অ্যামিষ জনগণ

maxresdefault (10)
জীবনযাপন

অ্যামিষ জনগণ

ভূমিকা

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা নানা ধরনের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক বিস্ময়কর সম্প্রদায় অ্যামিষ। এরা সহজ-সরল জীবনযাপনের জন্য বিখ্যাত। আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি থেকে নিজেদের দূরে রেখে, এই জনগোষ্ঠী আজও শতাব্দী পুরোনো ঐতিহ্য অনুযায়ী জীবন যাপন করছে। স্মার্টফোন তো দূরের কথা; অ্যামিষরা বিদ্যুৎও ব্যবহার করে না। এমনকি আধুনিক গাড়ির বদলে এরা এখনও ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে। শুধু তাই নয়, অ্যামিষরা কথাও বলে ৩০০ বছরের পুরনো জার্মান উপভাষায়।

যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অঞ্চলে বসবাস করা অ্যামিষদের জীবন সম্পর্কে সারা পৃথিবী জুড়েই কৌতূহল রয়েছে।

আমেরিকার আজব অ্যামিষ জনগোষ্ঠী !

ঐতিহাসিক পটভূমি

অ্যামিষ জনগণ হলো একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়, যারা যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া, ওহাইও এবং ইন্ডিয়ানা রাজ্যে বাস করে। অ্যামিষদের গল্প শুরু হয় ইউরোপের সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানিতে, ১৬৯৩ সালের দিকে। সেই সময় জ্যাকব আমান নামে একজন ধর্মীয় নেতা খ্রিষ্টান ধর্মের   শাখা থেকে আলাদা হয়ে নতুন সম্প্রদায় গড়ে তোলেন।

অ্যানাব্যাপটিস্টরা রাষ্ট্রীয় চার্চ থেকে আলাদা থাকতে চাইত, এবং তারা বিশ্বাস করত যে শুধু প্রাপ্তবয়স্করাই ব্যাপটিজম নিতে পারে। তাদের এই মতবাদের কারণে তারা ব্যাপক নিগৃহীত হতে থাকে। ইউরোপে ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের নির্যাতনের কারণে অ্যামিষরা প্রথমে ফ্রান্স এবং পরে ১৭৩০-এর দশকে আমেরিকায় পাড়ি জমায়।

পেনসিলভেনিয়ায় উইলিয়াম পেনের মতো লোকেদের নেতৃত্বে তারা স্বাধীন জীবন লাভ কলে, যার ফলে তাদের ধর্মীয় নিয়ম মেনে চলাটা অনেক সহজ হয়। অ্যামিশদের ইউরোপ থেকে আমেরিকায় আসার যাত্রাটা ছিল কঠিন। কিন্তু তারা তাদের বিশ্বাসকে অটুট রাখতে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিল।

অ্যামিশ ইতিহাস তাদের শিখিয়েছে যে বাইরের দুনিয়ার সাথে খুব বেশি মিশলে তাদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে, তাই তারা আলাদা থাকার চেষ্টা করে।

অ্যামিষদের জীবনযাত্রা

অ্যামিষ সম্প্রদায়ের লোকেরা আধুনিক প্রযুক্তি এবং বিশ্বের ব্যস্ততা থেকে দূরে থেকে একটি সরল, ধর্মভিত্তিক জীবনযাপন করে। ১৭শ শতাব্দীতে ইউরোপে যে ধর্ম বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল, সেটিই আজও তাদের জীবনের মূল ভিত্তি।

আমেরিকায় আসার পর ৩০০ প্রায় বছর পেরিয়ে গেলেও, তারা এখনও নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই জীবন সীমাবদ্ধ রেখেছে। তারা এখনও ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে। হাতে তৈরি পোশাক পড়ে। এমনকি বর্তমানেও তারা ৩০০ বছরের পুরনো ভাষায় কথা বলে।

