ক্রাইম মিনিস্টার নেতানিয়াহু

maxresdefault (1)
জীবনযাপন

ক্রাইম মিনিস্টার নেতানিয়াহু

ভূমিকা

বর্তমানে বিশ্ব মানবতার এক নম্বর শত্রু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সাম্প্রতিক সময়ে সারা বিশ্বের মানুষ, গাজায় গণহত্যা চালানোর জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যেমন প্রতিবাদ করছে। তেমনিভাবে ইসরায়েলের মধ্যেও নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চলছে ব্যাপক বিক্ষোভ। একের পর এক দুর্নীতি আর নিজের অপকর্ম ঢাকতে, নেতানিয়াহু মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ইসরায়েলের ক্ষমতার মসনদে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে, নেতানিয়াহু আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু করতেও পিছপা হয়নি। সেকারণে খোদ ইসরায়েলীরাই তাকে প্রাইম মিনিস্টারের বদলে, ক্রাইম মিনিস্টার বলেই অভিহিত করছে। মানবতা বিরোধী অপরাধে নেতানিয়াহ যেন হিটলারকেও ছাড়িয়ে গেছে।

নেতানিয়াহুকে কেন ক্রাইম মিনিস্টার বলা হয় ?

হামাসকে শক্তিশালী করণ

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, ইসরায়েলের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধী এই প্রধানমন্ত্রী, নিজের দেশেই এখন ব্যাপকভাবে অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। একসময় যিনি রাজনৈতিক দক্ষতা আর নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে সমর্থন পেতেন, আজ তিনি ইসরায়েলি সমাজের বড় একটি অংশের ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু।

বর্তমানে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অজনপ্রিয়তা সবচেয়ে বড় বিষয়। শুধু বিভিন্ন পোল এবং জনমত জরিপের ফলাফলই নয়, বরং ইসরায়েলের বড় বড় শহরের রাস্তায় নেতানিয়াহু বিরোধী মিছিল দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।

২০২৫ সালের সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, প্রায় ৭০-৮০% ইসরায়েলি নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে আস্থা হারিয়েছে এবং তার সবাই নেতানিয়াহুর পদত্যাগ চান। এর পিছনে বেশ কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে, যার মধ্যে বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ, দুর্নীতির অভিযোগ, যুদ্ধ পরিচালনায় বিতর্ক, এবং রাজনৈতিকভাবে একপাক্ষিক হয়ে পড়া অন্যতম কারণ।

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অজনপ্রিয়তার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে অনেক ইসরায়েলি সরাসরি তার নিরাপত্তা নীতি ও কৌশলকে দায়ী করেন। সমালোচকদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে তার নীতিমালা পরোক্ষভাবে হামাসকে শক্তিশালী করেছে। উদাহরণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন, নেতানিয়াহু কাতার থেকে আসা বিপুল অর্থ হামাসের কাছে পৌঁছানোর অনুমতি দিয়েছিল। যা মূলত গাজার অবকাঠামো বা সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য নয়, বরং হামাসের সংগঠন ও অস্ত্রভান্ডার মজবুত করার জন্য ব্যবহার হয়েছে।

আরেকটি বড় বিতর্কিত পদক্ষেপ ছিল গাজার সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়া এবং সেগুলোকে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে মোতায়েন করা। এই পদক্ষেপে দক্ষিণ সীমান্তে নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়ে। এরই সুযোগে হামাসের আকস্মিক আক্রমণে ১২০০-এরও বেশি ইসরায়েলি নিহত হয়—যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়।

অনেকে আরও অভিযোগ করেন, হামলার আগে মিশরীয় ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সতর্কবার্তা নেতানিয়াহু উপেক্ষা করেছিলেন। অনেকেই বলেন, নেতানিয়াহু ইচ্ছাকৃতভাবে হামাসের হামলা ঘটতে দিয়েছে, যাতে করে সে তার প্রতিশোধ হিসেব অনায়াসে গাজায় জাতিগত নিধন চালাতে পারে। এসব উপেক্ষা ও ভুল সিদ্ধান্ত মিলিয়ে ইসরায়েলি জনগণের একাংশ মনে করে, এই বিপর্যয় মূলত তার নেতৃত্বের ব্যর্থতার ফল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই তার প্রতি জনঅসন্তোষ আরও বেড়েছে, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

দুর্নীতি এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের অভিযোগ

নেতানিয়াহু ২০১৯ সাল থেকে দুর্নীতি, ফ্রড এবং বিশ্বাসভঙ্গের মামলায় অভিযুক্ত। অনেক ইসরায়েলি বিশ্বাস করেন যে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন শুধুমাত্র জেল এড়ানোর জন্য, কারণ যুদ্ধকালীন অবস্থায় তার মামলা স্থগিত রয়েছে। গাজা যুদ্ধে তার সিদ্ধান্তগুলো ব্যক্তিগত স্বার্থের পক্ষে এবং ইসরায়েলী জাতীয় স্বার্থের বিরোধী হিসেবেই দেখা হচ্ছে। একটি জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৩৩% ইসরায়েলি বিশ্বাস করে যে নেতানিয়াহুর নীতি জাতীয় স্বার্থে পরিচালিত। তারমানে ইসরায়েলের বাকি ৬৭ শতাংশ লোকই নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে।

