ট্রাম্প পুতিন এর আলাস্কা বৈঠক

maxresdefault (1)
জীবনযাপন

ট্রাম্প পুতিন এর আলাস্কা বৈঠক

ভূমিকা

সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন; আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজ শহরের এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন যৌথ সামরিক ঘাঁটিতে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন।

রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করার পর এটিই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী এই শীর্ষ বৈঠকে উভয় নেতা ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেন এবং বৈঠক শেষে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনেও অংশ নেন।

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের ফলাফল কী ?

বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য

আলাস্কা সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটানো বা অন্তত যুদ্ধবিরতির পথ প্রশস্ত করা। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল, তাই সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ থামানোর প্রচেষ্টা হিসেবে আলাস্কার এই শীর্ষ বৈঠকটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করছিল।

বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আশা করেছিলেন যে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে একটি যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে সমঝোতা শুরু করতে পারবেন। উভয় নেতা ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি নিয়ে কথা বলতে সম্মত হন।

বৈঠকের ফলাফল ও গুরুত্বপূর্ণ অর্জন

ট্রাম্প-পুতিন তিন ঘন্টার আলোচনার পর কোনো লিখিত শান্তিচুক্তি কিংবা অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির ঘোষণা হয়নি। যখন আলোচনা চলছিলেন, ঠিক সেই মুহুর্তেও রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা অব্যাহত রেখেছিল। অর্থাৎ আলোচনার মাঝেও যুদ্ধের কার্যক্রম থামেনি, তারমানে এই আলোচনা যুদ্ধের ময়দানে পরিস্থিতি বদলাতে ব্যার্থ হয়েছে।

পুতিন প্রস্তাব দেন যে ইউক্রেন যদি পূর্বাঞ্চলীয় ডনবাস অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ডনেস্ক সম্পূর্ণরূপে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়, তাহলে রাশিয়া ইউক্রেনে তার বর্তমান দখলকৃত ফ্রন্টলাইনগুলোতে যুদ্ধ স্থগিত করতে পারে। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই দাবিকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। রাশিয়া ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের প্রায় ২০% ভূমি দখলে রেখেছে, যার মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ ডনেস্ক প্রদেশের এলাকা অন্তর্ভুক্ত।

ট্রাম্প বৈঠকের আগে বলেছিলেন যে প্রথমে যুদ্ধবিরতি চাই, তারপর শান্তি আলোচনা, কিন্তু আলোচনার পর তিনি নিজের অবস্থান বদলেছেন। তিনি পুতিনের যুক্তির সঙ্গে একমত হয়ে বলেছেন যে আগে থেকে যুদ্ধবিরতি না করে সরাসরি চূড়ান্ত শান্তিচুক্তির জন্য আলোচনা করা উচিত। অর্থাৎ ট্রাম্প এখন মনে করছেন যুদ্ধবিরতির চেয়ে সমগ্র যুদ্ধ বন্ধ করার চুক্তিই অগ্রাধিকার পেতে হবে, কারণ অনেক সময় সাময়িক যুদ্ধবিরতি টিকে না।

আলোচনায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু ভূখণ্ডের বিনিময় নিয়ে কথা হয়েছে। রাশিয়া তাদের দখলকৃত কিছু ছোট এলাকা ছেড়ে দেবে, বিনিময়ে ইউক্রেন বৃহত্তর ডনবাসের মতো অঞ্চল রাশিয়াকে দিতে হবে। বিনিময়ে ইউক্রেনের জন্য নিরাপত্তা গ্যারান্টি দেওয়ার বিষয় নিয়ে দুই নেতা আলোচনা করেছেন। ট্রাম্প দাবি করেন তারা “প্রায় বেশিরভাগ ব্যাপারে” একমত হয়েছেন। ট্রাম্পের ভাষ্য, “আমি মনে করি আমরা চুক্তির একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেছি,” তবে চুক্তির জন্য ইউক্রেনের সম্মতি লাগবে এবং ইউক্রেন হয়ত চুক্তির বিষয়ে না বলতেও পারে।