অ্যামিষরা যে ভাষায় কথা বলে তার নাম পেনসিলভেনিয়া ডাচ (Pennsylvania Dutch)। এটি জার্মান ভাষার একটি বিশেষ উপভাষা। এটি আধুনিক স্ট্যান্ডার্ড জার্মান থেকে কিছুটা আলাদা, কারণ এটি পুরনো জার্মান উপভাষার শব্দ মিশে আছে, এবং সময়ের সাথে ইংরেজি শব্দও ঢুকে পড়েছে।

অ্যামিষ সম্প্রদায়ের নিয়ম মেনে চলা তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা পরিবার, সম্প্রদায় এবং ধর্মকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। অ্যামিশ সমাজে পরিবার কেন্দ্রিক জীবনধারা অপরিহার্য। তারা যৌথভাবে বসবাস করতে পছন্দ করে এবং বৃহত্তর পরিবারের সদস্যরা একসাথে থাকে। সমাজব্যবস্থায় সহানুভূতি ও সহযোগিতাও অপরিহার্য। যেমন, কোনো পরিবারের বাড়ি পুড়ে গেলে পুরো গ্রাম একত্র হয়ে নতুন বাড়ি তৈরি করে দেয়।

তাদের পোশাকে একধরনের সরলতা লক্ষ্য করা যায়। তাদের পোশাক সাধারণত নীল, কালো বা বেগুনির মত একরঙা। পুরুষরা সাধারণত কালো বা গাঢ় রঙের পোশাক পরেন, আর নারীরা লম্বা গাউন ও মাথায় স্কার্ফ ব্যবহার করেন। বাহারি পোশাক, গয়না কিংবা ফ্যাশনের বাহুল্য তাদের সংস্কৃতিতে নিষিদ্ধ। এই পোশাক তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং প্রথার প্রতিফলন।

অ্যামিষদের বিবাহও শুধুমাত্র অ্যামিষ সম্প্রদায়ের মধ্যেই হয়ে থাকে। সাধারণত ২০-২২ বছর বয়সে তাদের বিয়ে দেওয়া হয়। এবং শুধুমাত্র বিবাহিত পুরুষরা বাধ্যতামূলক দাড়ি রাখে।

ধর্মীয় বিশ্বাস ও নিয়মকানুন

অ্যামিশ জীবনধারা আসলে বাইবেলভিত্তিক এক সরলীকৃত সংস্কৃতি। তারা বিশ্বাস করে, প্রযুক্তিগত সুবিধা বা আধুনিক আরাম-আয়েশ মানুষকে ঈশ্বর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এছাড়া অতিরিক্ত প্রযুক্তি মানুষের মধ্যে অহংকার বাড়ায় এবং সম্প্রদায়ের বন্ধন দুর্বল করে। তাই তারা টেলিভিশন, টেলিফোন, ইন্টারনেট, গাড়ি এমনকি অনেক সময় বিদ্যুৎও ব্যবহার করে না। গাড়ির পরিবর্তে তারা ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করে। এবং বৈদ্যুতিক বাতির বদলে কেরোসিন ল্যাম্পের উপর নির্ভর করে।

তবে সব অ্যামিশ একই নিয়ম মেনে চলে না। ‘ওল্ড অর্ডার’ অ্যামিশরা সবচেয়ে কঠোর, অন্যদিকে কিছু সম্প্রদায় শিক্ষা ও ব্যবসার ক্ষেত্রে একটু নমনীয়।

বাইবেলের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা অনুযায়ী তারা জীবন-যাপন করেন। তাদের সমাজে রয়েছে কিছু লিখিত ও অলিখিত আইন, যাকে বলা হয় ‘অর্ডনাং’। এই অর্ডনাং নির্ধারণ করে, কে কীভাবে পোশাক পরবে, গৃহস্থালি কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে, এমনকি বাইরের জগতের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ধরন কি হবে।

প্রতিটি সম্প্রদায়ের অর্ডনাং আলাদা হতে পারে। এসব নিয়ম না মানলে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, একে বলা হয় ‘শুনিং’। শুনিং এর ভয়ে সবাই নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য হয়।

অ্যামিষ সমাজে অপরাধের হার অত্যন্ত কম। নেশা বা পারিবারিক ভাঙনের মতো সামাজিক সমস্যা একেবারেই নেই বললেই চলে।

