এআই যাদের চাকরি খাবে
এআই যাদের চাকরি খাবে
প্রযুক্তির আগমনে পেশার পালাবদল
একটা সময় কম্পিউটার এসে দুনিয়ার অনেক পেশার ধরণ বদলে দিয়েছিল। টাইপরাইটারের জায়গা নিয়েছে কম্পিউটার, হাতে লেখা চিঠির বদলে এসেছে ইমেইল, আর কাগজের হিসাবখাতার পরিবর্তে এসেছে এক্সেল শিট। এরকম নানা এনালগ ধাঁচের কাজ ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছে প্রযুক্তির স্রোতে। আজকের দিনে প্রযুক্তির সেই ঢেউ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের মাধ্যমে আরও ভয়াবহ হয়ে এসেছে। এই নতুন প্রযুক্তি শুধু মানুষের সহকারী নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে মানুষের জায়গা দখল করে নিচ্ছে অবিশ্বাস্য গতিতে।
যার ফলে আগামী ১০ বছরে বিশ্বের অর্ধেক লোক তাদের প্রচলিত চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। বিপরীতে বিপুল সংখ্যক নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরী হবে, যার জন্য দরকার হবে এআই এর দক্ষতা।
কেন এআই এত দ্রুত কাজ দখল করছে
এআইয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর গতি ও নির্ভুলতা। মানুষ যেখানে একটি রিপোর্ট বা তথ্য সাজাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নেয়, এআই সেটি কয়েক সেকেন্ডে করে ফেলে। আর ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এটি এক বিশাল সুবিধা। কারণ মানব কর্মীর মত, এআই এজেন্টের বেতন, ছুটি, স্বাস্থ্যসেবা বা কাজের বিরতির দরকার হয় না। এআই ২৪ ঘণ্টা একটানা একই মানে কাজ করে যেতে পারে। ফলে যে কাজগুলো নিয়মিত, পুনরাবৃত্তিমূলক এবং নির্দিষ্ট ধাপে ধাপে হয়, সেখানে মানুষের বদলে এআই ব্যবহার করা অনেক সস্তা ও কার্যকর হয়ে উঠেছে। আর তাই আগে যে প্রতিষ্ঠানে এক হাজার লোক কাজ করত, সেই একই প্রতিষ্ঠান এখন মাত্র ১০০ জন লোক দিয়েও আগের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করতে পারবে। বর্তমানে এই ১০০ জন লোকের মূল কাজ হল, সঠিকভাবে এআই কে পরিচালনা করা।
ঝুঁকিতে থাকা পেশা কোনগুলো
এআই এর আগমনের পর প্রথমেই বিপদের মুখে পড়েছে ডাটা এন্ট্রি, সাধারণ হিসাবরক্ষণ, টিকিট বুকিং বা কল সেন্টারের মতো রুটিন কাজের কর্মীরা। আগে যেখানে একজন গ্রাহক সেবা কর্মকর্তা ফোন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রশ্নের উত্তর দিতেন, সেখানে এখন বসানো হচ্ছে ভয়েস-বট বা চ্যাটবট, যা একইসঙ্গে শত শত মানুষের সাথে কথা বলতে পারে।
আইনজীবীর সহকারী বা হিসাবরক্ষকের মতো অফিসভিত্তিক পেশায়ও এআই বড় ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। নথিপত্র যাচাই, চুক্তিপত্র তৈরি বা হিসাব বিশ্লেষণের মতো কাজ আগে জুনিয়র স্টাফরা করতেন। এখন সেই কাজের বড় অংশ করে ফেলছে বিশেষ এআই সফটওয়্যার। এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো কম কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে বা বিদ্যমান কর্মীদের অন্য বিভাগে সরিয়ে দিচ্ছে।
আর্থিক খাতে এআইয়ের প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্ট। অনেক ব্যাংক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান লেনদেন পর্যবেক্ষণ, জালিয়াতি শনাক্তকরণ কিংবা শেয়ার বাজার বিশ্লেষণের মতো কাজ সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় করে ফেলেছে।
উন্নত বিশ্বের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসছে। খেলাধুলার ফলাফল, আবহাওয়ার খবর বা শেয়ার বাজারের ওঠানামার মতো তথ্য-ভিত্তিক খবর এখন, মুহূর্তের মধ্যেই তৈরি করে ফেলতে পারে এআই। ফলে বিশ্বের বহু গণমাধ্যমে এ ধরনের বেসিক নিউজ রাইটিং এর জন্য মানুষের প্রয়োজন কমে যাচ্ছে।
উৎপাদন শিল্পও এই ঢেউয়ের বাইরে নয়। প্যাকিং, অ্যাসেম্বলি, মান যাচাইয়ের মত কাজ এখন রোবট দিয়ে করা হচ্ছে। এগুলো মানুষের তুলনায় দ্রুত, নিখুঁত এবং দিনরাত কাজ করতে সক্ষম। ফলে হাজার হাজার শ্রমিকের কাজ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
কতজন চাকরি হারাতে পারে?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রযুক্তি জায়ান্ট ও আউটসোর্সিং কোম্পানিগুলো ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই করেছে। ভারতের আইটি কোম্পানি TCS সম্প্রতি প্রায় ১২ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে, আর এই কাজগুলো এখন করানো হচ্ছে এআই কে দিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের বিশ্লেষণাত্মক কাজের ৭০–৮০ শতাংশ এআই সিস্টেমের হাতে তুলে দিয়েছে। এমনকি কিছু মিডিয়া হাউসও সীমিত সংখ্যক সাংবাদিক দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, কারণ ডাটা-ভিত্তিক খবর এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়।
২০২৫ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম (WEF) এর Future of Jobs Report অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ১০ কোটি কর্মসংস্থান অদৃশ্য হতে পারে। তবে এই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, এআই এর কারণে প্রায় ১৭ কোটি নতুন চাকরিও সৃষ্টি হবে।
Forbes এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, Goldman Sachs-এর হিসাব অনুযায়ী, ৩০ কোটি ফুল টাইম জম এআই দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে যাচ্ছে।
এছাড়া IMF জানিয়েছে যে, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ চাকরির উপর এআই এর প্রভাব পড়বে। তারমানে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক কর্মী সরাসরি চাকরি না হারালেও, তাদের কর্মক্ষেত্র এবং কাজের উপাদান বদলে যাবে।
তবে এসব ধারণার বিপরীতে MIT একটি হিসেব মতে, আগামী দশকে মাত্র ৫% কাজে এআইয়ের দ্বারা পরিবর্তন আসতে পারে। তারমানে এসব আশঙ্কা এবং পূর্বাভাসগুলোর বেশিরভাগই অতিরঞ্জিত হতে পারে। ভবিষ্যতে কতলোক চাকরি হারাবে, তা নিয়ে হয়ত বিতর্ক থাকতে পারে; তবে এআই যে মানুষের কাজের ধরন আমূল বদলে দিবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।