বিশ্বের অন্যতম ক্ষুদ্র দেশ লিচেনস্টাইন
বিশ্বের অন্যতম ক্ষুদ্র দেশ লিচেনস্টাইন
লিচেনস্টাইন
ইউরোপের মাঝখানে, আল্পস পর্বতের পাদদেশে রয়েছে এক অপূর্ব দেশ লিচেনস্টাইন। দেশটি আয়তনে এতটাই ছোট যে, বাংলাদেশের যেকোন উপজেলাও এই দেশের প্রায় দ্বিগুণ বড়।
আয়তনে ছোট হলেও, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, শিক্ষার হার এবং জীবনযাত্রার মানে লিচেনস্টাইন অনেক বৃহৎ ও শক্তিশালী দেশকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে। আল্পস পর্বতের কোলে অবস্থিত হবার কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকেও দেশটি অসাধারণ।
বিশ্ব মানচিত্রে লিচেনস্টাইনের মত এত ছোট অথচ এত সফল দেশ খুব কমই আছে। তাই লিচেনস্টাইনের গল্প শুধু ভৌগোলিক বিস্ময় নয়, এটি এক অনুপ্রেরণার উৎসও বটে।
কীভাবে এমন একটি ছোট্ট রাষ্ট্র বিশাল সাফল্যের পথে হাঁটলো? কীভাবে গড়ে উঠল এর অর্থনীতি? কীভাবে এটি হয়ে উঠল ইউরোপের অন্যতম ধনী দেশ? এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আজকের কিকেনকিভাবে পর্বে আমরা জানব লিচেনস্টাইনের চমৎকার এক ইতিহাস ও বর্তমানের কথা।
কোথায় এই লিচেনস্টাইন?
ইউরোপের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র অথচ চমকপ্রদ দেশ লিচেনস্টাইন। এটি একটি ল্যান্ডলকড কান্ট্রি, অর্থাৎ দেশটি চারদিকে ভূমি দিয়ে ঘেরা; দেশটির কোনো সমুদ্রসীমা নেই। লিচেনস্টাইনের পশ্চিমে সুইজারল্যান্ড, আর পূর্বে অস্ট্রিয়া। আল্পস পর্বতমালার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই দেশটি আয়তন মাত্র ১৬০ বর্গকিলোমিটার। এখানকার পরিচ্ছন্ন রাস্তা, উন্নত অবকাঠামো, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং উচ্চমানের জীবনযাত্রার জন্য দেশটি বিশেষভাবে পরিচিত।
লিচেনস্টাইনের রাজধানীর নাম (Vaduz)। যেখানে চমকপ্রদ রাজপ্রাসাদ, আধুনিক জাদুঘর এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাঙ্কিং হাবের পাশাপাশি রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর শৈল্পিক দৃশ্যপট।
দেশটির মোট জনসংখ্যা মাত্র ৪০ হাজারের মতো হলেও নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষার হার প্রায় শতভাগ। এখানকার সরকারি ভাষা জার্মান, তবে স্থানীয়রা নিজেদের অঞ্চলের একটি স্বতন্ত্র উপভাষায় কথা বলেন, যা অনেকটা অস্ট্রিয়ান জার্মানের মতো।
রাজনীতিতে লিচেনস্টাইন এক অভিনব মডেল, এটি একটি রাজতন্ত্রভিত্তিক গণতন্ত্র। জনগণের ভোটে সংসদ নির্বাচিত হলেও দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা এখনোও রাজপরিবারের হাতেই রয়েছে। লিচেনস্টাইনের বর্তমান রাজা প্রিন্স দ্বিতীয় হান্স-অ্যাডাম। তিনি একজন দক্ষ অর্থনীতিবিদ ও সফল ব্যবসায়ী হিসেবেও সুপরিচিত।
লিচেনস্টাইনের শান্তিপূর্ণ অবস্থান ও পররাষ্ট্র নীতির কারণে দেশটির কোন সেনাবাহিনী নেই। প্রতিবেশী দেশ সুইজারল্যান্ড এই দেশের জাতীয় প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করে। এখানে সেনাবাহিনীর অবশ্য দরকারও পড়ে না। কারণ দীর্ঘ সময় ধরে লিচেনস্টাইনে কোন যুদ্ধ বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। ফলে দেশটিকে ইউরোপের সবচেয়ে স্থিতিশীল এবং বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ রাষ্ট্রগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানকার নাগরিকেরা খুবই নিয়ম মেনে চলেন। লিচেনস্টাইন ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে; এই দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যা দেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে।
এক কথায়, লিচেনস্টাইন হলো এমন এক দেশ, যেখানে আধুনিকতা, ঐতিহ্য এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দারুণ মেলবন্ধন ঘটেছে।
কিভাবে এত ধনী?
লিচেনস্টাইনের আয়তন খুবই ছোট হলেও, অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিক দিয়ে এটি বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশগুলোর একটি। এই ক্ষুদ্র দেশটি একসময় বিশ্বের অন্যতম ট্যাক্স হ্যাভেন হিসেবে পরিচিত ছিল। অর্থাৎ, এখানে অনেক কম ট্যাক্সের বিনিময়ে ব্যবসায়িক কম্পানি নিবন্ধন বা সম্পদ জমা রাখা যেত। সেকারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় বিনিয়োগকারী ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান লিচেনস্টাইনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক চাপের কারণে এই নীতিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবুও এখানকার ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত এখনো বিশ্বমানের।
লিচেনস্টাইনের অর্থনীতির আরেকটি চমকপ্রদ দিক হলো, এখানে বহু উচ্চপ্রযুক্তির কোম্পানি রয়েছে, যারা মূলত আধুনিক যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা সরঞ্জাম, এবং শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন করে থাকে। এগুলো শুধু দেশের চাহিদাই পূরণই করে না, বরং বিশ্বের নানা দেশে রপ্তানি হয়। ফলে এত ছোট একটি দেশ হয়েও এটি বহির্বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে একটি শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে।
পর্যটন শিল্পও লিচেনস্টাইনের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাজপ্রাসাদ, পাহাড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জাদুঘর এবং চমৎকার হাইকিং বা ট্রেইলপথ দেশটিকে ইউরোপের অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত করেছে। তবে আয়তনে ছোট হওয়ার কারণে দেশটিতে কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নেই। সুইজারল্যান্ডের জুরিখ কিংবা অস্ট্রিয়ার ইনসব্রুক বিমানবন্দর থেকে পর্যটকরা সড়কপথে সহজেই দেশটিতে যেতে পারে।
সব মিলিয়ে, লিচেনস্টাইন এমন এক অবিশ্বাস্য উদাহরণ, যেখানে আয়তনের সীমাবদ্ধতা অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে আটকে রাখতে পারেনি। বরং জ্ঞানভিত্তিক শিল্প, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মাধ্যমে দেশটি প্রমাণ করেছে যে, ছোট দেশও তাদের কর্মের মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।