এই বৈঠকে কোনো সুস্পষ্ট সমাধান বের না হওয়ায়; উভয় নেতা পরবর্তীতে আবার সাক্ষাৎ করার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈঠক শেষে ট্রাম্প পুতিনকে বলেন, “আমরা খুব শিগগিরই আবার আপনার সাথে কথা বলব এবং সম্ভবত আবার দেখা হবে,” যার জবাবে পুতিন হাসতে হাসতে ইংরেজিতে বলেন, “পরেরবার মস্কোতে”। অর্থাৎ সম্ভাব্য পরবর্তী শীর্ষ বৈঠক মস্কোতে হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

কোন পক্ষ কী অর্জন করেছে

বিশ্লেষকদের মতে এই সম্মেলনে ভ্লাদিমির পুতিন উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সুবিধা অর্জন করেছেন। তিনি তার মূল দাবিগুলো থেকে একটুও সরেননি। পুতিন এখনো চান ইউক্রেন কখনো ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না। এবং ডনবাসের মতো পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলো পুরোপুরি রাশিয়ার অধীনে দিতে হবে। কোনো বড় ছাড় না দিয়েই পুতিন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা করে, পশ্চিমা বিশ্বে তার পক্ষে এক ধরনের বৈধতা তৈরী করেছেন। পশ্চিমা নেতারা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পুতিনকে কার্যত একঘরে করে রেখেছিলেন, এবং মাত্র এক সপ্তাহ আগেও ট্রাম্প প্রশাসন তার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের সাথে আলাস্কার মঞ্চে আলোচনায় বসা এবং টাম্পকে নিজের ইচ্ছার পক্ষে রাজি করানো পুতিনের জন্য অভাবনীয় সাফল্য হিসেবে দেখছেন রজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি করাতে না পারলেও, তিনি এই বৈঠককে সম্পূর্ণ ব্যর্থ মনে করছেন না। বরং একে খুবই ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করছেন। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন যে ইউক্রেনের উচিত বাস্তবতা বিবেচনা করে রাশিয়ার সাথে একটা সমঝোতায় পৌঁছানো, কেননা “রাশিয়া একটি শক্তিধর শক্তি, আর ইউক্রেন ততটা নয়।” এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি ইউক্রেনকে চুক্তি করতে উৎসাহিত করেছেন। ট্রাম্পের মতে পুতিনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে এবং তিনি আশাবাদী যে শিগগিরই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি চুক্তি করা সম্ভব হবে। বৈঠকের ফলাফল হিসেবে ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে ওয়াশিংটনে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। যদিও সর্বশেষ বৈঠকে ট্রাম্পে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে নজির বিহীন অপমান করে হোয়াইট হাউজ থেকে বের করে দিয়েছিল। তবে খুব শীগ্রই আবারো জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনায় বসার পরিকল্পনা করেছেন ট্রাম্প। ধারণা করা হচ্ছে, সেই আলোচনায় ইউরোপীয় মিত্রদের কিছু প্রতিনিধিও উপস্থিত থাকতে পারে, যাতে সম্ভাব্য শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের ঐক্যমত নিশ্চিত করা যায়।

ইউক্রেনের প্রতিক্রিয়া

ইউক্রেন শুরু থেকেই পরিষ্কার করে বলেছে যে তারা নিজের ভূখণ্ডের ওপর রুশ দখল মেনে নেবে এবং কোনো অংশ ছেড়ে দেওয়ার শর্তে শান্তি চুক্তি করবে না। আলাস্কা বৈঠকে পুতিন যখন ডনেস্ক প্রদেশ ছেড়ে দেওয়ার শর্তের বিনিময়ে যুদ্ধ থামানোর করার প্রস্তাব দেন, তখনই জেলেনস্কি তা সরাসরি নাকচ করেছেন। জেলেনস্কি বৈঠকের পর মন্তব্য করেন, রাশিয়া যদি লড়াই থামাতে রাজি না হয় তবে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা জটিল হয়ে পড়বে।

