বিমান দুর্ঘটনায় পুড়ে যাওয়া কতটা অসহনীয়
বিমান দুর্ঘটনায় পুড়ে যাওয়া কতটা অসহনীয়
ভূমিকা
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধ বিমান উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিধ্বস্ত হওয়ার পর এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সরাসরি দুর্ঘটনার শিকার শিক্ষার্থীরা প্রায় ১ হাজার ৫০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ঝলসে েগছে। এই তাপমাত্রায় মানুষের ত্বক, চর্বি, পেশি এমনকি হাড় পর্যন্ত পুড়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, এই তাপমাত্রায় লোহার মতো ধাতুও গলে যায়।
বিমান দুর্ঘটনা
২০২৫ সালের ২১ জুলাই দুপুরে রাজধানী ঢাকার উত্তরা এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। বিমান ধ্বংস হওয়ার মুহূর্তে জ্বালানি ট্যাংক ফেটে গিয়ে তাৎক্ষণিক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে।
ফাইটার জেটগুলোতে সাধারণত Jet Propellant-8 বা JP-8 নামের কেরোসিনভিত্তিক এক ধরনের জ্বালানী ব্যবহৃত হয়। JP-8 উচ্চ-দাহ্যতা সম্পন্ন জ্বালানি। এগুলো সাধারণ জ্বালানীর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং দীর্ঘ সময় ধরে পোড়ে।
এসব জেট ফুয়েল যখন জ্বলে ওঠে, তখন তার তাপমাত্রা সাধারণত ৯৮০°C থেকে শুরু করে ১ হাজার ৯৮০°C পর্যন্ত উঠতে পারে। তবে বিধ্বস্তের সময় যদি আরও ধাতব বস্তু, গোলাবারুদ, ইঞ্জিনের সক্রিয় অংশ এবং অন্য কোন তাপীয় প্রতিক্রিয়া যুক্ত হয়, তাহলে কিছু মুহূর্তের জন্য সেই তাপমাত্রা ২ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বিমানের ধ্বংসাবশেষ দেখলে সহজেই বোঝা যায় যে, এখানে কি পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয়েছিল। প্রচন্ড তাপে বিমানের বাইরের ধাতব আবরণ পর্যন্ত পুড়ে গলে গেছে। এরকম তাপমাত্রায় এক সেকেন্ডের মধ্যেই মানুষের ত্বক সম্পূর্ণ পুড়ে যেতে পারে।
এই তাপে কংক্রিট গলে না গেলেও ফেটে যায়। বিস্ফোরণের সময় যে তাপ ও আগুন তৈরি হয়, তা Radiant Heat বা তাপ তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কেউ যদি দেয়ালের অপর পাশেও থাকে, তারাও ১ম বা ২য় ডিগ্রির বার্নের শিকার হতে পারে। তাছাড়া বিমান বিস্ফোরণের সময় ২০০–২৫০ ডেসিবেল এর মতো বিস্ফোরণের শব্দ হয়। এই শব্দ থেকে যে shockwave তৈরি হয়, তা কানের পর্দা ফাটিয়ে দিতে পারে, যার ফলে স্থায়ী শ্রবণহানি ঘটতে পারে।
আগুনে পোড়ার ধরন
আগুনে শরীর পুড়ে যাওয়ার বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে। এগুলোকে ডিগ্রি দিয়ে বোঝানো হয়। যেমন, ১. First-degree Burn ২. Second-degree Burn ৩. Third-degree Burn এবং ৪. Fourth-degree Burn। First-degree বা ১ম ডিগ্রি বার্ন বলতে শুধু চামড়ার বাইরের অংশ পুড়ে লাল হয়ে যাওয়া বোঝায়। যেমন সানবার্ন বা অতিরিক্ত সূর্যের তাপে এমন হতে পারে। ২য় ডিগ্রি বার্নে ত্বকে ফোসকা পড়ে, প্রচণ্ড ব্যথা হয় এবং ছাল উঠে যেতে পারে। ৩য় ডিগ্রি বার্ন হলে ত্বক, চর্বি, স্নায়ু ও পেশি পুড়ে যায়। এই রকম পোড়ার ক্ষেত্রে ত্বকের সাথে থাকা স্নায়ুই নষ্ট হয়ে যায়, সেকারণে ব্যথাও কমে যায়। এবং ৪র্থ ডিগ্রি বার্ন মানে হল হাড় পর্যন্ত পুড়ে যাওয়া। এই স্তরে যারা পৌছায় তাদের সাধারণত সাথে সাথে মৃত্যু ঘটে।