শিক্ষা ও অর্থনৈতিক জীবন

অ্যামিশ সমাজে শিক্ষাব্যবস্থা সাধারণত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সীমিত। তারা বিশ্বাস করে কৃষিকাজ, কাঠের কাজ কিংবা সেলাই-কারুকার্য শিশুদের জীবনে বেশি কার্যকর শিক্ষা। এজন্য তাদের স্কুলগুলোতে মূলত গণিত, প্রাথমিক ইংরেজি এবং ধর্মীয় শিক্ষা পড়ানো হয়।

অর্থনৈতিকভাবে অ্যামিষরা কৃষিভিত্তিক। ভুট্টা, গম, শাকসবজি উৎপাদন এবং পশুপালন তাদের মূল আয়। পাশাপাশি কাঠের আসবাবপত্র তৈরি, হস্তশিল্প ও বেকারি চালিয়ে অনেকেই আয় করে। আধুনিক মেশিন ছাড়া হাতে তৈরি পণ্যের জন্য তাদের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

রামস্প্রিংগা

অ্যামিষ সম্প্রদায়ের কিশোর-কিশোরীদের জন্য একটি একটি অনন্য রীতি হল রামস্প্রিংগা। সাধারণত ১৬ বছর বয়স থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত রামস্প্রিংগা পর্ব চলে। জার্মান ভাষায় “rum” মানে আশেপাশে ঘোরা এবং “springen” মানে লাফানো, তাই এটি একরকম “আশেপাশে লাফিয়ে বেড়ানো” বা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর সময়। এই সময়ে যুবক-যুবতীরা অ্যামিষ সম্প্রদায়ের কঠোর নিয়ম থেকে কিছুটা ছুটি পায়, যাতে তারা আধুনিক প্রযুক্তি, ইচ্ছেমত পোশাক, সঙ্গীত বা পার্টি করার মত বাইরের দুনিয়াটা দেখতে পারে। এর উদ্দেশ্য হলো যাতে তারা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর নিজের ইচ্ছায় অ্যামিষ চার্চে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

যদিও এধরনের স্বাধীন জীবন শেষে প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ যুবক-যুবতী আবারো অ্যামিষ সমাজে ফিরে আসে। তবে সব অ্যামিষ গ্রুপে এটি একইভাবে পালিত হয় না; কোথাও এটি খুব ঢিলেঢালা, আবার কোথাও কঠোরভাবে পালিত হয়। এই রীতি অ্যামিষ সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা তাদের বিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করে।

আধুনিক যুগে অ্যামিশ সম্প্রদায়

আজকের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে অ্যামিশ জনগণ যেন সমযয়ের সাথে থেমে থাকা এক সমাজে বাস করে। আধুনিক আমেরিকার বুকে, প্রাচীন ঐতিহ নিয়ে টিকে থাকাটা সত্যিই এক বিষ্ময়। বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ ৭ হাজার অ্যামিষ রয়েছে। তবে প্রতিবছরই তাদের সংখ্যা বাড়ছে।

বর্তমান সময়ে অনেক অ্যামিষ সম্প্রদায় তাদের জীবনে সামান্য পরিবর্তন এনেছে। কৃষি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে তারা আধুনিকতার দারস্থ হচ্ছে। এমনকি কিছু জায়গায় তারা সীমিতভাবে মোবাইল ফোনও ব্যবহার করছে। তবে তারা সচেতনভাবে স্মার্টফোন থেকে দূরে আছে। প্রয়োজনের তাগিদে আধুনিকতার কিছু উপাদান গ্রহণ করলেও, তাদের মূল নীতিমালা ও সংযত জীবন দর্শন আজও বেশিরভাগ অ্যামিষ গোষ্ঠীতে অটুট রয়েছে।

অ্যামিষদের মতই বর্তমান আধুনিক যুগেও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করছে আফ্রিকার ডগোন জনগোষ্ঠী। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল এবং বিস্তৃত মালভূমিতে এরা বাস করে। ডগোনরা এতটাই বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে যে, এদের এক গ্রামের মানুষও আরেক গ্রামের ভাষা বোঝে না।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।