ইউক্রেনের দৃষ্টিতে রাশিয়ার সদিচ্ছার প্রমাণ হলো যুদ্ধক্ষেত্রে অন্তত সাময়িক বিরতি; কিন্তু পুতিন তা মানতে নারাজ, ফলে কিয়েভ আশঙ্কা করছে যে যুদ্ধ চালু রেখেই চাপ দিয়ে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা চলছে। তবুও, জেলেনস্কি কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়ে যেতে রাজি আছেন এবং বৈঠকের ফলাফল সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেও তিনি আলোচনার পথ পুরোপুরি বন্ধ করেননি; তাই ট্রাম্পের আমন্ত্রণে তিনি পরবর্তীতে ওয়াশিংটনে আলোচনায় অংশ নিতে সম্মত হয়েছেন।

ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ইউরোপীয় মিত্ররা ট্রাম্প-পুতিন বৈঠককে সমর্থন জানালেও তাঁদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। ইউরোপীয় নেতারা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন যে সম্ভাব্য শান্তিচুক্তিতে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য “লোহার দেয়ালের মতো কঠোর” গ্যারান্টি থাকতে হবে এবং সেই সাথে রাশিয়া যা চাইছে সেই অনুযায়ী ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বা তার ন্যাটো জোটে যোগদানের অধিকার সীমিত করা যাবে না।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার মন্তব্য করেছেন যে ট্রাম্পের প্রচেষ্টার কারণে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি দেখা দিচ্ছে। তবে তিনি সতর্ক করেছেন যে যদি যুদ্ধ অব্যাহত থাকে তবে রাশিয়ার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। অন্যদিকে কিছু ইউরোপীয় বিশ্লেষক এই বৈঠককে নিয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছেন। জার্মানির সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বিশ্লেষক উলফগ্যাং ইশিঞ্জার সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “পুতিন ট্রাম্পের কাছ থেকে লাল গালিচা সম্বর্ধনা পেয়েছে, কিন্তু বিনিময়ে ট্রাম্প কিছুই পায়নি”। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া ইঙ্গিত করে যে ইউরোপে অনেকেই মনে করছেন আলাস্কা সম্মেলন তাৎক্ষণিকভাবে পশ্চিমাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়নি। উল্টো পুতিন কোনো বাস্তব ছাড় না দিয়েই কূটনৈতিক স্বীকৃতি পেয়ে গেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের সম্ভাব্য সমাপ্তি

আলাস্কার এই শীর্ষ বৈঠকের পর প্রশ্ন উঠছে যে এর ফলে ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো দ্রুত সমাপ্তি আসতে পারে কি না। বিশ্লেষকদের মত অনুযায়ী, এই এক বৈঠকের ফলে যুদ্ধ থামার সম্ভাবনা নেই। পুতিন আলোচনায় কোনো বাস্তব ছাড় দেয়নি এবং যুদ্ধ বন্ধের বদলে আরও ভূখণ্ড দাবি করেছে, যা থেকে বোঝা যায় যে অবস্থানগতভাবে রাশিয়া খুব একটা নমনীয় হয়নি এবং শান্তির পথে তাত্ক্ষণিক অগ্রগতি নেই বললেই চলে।

অনেকে মনে করেন, ট্রাম্প এই বৈঠকের মাধ্যমে আলোচনার দ্বার খুলতে পেরেছেন বটে। তবে ইউক্রেনকে বিশাল ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার মত সম্ভাব্য চুক্তির শর্তগুলো  বাস্তবে কার্যকর করা খুব কঠিন হবে বলে। জেলেনস্কি বারবারই বলেছেন কোন অঞ্চলের উপর রুশ দখল মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করে এমন শান্তি তারা সমর্থন করবে না।

সর্বোপরি, ট্রাম্প-পুতিন আলাস্কা বৈঠকটি যুদ্ধ অবসানের একটি সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে বটে, কিন্তু তা তাৎক্ষণিক ফলপ্রসূ সমাধান এনে দেয়নি। তবুও দীর্ঘ সময় পর যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সরাসরি আলোচনায় বসায় কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। এই অধ্যায় সফল হবে কি না তা নির্ভর করবে পরবর্তী কূটনৈতিক উদ্যোগগুলোর ওপর।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।