অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়া কতটা বিপদজ্জনক

maxresdefault (25)
জীবনযাপন

অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়া কতটা বিপদজ্জনক

ভূমিকা:

পৃথিবীর নানা প্রান্তে লাখ লাখ মানুষ যুদ্ধ, দারিদ্র্য, বেকরত্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, জলবায়ু পরিবর্তনে মত নানা কারণে নিজেদের দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। তবে সবার পক্ষেই বৈধ কাগজপত্র নিয়ে যাত্রা করা সম্ভব হয় না। তখন তারা ঝুঁকিপূর্ণ, ‘অবৈধ’ পথে পা বাড়ায়।

বিশ্বব্যাপী অভিবাসন প্রত্যাশীদের সবচেয়ে কাঙ্খিত গন্তব্য হল ইউরোপ। অবৈধ উপায়ে ইউরোপে যাওয়ার জনপ্রিয় পথ হল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা, IOM এর তথ্য মতে, গত এক দশকে শুধু ভূমধ্যসাগরেই প্রায় ২৯ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অথচ এরা সবাই এসেছিল একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক জীবনের আশায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত পর্যবেক্ষণ সংস্থা ফ্রন্টেক্সের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইউরোপ প্রবেশের তালিকায় বাংলাদেশীরা রয়েছে শীর্ষে। [নিউজ]

অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়া কতটা বিপদজ্জনক ?

ভূমধ্যসাগর রুট কেন জনপ্রিয়?

ভূমধ্য সাগরের একদিকে রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশ এবং অন্যদিকে ইউরোপ। লিবিয়া, তিউনিশিয়া, মরক্কো আর তুরস্ক, এই দেশগুলো ইউরোপের ঠিক দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত। ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশগুলোর উপকূল থেকে ইউরোপের দূরত্বও খুব বেশি নয়। লিবিয়া থেকে ইতালির ল্যাম্পেডুসা দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, মরক্কোর তিউনিশিয়া থেকে ইতালির সিসিলিরও প্রায় কাছাকাছি। এছাড়া মরক্কোর উপকূল থেকে স্পেনের উপকূল জিব্রাল্টার প্রণালীর মাধ্যমে বিভক্ত হয়েছে। যা মাত্র ১৪ কিলোমিটার প্রশস্ত। তুরস্ক থেকেও গ্রিসের অনেক দ্বীপ বেশ কাছাকাছি।

এই অল্প দূরত্বের জন্যই মানুষ ভাবে, নৌকায় চেপে সহজেই ইউরোপে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। তাদের মনে হয়, “সাগর পার হলেই তো ইউরোপের মাটি।” আর এটাই তাদের বড় এক ভ্রান্তির সূচনা।

আফ্রিকার দেশের অনেক জায়গাতেই সীমান্ত নিরাপত্তা বেশ দুর্বল। লিবিয়ার মতো দেশে তো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, গৃহযুদ্ধ আর নানা সশস্ত্র গোষ্ঠীর দখলদারির কারণে আইনশৃঙ্খলাই প্রায় ভেঙে পড়েছে। ফলে সেখানে কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে।

তুরস্কের কিছু উপকূল, মরক্কোর নির্জন সৈকত বা তিউনিশিয়ার নিরিবিলি ঘাটগুলোও পাচারকারীদের কার্যক্রমের জন্য নিরাপদ ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হলেও, পাচারকারীরা আবার নতুন পথ বের করে ফেলে।

ইউরোপে ঢোকার অবৈধ রুট

ইউরোপে ঢোকার জন্য প্রধান তিনটি অবৈধ রুট সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়: ১. পশ্চিম ভূমধ্য রুট ২. মধ্য ভূমধ্য রুট এবং ৩. পূর্ব ভূমধ্য রুট।

পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় রুটে মূলত মরক্কো থেকে স্পেনের দিকে যাওয়া হয়। অনেকেই ছোট নৌকা বা জলপথ ব্যবহার করে স্পেনের সিউতা বা মেলিলা শহরে ঢোকার চেষ্টা করেন। মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় রুট হল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। এই রুটে যারা যায়, তারা লিবিয়া, তিউনিশিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে ইতালির ল্যাম্পেডুসা দ্বীপ বা সিসিলিতে গিয়ে পৌছাতে চেষ্টা করে। ২০২৪ সালে এই রুটেই মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় রুটে তুরস্ক থেকে গ্রিসের দ্বীপগুলোর দিকে যাত্রা করা হয়। এই পথেও ঝুঁকি কম নয়, তবে ভূমধ্যসাগরের মাঝখান দিয়ে যাওয়া রুটের তুলনায় এখানকার দূরত্ব কিছুটা কম।

শুধু সাগর পথেই নয়, কখনো আবার স্থলপথেও ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করা হয়। যেমন স্থল পথে অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার এই রাস্তা বলকান রুট নামে পরিচিত। স্থল পথেও সীমাহীন েভাগান্তি থাকলেও, সাগরপথের বিপদ আর ভয়াবহতার তুলনায় তা বেশ কমই বলা চলে।

ভয়ঙ্কর ঝুঁকি

পাচারকারীরা এই সুযোগেই গোপনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এখানে জড়ো করে আনে। এরপর মেরামত করা বিভিন্ন পুরনো নৌকায় উঠিয়ে তাদের সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এসব নৌকায় থাকে না পর্যাপ্ত খাবার, পানি বা জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম। অনেক ক্ষেত্রে এসব নৌকার কোন দক্ষ মাঝি বা চালকও থাকে না। তারা অবৈধ অভিবাসীদের মধ্য থেকেও কাউকে নৌকা চালানোর দ্বায়িত্ব দেয়। এমনকি যেসব ভাঙাচূড়া নৌকায় তাদের পাঠানো হয়, তাতে কোন জিপিএস বা দিক নির্ণয়ের যন্ত্রও থাক না। তাই অনেক সময় যাত্রীরা দিক হারিয়ে মাঝ সাগরে ভাসতে থাকে।

