বাংলাদেশের আউটসোর্সিং আয়

maxresdefault (2)
জীবনযাপন

বাংলাদেশের আউটসোর্সিং আয়

ভূমিকা

বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) এবং আউটসোর্সিং খাত ২০২৫ সালে ইতিহাসের সর্বোচ্চ আয় অর্জন করেছে। ২০২৫ সালে অর্ধেক বছরেই আইট খাত থেকে প্রায় $৯০০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। অথচ ২০২৪ সালের পুরো বছরের মোট আয় হয়েছিল $৮৫০ মিলিয়ন ডলার। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এআই ব্যবহারের ফলেই এই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে ২০২৫ সালের শেষে বাংলাদেশের বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (BPO) ও আইটিইএস রপ্তানি আয় প্রথমবারের মতো $১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করবে। এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশকে আইটি রপ্তানিতে একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ যদি এআই কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে তথ্যপ্রযুক্তি খাত, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দিক থেকে তৈরী পোশাক খাতকেও ছাড়িয়ে যাবে।

আয় বৃদ্ধির খাতসমূহ  

২০২৫ সালের আয় বৃদ্ধির পেছনে আইটি ও আউটসোর্সিং খাতের বিভিন্ন শাখা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (BPO) সেক্টরের অবদান অনেক বেশি।

কন্টাক্ট সেন্টার, কাস্টমার সার্ভিস, মেডিক্যাল ট্রান্সক্রিপশনসহ বিভিন্ন ব্যাক-অফিস সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লেখযোগ্য আয় করেছে। এই উপখাতে AI প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষতা বেড়েছে, ফলে কম জনব দিয়েই বেশি কাজ করা সম্ভব হচ্ছে। আর সেখান থেকেই ফলে অর্ডার এবং রপ্তানি আয় দ্রুত বেড়েছে। বিশেষ করে কল সেন্টার ও স্বাস্থ্যসেবা সহায়তার মতো সেবাগুলোতে বিদেশি কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশকে বেশি কাজ দিচ্ছে।

এরপরই রয়েছে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও আইটি সেবা। দেশে থাকা বহু সফটওয়্যার কোম্পানি ও ফ্রিল্যান্সার বিদেশের জন্য সফটওয়্যার উন্নয়ন, মোবাইল অ্যাপ তৈরি, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ও আইটি সাপোর্ট সেবা দিয়ে আয় করছে। ২০২৫ সালে এ খাতে কাজের পরিমাণ বেড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে জেনারেটিভ এআই এবং এআই দিয়ে কোডিং অটোমেশনের সাহায্যে দ্রুত সেবা দিচ্ছে, যার ফলে তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রজেক্টের কাজ নিতে পারছে।

বাংলাদেশের একটি শীর্ষ সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট কম্পানি জানিয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠানে ৭৫% কোড লেখা হয় এআই দিয়ে। আর বাকিটা করে মানুষ। সেকারণে তাদের সময় ও অর্থ উভয় ক্ষেত্রেই সাশ্রয় হচ্ছে।

শুধু বিদেশী এআই ব্যবহার করে কাজ সহজ করাই নয়, বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারা নিজেরাও এআই ডেটা এনোটেশন ও মেশিন লার্নিং এর মত বিষয়গুলোকে উন্নত করতে কাজ করে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়নের জন্য ছবি বা টেক্সট লেবেল করার মত, প্রয়োজনীয় ডেটাসেট তৈরির কাজ বাংলাদেশে একটি উদীয়মান উপখাত।

বৈশ্বিকভাবে এআই ব্যবহারের বিস্ফোরণের ফলে ডেটা এনোটেশনের চাহিদা বেড়েছে, আর স্বল্পব্যয়ের দক্ষ কর্মীশক্তি থাকার কারণে বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের কর্মীদের দিয়ে বড় পরিসরে ডেটা লেবেলিংয়ের কাজ করাচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রযুক্তিখাতের উদ্যোক্তারা গ্রাফিক ডিজাইন, লোগো ও ওয়েবসাইট ডিজাইন, এনিমেশন, ভিডিও এডিটিং, থ্রিডি মডেলিং, এবং কনটেন্ট রাইটিংয়ের মতো সৃজনশীল সেবাগুলোতেও ফ্রিল্যান্সিং করে বিপুল অর্থ আয় করছ।

