বাংলাদেশে বেকার সমস্যা
বাংলাদেশে বেকার সমস্যা
সূচনা
বাংলাদেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন অসঙ্গতির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো বেকার সমস্যা। বাংলাদেশের প্রতি পাঁচজনে একজন যুবক তাদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। গত ৫ বছরে বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ ঘটনা, ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানও তৈরি হয়েছিল, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের চাকরি না পাওয়ার হতাশা থেকে।
বেকার সমস্যা
বাংলাদেশের জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগই তরুণ। তারমানে বাংলাদেশে একটি বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু দেশের আর্থিক খাতগুলোতে সম্ভাবনাময় তরুণরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে বড় হচ্ছে, সেই অনুযায়ী নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। কিন্তু আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা ILO এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি।
করোনা মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতির গতি অনেকটাই স্লথ হয়ে পড়ে। সেই সাথে তৈরি হওয়া বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে, প্রয়োজনীয় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে বেসরকারি খাতে চাকরির সুযোগ কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। সেই সাথে সরকারি চাকরিতে কোটার কারণে মেধাবীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত থাকায়, তরুণদের অনেকেই হতাশায় ভুগছেন।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে বাংলাদেশের বেকারদের ৮৩ শতাংশই তরুণ। এদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর আরেকটি সমীক্ষা, বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২ অনুসারে, দেশের প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। তার মানে হল এসব তরুণেরা কোন ধরনের পড়াশোনায় নেই, কর্মসংস্থানে নেই, এমনকি কাজের জন্য কোন প্রশিক্ষণও নিচ্ছে না।
শিক্ষিত বেকার
বাংলাদেশের বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বড় অংশ উচ্চশিক্ষিত। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশের বেকারদের মধ্যে ৮ লাখ বেকার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রতি তিনজন বেকারের মধ্যে একজনই উচ্চ শিক্ষিত বেকার। তারমানে দেশের মোট বেকারের প্রতি তিনজনের একজন বিএ এমএ পাস করেও চাকরি পাচ্ছেন না। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী দের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পাস বেকার তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা যোগ করলে আরো ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। দেশের মোট বেকারের ৫১ শতাংশ কমপক্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পাস। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, সমগ্র বিশ্বেই বেশ বিরল। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশেই শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি।
উচ্চ শিক্ষিত বেকারের হার বাড়ার অন্যতম একটি কারণ হলো, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার হার বেড়েছে কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষা বাড়েনি। দেশের জেলা উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বহু বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়েছে। কিন্তু এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিও সত্যিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে উন্নীত হতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজই হলো সমাজের চাহিদা অনুযায়ী নতুন জ্ঞান উৎপাদন করা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুরনো মুখস্তবিদ্যা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা আঁকড়ে ধরে, সমাজের কোন উপকার তো করতে পারছেইনা, বরং একগাদা শিক্ষিত বেকার উৎপাদন করে দেশের বোঝা বাড়াচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের তরুণরা যে ধরনের শিক্ষা পাচ্ছে, সেই অনুযায়ী তারা কোন চাকরি পাচ্ছে না। অন্যদিকে অর্থনৈতিক খাতে যে ধরনের কাজ সৃষ্টি হচ্ছে, শিক্ষিত তরুণেরা সেই ধরনের কাজের জন্য মোটেও দক্ষ নয়। এর ফলে বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বেকাররা বলছে চাকরি নেই এবং চাকরিদাতারা বলছে দক্ষ কর্মী নেই।
বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে “পড়ালেখা করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে”। এর মাধ্যমে আসলে পড়ালেখা করে ভালোভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়টিকে ইঙ্গিত করা হয়। কিন্তু বর্তমানে এই প্রবাদ সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। বাংলাদেশের শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, যারা পড়ালেখার করেনি বা অতি সামান্য পড়ালেখা করেছে, তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম। কারণ তারা যেকোনো ধরনের কাজ করতে প্রস্তুত থাকে।