এই পাচারকারীরা বা দালালরা অভিবাসীদের কাছে মিথ্যা স্বপ্ন বিক্রি করে। তারা বলে, মাত্র “দুই-তিন ঘণ্টার নৌকাযাত্রা করলেই ইউরোপ!” তারা অভিবাসীদের বোঝায়, “সাগর খুবই শান্ত, কিছুই হবে না, ইতালি বা স্পেন একদম কাছেই।” এই সব কথা বিশ্বাস করেই মানুষ বিপদে পড়ে। কারণ, তাদের মন ইউরোপের স্বপ্নে বিভোর থাকে।

একটি নৌকায় মাত্র ২০-৩০ জন ওঠার কথা থাকলেও, সেখানে ৭০-৮০ জনকে গাদাগাদি করে ওঠানো হয়। ফলে সামান্য ঢেউ এলেই নৌকা ডুবে যায় বা উল্টে যায়। ২০২৩-২০২৪ সালে ভূমধ্যসাগরে অন্তত ৩ হাজারের বেশি মানুষ এভাবেই মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে।

দালালরা মাত্র দুই-তিন ঘণ্টার যাত্রার কথা বললেও, সাগরে দিনরাত ভাসতে হয়; কখনো কখনো এই যাত্রা সপ্তাহজুড়ে চলা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়। যাত্রা পথে নৌকা নষ্ট হয়ে যাওয়া, খাবার-পানি শেষ হয়ে যাওয়া এবং মাঝ সমুদ্রেই প্রাণ হারানো একটি অতি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সেই বিপদে দালালরা তাদের পাশে থাকে না। তারা টাকা নিয়েই গা ঢাকা দেয়, এবং অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য রেখে যায় শুধু কান্না আর মৃত্যুর পরোয়ানা।

শুধু তাই নয়, লিবিয়া বা তুরস্কের ক্যাম্পগুলোতে অনেক সময় অভিবাসন প্রত্যাশীদের বন্দি করে অত্যাচার করা হয়। তখন তাদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করে পাচারকারীরা। এরফলে জমি বিক্রি করে বা ঋণ করে ইউরোপে পাড়ি দেওয়া পরিবারগুলো আরো বড় বিপদের সম্মুখীন হয়।

ইউরোপ কি সেরা গন্তব্য?

ইউরোপ মানে অনেকের কাছে স্বপ্নের দেশ। বিশেষ করে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষেরা ভাবে, ইউরোপে গেলেই কাজ পাওয়া সহজ হবে, বেতন ভালো হবে। অনেকেই ইউরোপে থাকা আত্মীয় বা বন্ধুদের গল্প শোনে আর ভাবে, ইউরোপে গেলেই টাকা উপার্জন খুব সোজা।

কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন। ইউরোস্ট্যাটের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ইউরোপের গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৫.৫% ছিল। খাদ্যদ্রব্য, ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ সবকিছুর দাম বেড়েছে। জার্মানি, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স সব দেশেই মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ২০২৫ সালের শুরুর দিকে ১৪%-এর বেশি। অনেক দেশ যেমন স্পেন বা গ্রিসে, এই হার ৩০%-এর কাছাকাছি।

বিশ্বব্যাংক এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপে এখন অন্তত ৯ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। অনেক শহরে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। তাছাড়া ইউরোপের বহু দেশে রাজনীতি এখন অনেক বেশি অভিবাসনবিরোধী হয়ে উঠেছে। যেমন, ইতালি, হাঙ্গেরি, ফ্রান্সে কড়া অভিবাসন নীতি প্রণয়ন হয়েছে। এর ফলে নতুন অভিবাসীদের জন্য চাকরি পাওয়া, থাকার জায়গা পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

শুধু তাই নয়, অবৈধভাবে ইউরোপের উপকূলে পৌঁছালেই স্বপ্ন পূরণ হয় না। একসময় হয়ত ইউরোপের কোন দেশে পৌছাতে পারলেই তােদরকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়া হত। এবং ধীরে ধীরে তার নাগরিকত্ব লাভ করত। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসব অবৈধ অভিবাসীদের ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়। যেখানে বছরের পর বছর কাগজপত্রের ঝামেলায় ভুগতে হয়।

সুতরাং, ইউরোপের জীবন ‘সোনার হরিণ’ ভাবার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। কারও কারও ভাগ্যে হয়তো নতুন জীবন থাকে, কিন্তু হাজার হাজার মানুষ ভূমধ্যসাগরেই চিরতরে হারিয়ে যায়।

সম্পর্কে জানতে চাইলে কিকেনকিভাবে র এই ভিডিওটি দেখতে পারেন।

কিকেনকিভাবের পরবর্তী ভিডিও আপলোড হওয়ার সাথে সাথে দেখতে চাইলে, সাবস্ক্রাইব করে বেল আইকনটিতে ক্লিক করুন। আপনি যদি AI শিখে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যেতে চান, তাহলে কিকেনকিভাবে একাডেমির AI দক্ষতা কোর্সে ভর্তি হতে পারেন। কোর্সের লিংক ভিডিও ডেসক্রিপশন ও পিন কমেন্টে দেওয়া আছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।