আগে যেখানে বহু ফ্রিল্যান্সার শুধুই ডেটা এন্ট্রি বা ভার্চুয়াল সহকারীর মতো সাধারণ কাজে সীমাবদ্ধ ছিলেন, এখন AI টুল ব্যবহারের মাধ্যমে তারা উচ্চ-মূল্যের সৃজনশীল কাজের দিকে যাচ্ছেন।

২০২৫ সালে লোগো/গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং কনটেন্ট ও অনলাইন লেখালেখির কাজের চাহিদা বেড়েছে এবং এসব সেবা দেশের আয় বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

উপরোক্ত খাতগুলোর সমন্বিত সফলতায় ২০২৫ সালে মোট আইটি রপ্তানি আয়ে ব্যাপক অগ্রগতি দেখা গেছে। বিশেষ করে দেশের প্রায় ৪৫০টির বেশি আউটসোর্সিং কোম্পানি, যেখানে প্রায় ৯০,০০০ কর্মী নিযুক্ত এবং আনুমানিক সাড়ে ৬ লক্ষ ফ্রিল্যান্সার মিলিয়ে একটি বিশাল জনশক্তি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে অবদান রাখছে।

এআই প্রযুক্তির অবদান

২০২৫ সালে বাংলাদেশের আইটি ও আউটসোর্সিং খাতে আয় বৃদ্ধির পেছনে AI বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এআই টুলসগুলো দেশের তরুণ কর্মীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং ইংরেজি ভাষাজ্ঞানে সহায়তা করছে, ফলে বিদেশি ক্লায়েন্টদের সাথে কাজের ক্ষেত্রে যে দীর্ঘদিনের দক্ষতার ফাঁক ছিল তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে।

আগে যে জটিল কোডিং বা ডকুমেন্টেশন করতে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস সময় লাগত। এআই-এর সাহায্যে অটোমেশন করে, সেসব কাজ করা যাচ্ছে মাত্র কয়েক ঘন্টায়। সেকারণে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর্মী উল্লেখযোগ্যভাবে না বাড়লেও, আয় বেড়েছে দ্বিগুন। এই খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এআই বাংলাদেশের আইটি কর্মীদের দক্ষতার ঘাটতি পূরণে অভাবনীয় উপায়ে সহায়তা করছে। দক্ষতার এই উন্নয়নে কম সময়ে ভালো মানের কাজ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, যা বিদেশি গ্রাহকদের আস্থা বৃদ্ধি করেছে।

এআই ব্যবহারের ফলে কম লোকবল ও কম সময়ে বেশি কাজ করা সম্ভভ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশি একটি থ্রিডি ডিজাইন কম্পানি এআই প্রয়োগ করে বিপুল সাফল্য পেয়েছে।তারা ৩০-৪০% ইমেজ প্রসেসিং কাজ এখন এআই দিয়ে করছে। আগে একটি সাধারণ থ্রিডি ডিজাইন করতে ৬ ঘণ্টা লাগত, এখন এআইয়ের মাধ্যমে মাত্র ১ ঘণ্টায় তা করা যাচ্ছে।

আগে ১০০ জন ডিজাইনার মিলে যে কাজ করত, এখন মাত্র ২৫-৩০ জন কর্মী সেই কাজ আরো দক্ষতার সাথে করতে পারছে। ভিডিও এডিটিং ও অ্যানিমেশনেও এআই টুল ব্যবহারে সময় ও খরচ দুটোই কমেছে। যার ফলে কোম্পানিগুলো একই সময়ে বেশি ক্লায়েন্টের কাজ নিতে পারছে এবং সামগ্রিক আয় বাড়ছে।