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ২০২৩-এর জুডিশিয়াল রিফর্মের চেষ্টা করেছিল, যার লক্ষ্য ছিল সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা কমানো। নেতানিয়াহুর সেই সিদ্ধান্তেও ইসরায়েল বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়। অনেকেই সেই ঘটনাকে “কনস্টিটিউশনাল কু” বা সাংবিধানিক অভ্যুত্থান হিসেবে দেখে; যা ইসরায়েলের গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল।

ইসরায়েলে মূলত ৭টি কট্টর ডানপন্থী দলের জোট সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছে লিকুদ পার্টির নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর রিলিজিয়াস জায়নিস্ট পার্টির প্রভাবশালী নেতা ইটামার বেন গাভির মন্ত্রী সভা থেকে পদত্যাগ করেছিল। এছাড়া বর্তমান জোট সরকারের অন্যান্য কট্টরপন্থীরাও নেতানিয়াহুর সরকার ভেঙে দেওয়ার চাপ সৃষ্টি করে।

ক্ষমতাসীন সরকারের এই জোট যদি ভেঙে যায় তাহলে ইসরায়েলে আবার নতুন করে নির্বাচন হবে। আর ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে রয়েছে, তাই নতুন করে নির্বাচন হলে নেতানিয়াহুর ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। সেকারণে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দীর্ঘ দুই বছর যাবৎ গাজায় নজিরবিহীন গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।

তাছাড়া গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলীদের সমর্থনের অন্যতম কারণ ছিল বন্দীদের মুক্ত করে আনা। কিন্তু নেতানিয়াহু সরকার ইসরায়েলী বন্দীদের মুক্ত করার জন্য কোন ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এছাড়া, যুদ্ধের কারণে ইসরায়েলের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবনতি দেশজুড়ে নেতানিয়াহুর জপ্রিয়তা সম্পূর্ণ ধূলিস্মাৎ করে দিয়েছে।

ক্রাইম মিনিস্টার

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরোধীরা ২০১৯ সালে তাকে “প্রাইম মিনিস্টার” এর বদলে “ক্রাইম মিনিস্টার” হিসেবে অপমানজনক উপাধি দিয়েছে।

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তিনটি প্রধান মামলা রয়েছে, যা তার এই উপাধির মূল কারণ। এগুলোতে তিনি ঘুষ, প্রতারণা এবং বিশ্বাসভঙ্গের জন্য অভিযুক্ত হয়েছেন। এসব মামলায় তার ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের সম্ভাবনা রয়েছে।

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ হল, Bezeq Telecom কোম্পানিকে সে প্রায় ১.৮ বিলিয়ন শেকেল বা প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের রেগুলেটরি সুবিধা দিয়েছে। এর বিনিময়ে সেই কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান শাউল এলোভিচের নিয়ন্ত্রিত একটি নিউজ ওয়েবসাইটে; নেতানিয়াহু তার নিজের এবং তার স্ত্রীর পজিটিভ কভারেজ পেয়েছেন।

নেতানিয়াহু এবং তার স্ত্রী হলিউড প্রডিউসার আরনন মিলচান এবং অস্ট্রেলিয়ান বিলিয়নিয়ার জেমস প্যাকারের কাছ থেকে প্রায় ৭ লক্ষ শেকেল মূল্যের উপহার গ্রহণ করেছে। এর বিনিময়ে নেতানিয়াহু মিলচানের ব্যবসায়িক স্বার্থে সাহায্য করেছে।

এছাড়া নেতানিয়াহু Yedioth Ahronoth পত্রিকার মালিক আরনন মোজেসের সাথে একটি গোপন চুক্তি করে। যাতে ভালো কভারেজের বিনিময়ে নেতানিয়াহু সেই পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী কম্পানিকে রুখে দিতে আইন পাশ করে।

ইসরায়েলি আইন অনুসারে, তিনি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য নন। সেকারণেও নেতানিয়াহুর মামলাকে বছরের পর বছর টেনে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এই মামলাগুলো অতি সাধারণ দুর্নীতি মামলা মনে হলেও, এসব মামলার কারণে ইসরায়েলের রাজনীতিতে গভীর বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে।

তবে ২০২৪ সালে  আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ICC নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের জন্য ওয়ারেন্ট জারি করার পর; নেতানিয়াহুর “ক্রাইম মিনিস্টার” উপাধির যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। গাজায় স্টারভেশন বা ক্ষুধাকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা বিশ্বব্যাপী নেতানিয়াহুর অজনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়েছে। যার কারণে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি সহ বেশ কিছু ইউরোপীয় মিত্র দেশও এখন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কঠোর বিবৃতি দিয়েছে।

শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে একমুঠো খাবারের জন্য ত্রাণের লাইনে দাঁড়ানো নিরস্ত্র মানুষজনকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালানোর মত সিদ্ধান্ত দিয়েছে এই মানবতা বিরোধী অপরাধী। ইসরায়েল যেভাবে গাজার খাদ্য সহায়তা বন্ধ করে, ত্রাণ পৌঁছাতে বাঁধা দিয়ে, মানুষকে না খাইয়ে মারছে; এটি গণহত্যার একটি সম্পূর্ণ নতুন রূপ সৃষ্টি করেছে। একে বলা হচ্ছে ‘famine by design’।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।