশিপ লঞ্চ করা হয়। তখন কয়েক মিনিট আকাশে উড়ে বিস্ফোরিত হলেও, সেটিই ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রকেটের সফল উড্ডয়ন প্রচেষ্টা।
১৯৬০–৭০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের N1 রকেটেও ৩০টি ইঞ্জিন ছিল, কিন্তু সেই রকেট একবারও সফল হয়নি। Starship সেই ব্যর্থতার জায়গা থেকে শিক্ষা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত, ১০ বার স্পেসএক্স এর স্টারশিপ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। যার মধ্যে ৫টি সফল এবং ৫টি পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। স্পেসএক্স তার “দ্রুত ব্যর্থ হও, দ্রুত শেখো” নীতির মাধ্যমে বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকে, যেখানে ব্যর্থতাকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখা হয়।
প্রতিবার ব্যার্থ হবার পর স্টারশিপ অতীতের তুলনায় আরো শক্তিশালী হয়েছে। এবং প্রতিবার রকেট ধ্বংস হবার পর স্টারশিপ বারবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পরা ফুটেজ আর নাটকীয় টেস্ট লঞ্চ সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই রকেট সম্পর্কে কৌতুহল আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও প্রযুক্তি
Starship শুধু আকারেই বড় নয়, এর ভেতরে রয়েছে এমন সব উদ্ভাবন যা একে অন্য সব রকেটের থেকে আলাদা করেছে।
Starship মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। রকেটের নিচের অংশ হল বিশাল Super Heavy বুস্টার এবং ওপরের অংশটি Starship মহাকাশযান। উভয় অংশই পুনঃব্যবহারযোগ্য। অর্থাৎ লঞ্চ শেষে রকেটগুলো আবার পৃথিবীতে ফিরে এসে খাড়াভাবে নামতে পারবে। এরপর অতি সামান্য মেরামত করে আবার ব্যবহার করা যায়। যার ফলে এগুলো বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি রকেট হলেও, এর খরচ প্রচলিত রকেটের চেয়ে অনেক কম।
SpaceX চায় ভবিষ্যতে এই রকেটগুলোকে বিমানের মত ব্যবহার করতে। যার মাধ্যমে তারা একদিনের মধ্যে Starship মহাকাশে লঞ্চ করে, আবার পৃথিবীতে নামিয়ে এনে নতুন করে লঞ্চ করতে পারবে।
স্টারশিপ রকেটের রয়েছে অসাধারণ পরিবহনক্ষমতা। Starship একবারে প্রায় ১ থেকে দেড় লক্ষ কেজি মালামাল মহাকাশে নিয়ে যেতে পারবে। এমনকি প্রয়োজনে এটি আড়াই লক্ষ কেজি পর্যন্ত বহন করতে সক্ষম। তারমানে এই রকেটে একসাথে কয়েকশ’ স্যাটেলাইট বা বড়সড় স্পেস স্টেশন মডিউল একসাথে পরিবহন করা যাবে।
স্টারশিপ রকেটের Raptor ইঞ্জিনগুলো মিথেন ও তরল অক্সিজেন দিয়ে চলে। এই ধরনের জ্বালানী মঙ্গল গ্রহের খনিজ থেকেও তৈরি করা সম্ভব। ফলে ভবিষ্যতে মঙ্গলে গিয়ে, মঙ্গলের বরফ ও বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে “Sabatier Process” ব্যবহার করে, সেখানেই জ্বালানি বানিয়ে Starship আবারো পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রকেটটি স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে তৈরি। যা একইসাথে সস্তা, টেকসই এবং তাপ প্রতিরোধী। ফলে চাঁদ বা মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে ফেরার সময় ভয়ানক তাপও অনায়াসে সামলাতে পারবে।
এই রকেটের রয়েছে কক্ষপথে জ্বালানি ভরার সুবিধা। তারমানে Starship মহাকাশে কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতেই অন্য একটি Starship ট্যাঙ্কার থেকে জ্বালানি নিতে পারবে। এতে দূর গ্রহে যাওয়ার সক্ষমতা বহুগুণ বাড়বে।
চাঁদ ও মঙ্গল অভিযানে Starship
মানুষ আবারো নতুন করে চাঁদে ফেরার জন্য স্টারশিপ রকেট ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। NASA তাদের Artemis প্রোগ্রাম-এর জন্য Starship বেছে নিয়েছে। প্রায় ২৮৯ কোটি ডলার মূল্যের চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৭ সালে Starship চাঁদে নভোচারী নামাবে। পরিকল্পিত Artemis III মিশনে Starship দিয়ে মহাকাশচারীরা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামবে। এবং সেখানে প্রায় এক সপ্তাহ অবস্থান করবে। এই মিশনেরই প্রথম কোন নারী এবং কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি চাঁদের বুকে পা রাখাতে যাচ্ছে।
স্পেসএক্স নাসার চন্দ্র মিশনের জন্য Starship HLS বা Starship Human Landing System নামে একটি বিশেষ সংস্করণ তৈরী করবে। সেই রকেটটিকে চাঁদে অবতরণের জন্য আলাদা করে কাস্টমাইজড করা হবে। এতে থাকবে বড় কেবিন আর দুটি এয়ারলক, যাতে নভোচারীরা সহজে চাঁদের মাটিতে নামতে পারে।
তবে ইলোন মাস্ক এই রকেট তৈরী করেছিলেন মঙ্গল গ্রহে যাবার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। Starship একসাথে শতাধিক মানুষ ও বিপুল মালপত্র নিয়ে মঙ্গলে যেতে পারবে। ভবিষ্যতে মঙ্গলে Starship-এর বহর বানিয়ে স্থায়ী শহর গড়ার স্বপ্ন দেখছে SpaceX। মঙ্গলের বরফ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে Starship সেখানেই জ্বালানি বানাতে পারবে, যা ফেরার পথে কাজে লাগবে।
SpaceX-এর Starship মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী রকেট, যা শুধু প্রযুক্তিগত নয়, কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। পুনঃব্যবহারযোগ্য নকশা, বিশাল পরিবহনক্ষমতা আর দূর মহাকাশে বিচরণ ক্ষমতার কারণে Starship মহাকাশ অভিযাত্রার জন্য এক গেম চেঞ্জার। আগামী এক দশকের মধ্যেই হয়ত আমরা দেখতে পাব, স্টারশিপ রকটে ব্যবহার করে, মানুষ অন্যকোন গ্রহে গিয়ে বসবাস করছে।