এআই শুধু বিদ্যমান কাজকে দ্রুততর করেনি, পাশাপাশি নতুন ধরনের সেবার সুযোগও সৃষ্টি করেছে। অনেক ফ্রিল্যান্সার এখন এআই-এর সাহায্যে ডেটা বিশ্লেষণ করে Market Trend বা বাজারের প্রবণতা শনাক্তের কাজ করছে। এসব কাজ আগে শুধুমাত্র উন্নত দেশের বিশ্লেষকরাই করতে পারত।

সাধারণ ডেটা এন্ট্রি বা ভার্চুয়াল সহায়তা থেকে উঠে এসে, বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সাররা এখন গ্রাফিক ডিজাইন, মোশন গ্রাফিক্স, থ্রিডি মডেলিং, কনটেন্ট রাইটিং-এর মতো উচ্চমূল্যের কাজের বাজারে প্রবেশ করছে। এআই তাদেরকে রুটিন কাজ অটোমেট করে সৃজনশীল ও জটিল কাজে মনোযোগ দিতে দিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সাররা গ্লোবাল মার্কেটে বেশি মূল্যে সেবা বিক্রি করতে পারছে, সেইসাথে নতুন বাজারেও প্রবেশ করছে।

এআই টুল ব্যবহারে কাজের নির্ভুলতা ও গুণগত মানও বেড়েছে, যা বৈশ্বিক গ্রাহকদের সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, চিকিৎসা কেন্দ্রিক আউটসোর্সিং করা একটি কম্পানি নিজেদের এআই টুল তৈরি করে মেডিক্যাল ট্রান্সক্রিপশনের প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয় করেছে। আগে তারা মেডেকেল প্রতিবেদন ম্যানুয়ালি টাইপ ও পরীক্ষা করত। আর এখন তারা এআই দিয়ে দ্রুত ও নির্ভুলভাবে বেশি রোগীর ডেটা প্রক্রিয়া করতে পারছে।

এক কথায় বলতে গেলে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাংলাদেশের আইটি খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, নতুন বাজার ও সেবার উদ্ভাবন এবং দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধির শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা

২০২৫ সালে এসে বাংলাদেশের আইটি আউটসোর্সিং খাত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করলেও; বৈশ্বিক বাজারের তুলনায় বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে আছে।

বাংলাদেশের আইটিই রপ্তানি আয় সবেমাত্র $১ বিলিয়ন ডলারে পৌছালেও, প্রতিবেশী দেশ ভারত এই খাত থেকে বছরে প্রায় $২০০ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এই খাতের আরেক প্রতিদ্বন্দী দেশ ফিলিপাইন আয় করে প্রায় $৭৫ বিলিয়ন ডলার।

তারমানে বাংলাদেশ এখনও আউটসোর্সিং দুনিয়ার অতি নগন্য অংশ দখল করতে পরেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি নতুন আশার সঞ্চার করেছে।

বাংলাদেশ প্রতি মাসেই নতুন করে প্রায় ১৫টি কোম্পানি আইটি সেক্টরে যুক্ত হচ্ছে। এমনকি এই খাতের অনেক আয় আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে দেশে না আসায় প্রকৃত সংখ্যাটা জানা যাচ্ছে না। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তথ্যপ্রযুক্তিখাতে বাংলাদেশের আয় আনুষ্ঠানিক হিসেবের প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে।

দেশের আইটি নেতৃবৃন্দ উচ্চমানের দক্ষ জনবল গড়ে তোলার উপর জোড় দিচ্ছেন। কারণ বৈশ্বিক বাজারের একটি বড় অংশ দখলের জন্য যে পরিমাণ দক্ষ কর্মী দরকার, বাংলাদেশে এখনও সেই পরিমাণ দক্ষ কর্মী নেই।

উপযুক্ত বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং অবকাঠামো পেলে আগামী দিনে বাংলাদেশ আইটি আউটসোর্সিং থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করা কোনও অসম্ভব বিষয় নয়।

এআই দিয়ে বাংলাদেশ কিভাবে বিলিয়ন ডলার আয় করল?

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।