সাধারণ বাসাবাড়ির চুলায় রান্নার সময় ২০০ থেকে ৩০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপ থাকে। ১৫০০ ডিগ্রির আগুনে দগ্ধ হওয়া মানে শুধুমাত্র পোড়া নয়, এটি জীবন্ত অবস্থায় মৃত্যুর স্বাদ পাওয়া। পৃথিবীতে খুব কম জিনিসের সাথে এই যন্ত্রণার তুলনা করা যায়। শারীরিক যন্ত্রণা ছাড়াও বার্ন ভিকটিমদের মানসিক যন্ত্রণা থাকে আরো বেশি। নিজের শরীর পুড়তে দেখার যে মানসিক যন্ত্রনা, তা চিরজীবনের জন্য ট্রমা তৈরি করে। এই অভিজ্ঞতা এতটাই ভয়ংকর যে, যারা বেঁচে থাকেন, তাদের মনে হয় – এই যন্ত্রনার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো।
প্রথম যখন আগুন গায়ে লাগে, তখনও ত্বকের স্নায়ু একদম সজাগ থাকে। স্নায়ুগুলো প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে। চামড়া গলে যায়, ফোসকা পড়ে এবং চর্বি-টিস্যু গলে গিয়ে হাড় পর্যন্ত পুড়ে যায়। সেই সাথে শরীর দ্রুত পানি হারাতে থাকে। রক্তচাপ পড়ে যায় এবং পোড়া জায়গায় সংক্রমণ শুরু হয়। কারো কারো কিডনি, ফুসফুস, এমনকি হৃদপিণ্ড পর্যন্ত অচল হয়ে যেতে পারে।
পোড়ার শতকরা হার
একজন মানুষের শরীরের যত শতাংশ পুড়ে যায়, সেই পোড়ার পরিমাণ অনুযায়ী কী ধরনের প্রভাব পড়ে এবং রোগীর কতটুকু বাঁচার সম্ভাবনা থকে সেই বিষয়গুলো একটি চার্টে উপস্থাপন করা যাক।
শরীরের ১০% অংশ পুড়ে গেলে হালকা ক্ষতি হয়, এবং এ জাতীয় প্রায় ১০০% রোগীই সুস্থ হয়ে ওঠেন। শরীরের ২০% অংশ পুড়ে যাওয়া গুরুতর বলে বিবেচিত হয়, এবং বাঁচার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশের উপরে। ৩০% অংশ পুড়ে যাওয়া ব্যক্তিরা জটিল অবস্থায় পড়েন। এদের Skin Grafting বা চামড়া প্রতিস্থাপনের দরকার হয়। সঠিক চিকিৎসা না পেলে এই অবস্থায় বাঁচার সম্ভাবনা ৭০ থেকে ৮৫ শতাংশ।
যাদের শরীর ৪০% অংশ পুড়ে যায়, তাদের দ্রুত আইসিইউ-তে ভর্তি করতে হয়। কারণ এদের শ্বাসনালিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং রক্তে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই অবস্থায় বাঁচার সম্ভাবনা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশে নেমে আসে।
৫০% থেকে ৭০% পর্যন্ত পুড়ে যাওয়া ব্যক্তিরা মারাত্মক স্তরের রোগী। বিশেষায়িত বার্ন ইউনিটে এদের চিকিৎসা দিতে হয়, কারণ তাদের চামড়ায় সংক্রমণ হয় এবং কিডনি ফেলিওরের ঝুঁকি থাকে। এই পর্যায়ে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশ।
কারো শরীর ৭০% থেকে ৯০% অংশ পুড়ে যাওয়া প্রায় মৃত্যুর সমান। এদের চামড়া শুধু পোড়ে না, গলে যায়। দেহে রক্ত জমে থাকে না, শরীের কোন তরল ধরে রাখা যায় না এবং অপারেশন করতে হলেও বারে বারে করতে হয়। কৃত্রিম সাপোর্ট, স্কিন ট্রান্সপ্লান্ট এবং ইনটেনসিভ থেরাপির মত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ। এই সময়ের যন্ত্রণা এতটাই বেশি থাকে যে, রোগীরা চেতনা হারিয়ে ফেলে বা ব্যথায় শক-এ চলে যায়।
৯০% থেকে ১০০% শরীর পুড়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মৃত্যু অনিবার্য। এই অবস্থা থেকে কেউ সচরাচর ফেরে না। এদের চামড়া পোড়ার সাথে সাথে দেহের ভেতরের অঙ্গগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। এরকম রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা Palliative Care দিয়ে ব্যথা কমিয়ে, রোগীর মৃত্যুর পথ মসৃণ করার চেষ্টা করেন। এদের শরীরে Burn Shock হয়ে অঙ্গ বিকল হয়ে পড়ে এবং শ্বাস বন্ধ হয়ে একসময় মারা যায়।
Burn Shock কী?
