বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রুজ শিপ
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রুজ শিপ
ভূমিকা
একটা সময় ছিল যখন বিশাল কোনো জাহাজের কথা বললে চোখের সামনে ভেসে উঠত কিংবদন্তি টাইটানিকের ছবি। কিন্তু সেই জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে এক আধুনিক দৈত্যাকার জাহাজ Icon of the Seas।
এই জাহাজটি টাইটানিকের চেয়ে শুধু বড় নয়, বরং আকারে প্রায় দুই গুণ। যেখানে টাইটানিক বহন করতে পারত প্রায় ৩,৩০০ যাত্রী, সেখানে Icon of the Seas-এ একসাথে সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি মানুষ ভ্রমণ করতে পারে।
এই স্বপ্নের জাহাজ তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি Royal Caribbean। এটা শুধু একটা জাহাজ নয়, বরং এক বিশাল ভাসমান বিলাসবহুল হোটেল রুম, সাতটি বিশাল সুইমিং পুল, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভাসমান ওয়াটার পার্ক, সুবিশাল থিয়েটার, শপিং মল, ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট, বার, কি নেই এখানে।
স্বপ্নের জাহাজ যেভাবে তৈরি হলো
২০১৬ সালে Royal Caribbean গ্রুপ ঘোষণা দেয়, তারা এমন এক নতুন প্রজন্মের জাহাজ তৈরি করতে যাচ্ছে, যেটি শুধু বড় বা বিলাসবহুলই নয়, বরং প্রযুক্তি, পরিবেশসচেতনতা এবং অভিজ্ঞতার দিক থেকেও আগের সকল জাহাজকে ছাপিয়ে যাবে। তারা এই নতুন সিরিজের নাম দেয় Icon Class।
এই শ্রেণির প্রথম জাহাজ ‘Icon of the Seas’ নির্মিত হয় ফিনল্যান্ডের বিখ্যাত Meyer Turku শিপইয়ার্ডে। জাহাজটির কাঠামো তৈরি, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, প্রযুক্তি সংযোজন মিলিয়ে প্রায় ১০ বছর সময় লাগে। অবশেষে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রমোদতরি প্রথমবারের মতো সমুদ্র যাত্রা করে।
তবে Royal Caribbean এখানেই থেমে থাকেনি। তারা একই ডিজাইন ও ধারণা নিয়ে, ‘Star of the Seas’ নামে আরেকটি জাহাজ তৈরি করেছে। এটি ২০২৫ সালের আগস্টে প্রথম যাত্রা শুরু করবে। এটি Icon of the Seas–এর জমজ বোনের মতো। একই রকম দৈর্ঘ্য, ওজন, যাত্রী ধারণক্ষমতা, এমনকি একই ধরনের অভিজ্ঞতার কারণে যাত্রীরা এর ভেতর থেকে বুঝতেও পারবে না, কোনটি Icon of the Seas আর কোনটি Star of the Seas।
এই প্রতিটি জাহাজের ওজন প্রায় ২ লক্ষ ৫ হাজার গ্রস টন, যা প্রায় ৩৫ হাজার হাতির ওজনের সমান। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১ হাজার ২০০ ফুট বা প্রায় ৪টি ফুটবল মাঠের সমান লম্বা এবং উচ্তায় জাহাজগুলো ২০ তলা বিল্ডিং এর সমান উঁচু। প্রতিটি জাহাজে একসাথে ৭ হাজারের বেশি যাত্রী ও ক্রু সদস্য ভ্রমণ করতে পারে।
Royal Caribbean গ্রুপ তাদের আইকন সিরিজের আওতায় Legend of the Seas নামে আরও দুটি জাহাজ ২০২৬ ও ২০২৭ সালে চালু করার পরিকল্পনায় রয়েছে।
জাহাজ নয়, ভাসমান শহর
‘Icon of the Seas’ কে শুধু একটি জাহাজ বললে ভুল হবে—এটি আসলে এক ভাসমান শহর। আর এই শহরকে সাজানো হয়েছে ৮ টি আলাদা ‘neighborhood’ বা ‘পাড়া’ বা হিসেবে। প্রতিটি পাড়াই পর্যটকদের আলাদা অভিজ্ঞতা দেয়।
যারা আরাম আর প্রশান্তির সন্ধানে থাকেন, তাদের জন্য আছে Chill Island। এখানে আছে চারটি সুইমিং পুল, অারাম চেয়ারে বসে সূর্যাস্ত দেখার বিশেষ ব্যবস্থা।
যারা একটু অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, তাদের ঠিকানা হলো Thrill Island। এখানেই আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভাসমান ওয়াটার পার্ক। ছোট-বড় সবার জন্যই এটি এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