পুড়ে যাওয়ার পর একজন মানুষের শরীরে শুধু চামড়া বা বাহ্যিক স্তরে ক্ষতি হয় না, বরং শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই সময় শরীর একটি সংকটজনক অবস্থায় পৌঁছানোকে বলা হয় Burn Shock।
Burn Shock হলে শরীরের পানি ও ইলেকট্রোলাইটের মত অতিরিক্ত ফ্লুইড লস হতে থাকে। সেই সাথে প্রোটিন লস হওয়ার ফলে বিশেষ ধরনের হাইপোভোলেমিক শক (Hypovolemic Shock) সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় রক্তচাপ নেমে যায়, টিস্যুগুলোতে পর্যাপ্ত রক্ত পৌঁছায় না, ফলে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যেতে থাকে।
Burn Shock এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হল, চামড়া পুড়ে যাওয়ার সময় রক্তনালির দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যার ফলে রক্তনালি থেকে পানি ও প্রোটিন টিস্যুতে লিক হয়ে পড়ে।
আমাদের ত্বক হল শরীরের প্রাকৃতিক বাধা। তাই বাধা নষ্ট হয়ে গেলে শরীর তার ভেতরের তরল ধরে রাখতে পারে না। এছাড়া শরীর পুড়ে যাওয়ার পর আমাদের ইমিউন সিস্টেম অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে পড়ে। যার কারণে cytokine storm নামে শরীরে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। এটি রক্তনালিকে আরো খালি করে ফেলে।
এগুলোর বাইরেও, বিস্ফোরণের সময় যদি কেউ ধোঁয়া, গ্যাস, বা গরম বাষ্প শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে, তাহলে ফুসফুস পুড়ে যেতে পারে। তাছাড়া পোড়া জায়গায় ইনফেকশন তৈরী হওয়ার মোক্ষম পরিবেশ বিরাজ করে। ইনফেকশন যদি একবার রক্তে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে Sepsis এর মত জীবনঘাতী অবস্থা তৈরী হয়। Septic Shock থেকে কিডনি, লিভার এমনকি ব্রেনও অকেজো হয়ে যেতে পারে।
পুনর্বাসন
আগুনে পেড়া ব্যক্তিদের সুস্থ হয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগে। যদি ডার্মিস স্তর অক্ষত থাকে, তাহলে নতুন চামড়া তৈরি হতে পারে। তবে গভীর পোড়ায় চামড়া গজায় না; তখন প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়। পুড়ে যাওয়া স্থানে মেলানিন কোষ ধ্বংস হয়ে যায়, ফলে ত্বক আর আগের রঙে ফিরে আসে না। নতুন চামড়া সাধারণত সাদা বা গোলাপি রঙের হয়ে থাকে।
Burn Victim দের পুনর্বাসনে শারিরীক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। কারণ তাদের শুধু শরীরের চামড়ায় ক্ষত নয়, বরং মন ও আত্মার ওপরও এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। অনেকের চেহারা এবং শরীরের গঠন বদলে যায়। ফলে তারা আয়নায় নিজেকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাই আগুনে পেড়া ব্যক্তিদের জন্য মানসিক চিকিৎসা কোনো বিলাসিতা নয়; বরং মৌলিক চাহিদার মত জরুরী।