আর যারা একটু রোমান্টিক পরিবেশে সময়টা কাটাতে চায়, তাদের গন্তব্য হল The Hideaway এলাকা। এটি সমুদ্রের উপরে ঝুলে থাকা ইনফিনিটি পুল, ব্যক্তিগত লাউঞ্জ চেয়ার আর সূর্যাস্তের দারুণ দৃশ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে।
Surfside নামের একটি বিশেষ ফ্যামিলি ফ্রেন্ডলি পাড়াও রয়েছে, যেটি শুধুমাত্র শিশু ও পরিবারকেন্দ্রিক। বাচ্চাদের জন্য আলাদা ওয়াটার স্লাইড, খেলাধুলার জায়গা, কার্টুন থিম পার্ক, এমনকি পরিবারের সবাই একসাথে বসে খেতে পারে এমন রেস্টুরেন্টও রয়েছে।
AquaDome নামে জাহাজের একদম উপরের বিশাল কাঁচের গম্বুজের মত আরেকটি বিশেষ এরিয়া আছে। এখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভাসমান ওয়াটার-থিয়েটার।
জাহাজের একদম মাঝখানে রয়েছে Royal Promenade নামের এক আধুনিক বাণিজ্যিক এলাকা। এখানে আছে দোকানপাট, শপিং মল, ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, লাইভ মিউজিকের ব্যবস্থা। এমনকি প্রায় ৩০ হাজার গাছ পালা দিয়ে এখানে একটি কৃত্রিম পার্কের মতও তৈরী করা হয়েছে।
সবশেষে রয়েছে Suite Neighborhood, যেটি মূলত ভিআইপি যাত্রীদের জন্য। এই এলাকাটি শুধুমাত্র স্যুইট ক্লাসের কেবিনে থাকা অতিথিদের জন্য উন্মুক্ত। এখানে রয়েছে ব্যক্তিগত পুল, এক্সক্লুসিভ রেস্টুরেন্ট এবং আলাদা ভিআইপি লাউঞ্জ।
থাকা-খাওয়ায় রাজকীয় আয়োজন
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রুজ শিপ ‘Icon of the Seas’ শুধু বিশাল এক জাহাজ নয়—এটি যেন এক চলমান রাজপ্রাসাদ, যেখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও রাজকীয়।
Icon of the Seas জাহাজের বহু ধরনের আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলো শুধুই ঘুমানোর জায়গা নয়, বরং প্রতিটি কেবিন যেন একেকটি পাঁচ তারকা মানের বিলাস বহুল হোটেল রুম। এখানে মোট ২ হাজার ৮০৫টি কেবিন রয়েছে, যার প্রতিটিই বিশেষভাবে সাজানো।
যারা একটু বাজেটের মধ্যে থাকতে চান, তাদের জন্য রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ইন্টেরিয়র রুম বা ব্যালকনি কেবিন। প্রতিটি কেবিনেই রয়েছে স্মার্ট টিভি, এসি, ব্যক্তিগত বাথরুম, স্টোরেজ স্পেস এবং বিলাসবহুল বিছানা।
আর যারা রাজকীয় বিলাসিতায় বিশ্বাস করেন, তাদের জন্য রয়েছে ‘Royal Loft Suite’, ‘Sunset Corner Suites’, ‘Panoramic Ocean Views’ এবং সবচেয়ে বিখ্যাত ‘Ultimate Family Townhouse’। এই টাউনহাউজ রুমে রয়েছে তিন তলা বিশিষ্ট ঘর, ব্যক্তিগত স্লাইড, সিনেমা স্ক্রিন, বাচ্চাদের খেলার ঘর, দুইটি বাথরুম এবং আলাদা ডাইনিং এরিয়া। কিছু কিছু স্যুইটে ব্যক্তিগত জ্যাকুজি, ব্যালকনি, এমনকি সমুদ্রের দিকে মুখ করে থাকা ইনফিনিটি পুলও রয়েছে। সেই সাথে আছে সুবিশাল ওপেন ডেক ব্যক্তিগত বারান্দা।
এছাড়া বিলাসবহুল স্যুটের অতিথিদের জন্য একজন ব্যক্তিগত বাটলার নির্ধারিত থাকে, যে ২৪ ঘণ্টা অতিথিদের প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার, শো বুকিং বা যেকোনো ব্যবস্থা করে দেয়। অতিথিরা চাইলে জন্মদিন উদযাপন, চমকপ্রদ ক্যান্ডেল-লাইট ডিনার বা বাচ্চাদের জন্য থিমযুক্ত ঘর সাজানোর মত বিশেষ আয়োজনও করাতে পারেন।
এই শিপে আছে ৪০টির বেশি রেস্তোরাঁ, ক্যাফে ও বার। পর্যটকেরা এখানে ইতালিয়ান, জাপানিজ, আমেরিকান, এমনকি ভারতীয় খাবারও খেতে পারবেন। দিনের শুরুতে সকালের নাস্তায় রয়েছে ইউরোপিয়ান বেকারি ও ফলমূল, দুপুরে আন্তর্জাতিক বুফে, আর রাতে মোমবাতির আলোয় সমুদ্র দেখার মতো রোমান্টিক ডিনার। চাইলে কেবিনে বসেও আপনি রুম সার্ভিসের মাধ্যমে পছন্দের খাবার পেতে পারেন।
আপনি যদি ভাবেন, এক সপ্তাহ একই জাহাজে কাটিয়ে ফেলার পর বিরক্ত হয়ে যাবেন, তাহলে ভুল ভাবছেন। এখানে আছে ব্রডওয়ে স্টাইল থিয়েটার, আইস স্কেটিং এরিনা, লাইভ মিউজিক পারফর্মেন্স, ডিজে পার্টি, ক্লাইম্বিং ওয়াল, মিনি গল্ফ, এমনকি বিশাল ভিডিও গেম জোনও। ছোটদের জন্য আছে কার্টুন থিম পার্ক, বাচ্চাদের লাইভ শো আর স্লাইডে ভরা খেলাঘর।
সবকিছু মিলিয়ে Icon of the Seas হল এক ভাসমান পর্যটন শহর। এখানে এক সপ্তাহের যাত্রা শুরু হয় জনপ্রতি প্রায় ২,০০০ মার্কিন ডলার থেকে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকার মতো। তবে কেবিন, খাবার, সময় ও সিজন অনুযায়ী এই খরচ ৩–৪ লক্ষ পর্যন্তও হতে পারে। যারা একটু বেশি বিলাসী, তারা স্যুইট ক্যাটাগরির কেবিন নিতে চায়, তাদের খরচ ৩৫ লক্ষ থেকে কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি
‘Icon of the Seas’ কেবল বিশাল আর বিলাসবহুলই নয়—এটি পরিবেশ নিয়ে সচেতনতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এই জাহাজটি LNG বা Liquefied Natural Gas দিয়ে চালিত হয়। যা প্রচলিত ডিজেল বা ভারী মেরিন ফুয়েলের তুলনায় অনেক কম পরিমাণে সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও কার্বন নিঃসরণ করে। LNG শুধু দূষণ কমায় না, বরং শব্দ দূষণও হ্রাস করে, ফলে এটি সামুদ্রিক জীবজগতের জন্যও তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর।
তাছাড়া, জাহাজটিতে রয়েছে উন্নত বর্জ্য শোধন প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে প্রতিদিনের বর্জ্য, বিশেষ করে তরল বর্জ্য, ফিল্টার করে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হয়। বাথরুম, রান্নাঘর বা অন্যান্য ব্যবহার্য জলের অনেকাংশই রিসাইকেল করে ব্যবহার করা যায়, যাতে পানির অপচয়ও কম হয়।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ফুয়েল সেল সাপোর্টেড পাওয়ার সিস্টেম। এটি একটি পরীক্ষামূলক প্রযুক্তি, যা বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনের জন্য হাইড্রোজেন বা অন্যান্য পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবহার করে।
শুধু জাহাজের ভিতরের প্রযুক্তি নয়, যাত্রী অভিজ্ঞতা উন্নয়নের ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির আধুনিকতা স্পষ্ট। প্রতিটি যাত্রীর হাতে থাকে একটি স্মার্ট RFID ব্যান্ড বা মোবাইল অ্যাপ, যার মাধ্যমে তারা চেক-ইন করতে পারেন, দরজা খুলতে পারেন, খাবার অর্ডার করতে পারেন, কিংবা লাইভ শো বা ওয়াটার পার্কের বুকিংও করতে পারেন। ফলে এটি পুরোপুরি কাগজমুক্ত, ঝামেলামুক্ত, আর ডিজিটালি সংগঠিত এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়।
Icon of the Seas জাহাজটির মালিকানা কম্পানি Royal Caribbean গ্রুপ হলেও, এই Royal Caribbean গ্রুপের মালিকানার ২০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কুখ্যাত বিগ থ্রির। তিনটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ভ্যানগার্ড, ব্ল্যাকরক এবং স্টেট স্ট্রিট কে একসাথে বলা হয় বিগ থ্রি। অ্যাপল, ফেসবুক, গুগল, টেসলা, অ্যামাজন, কোকাকোলাসহ বিশ্বের হাজারো শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে তাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে। এই বিগ থ্রি কিভাবে আমাদের সবার অগোচরে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, সে সম্পর্কে জানতে চাইলে কিকেনকিভাবে র এই ভিডিওটি দেখতে পারেন।
কিকেনকিভাবের পরবর্তী ভিডিও আপলোড হওয়ার সাথে সাথে দেখতে চাইলে, সাবস্ক্রাইব করে বেল আইকনটিতে ক্লিক করুন। আপনি যদি AI শিখে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যেতে চান, তাহলে কিকেনকিভাবে একাডেমির AI দক্ষতা কোর্সে ভর্তি হতে পারেন। কোর্সের লিংক ভিডিও ডেসক্রিপশন ও পিন কমেন্টে দেওয়া আছে।