স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদেরকে বিভিন্ন সময়ে শেখানো হয়েছে “কোন কাজই ছোট নয়”। কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয় কিছু কাজ “শোভন”এবং কিছু কাজ “অশোভন”। সে কারণে বাংলাদেশের শিক্ষিত বেকারেরা শুধুমাত্র তথাকথিত শোভন কাজ পাবার আশায়, অন্য কোন ধরনের কাজে যুক্ত হতে চায়না।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে কাঙ্খিত শোভন চাকরির না পেয়ে, দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েও অনেকে ই-কমার্স খাতের ডেলিভারিম্যান, বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং সহ নানান ধরনের অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন। এমনকি উচ্চ শিক্ষিত বেকার তরুণদের কেউ কেউ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি চাকরির জন্যও আবেদন করছেন। অনেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে পূর্ব পুরুষের পেশা কৃষি কাজের প্রতি মনোযোগী হচ্ছেন। যারা সমাজের প্রচলিত ট্যাবু ভেঙে, যে কোন পেশায় নিয়োজিত হয়ে বেকারত্ব দূর করছেন, তারা শুধু নিজেদেরই নয় বর সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।
প্রবাসী কর্মী
বাংলাদেশে পছন্দমত কাজ না পেয়ে তরুণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ কাজের সন্ধানে কিংবা উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩ সালে প্রতি ঘন্টায় গড়ে ১৫০ বাংলাদেশি কাজের আশায় দেশ ছেড়েছেন। প্রতিবছর বাংলাদেশীদের জন্য দেশ-বিদেশের যত নতুন কর্মসংস্থান হয় তার তিন ভাগের এক ভাগই হয় প্রবাসে। স্বল্পশিক্ষিত তরুণদের প্রধান গন্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এদের অধিকাংশই জমিজমা বিক্রি করে অথবা মোটা অঙ্কের ধা–র দেনা করে বেকারত্ব ঘোচাতে বিদেশে পাড়ি জমায়। বিগত কয়েক বছর ধরে প্রতিবছর গড়ে ১০ লাখেরও বেশি নারী পুরুষ শুধুমাত্র কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন দেশে গেছেন। ২০২৩ সালে বিদেশ পারি জমিয়েছেন রেকর্ড সংখ্যক ১৩ লাখেরও বেশি কর্মী।
এছাড়া উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় বহু বাংলাদেশী তরুণ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হতে চেষ্টা করে। এদের কেউ কেউ সফল হলেও বহু তরুণ ব্যর্থ হয়ে বিভিন্ন দেশের কারাগারে বন্দি হয় অথবা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। বিপদ সংকুল ভূমধ্যসাগর রুট দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করতে চাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। শুধুমাত্র শ্রমিক বিদেশে গেলেই যে রেমিটেন্স বাড়বে বিষয়টি মোটেও সেরকম নয়। গত তিন বছরে সৌদি আরবে প্রায় ১৭ লাখ কর্মী গেছে। তিন বছর আগে সৌদি আরব থেকে বছরে প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে। কিন্তু বর্তমানে অতীতের চেয়ে বেশি কর্ম সৌদি আরবে থাকার পরও দেশটি থেকে এখন রেমিটেন্স আসছে মাত্র ৩০০ কোটি ডলারের মতো। তারমানে প্রবাসে থাকা বাংলাদেশি কর্মীরা ভালো রোজগার করতে পারছেন না।
বিসিএস উন্মাদনা
বাংলাদেশের শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে অনেকেই সফল হওয়া বলতে শুধু “বিসিএস ক্যাডার”হওয়া বোঝে। বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণেরা উন্মাদের মতো বিসিএস এর দিকে ঝুঁকছে। বিসিএস উন্মাদনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ৪০ তম বিসিএস এ আবেদনকারীর সংখ্যা মালদ্বীপের জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
বিসিএস নামক সোনার হরিণের পিছনে ছুটে বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ দেশের জনশক্তিতে কাজে লাগতে পারছে না। বিসিএস উন্মাদনা বাংলাদেশের জন্য একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর গড়ে মাত্র আড়াই হাজার পদের বিপরীতে প্রায় ৪ লক্ষ আবেদনকারী বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। তারমানে প্রতিবছর বিসিএসে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৯৯.৫ শতাংশই বেকার থেকে যাচ্ছে। তারপরও বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের প্রথম টার্গেটই থাকে বিসিএস।
বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিতে যোগদান করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। অধিকাংশ চাকরি প্রার্থী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা অতিক্রম না করা পর্যন্ত বারবার বিসিএস দিতেই থাকে। এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে দেশের তরুণ-তরুণীরা তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টাকে জলাঞ্জলি দেয়। এরপর আর তাদের নতুন কোন দক্ষতা অর্জন করে অন্য কোন পেশায় যাওয়ার মানসিকতা থাকে না। বিসিএস প্রস্তুতির নামে তারা যা পড়ে, সেই পড়া বিসিএস এর বাইরে দু-একটি চাকরির পরীক্ষা ছাড়া আর কোথাও তেমন কোন কাজেও আসে না।
দেশের বিশাল একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী উদ্যোক্তা বা আবিষ্কারক হওয়ার নেশা ছেড়ে; আমলা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। এই প্রচেষ্টা সত্যিকার অর্থে দেশের জন্য কোনভাবেই মঙ্গল জনক নয়। দেশ পরিচালনার জন্য অবশ্যই মেধাবীদের এগিয়ে আসা উচিত; কিন্তু তাই বলে দেশের সমস্ত মেধাবী তরুণ যদি সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে, তাহলে দেশের অন্য কোন বেসরকারি খাত কখনোই বিকশিত হবে না। একটি দেশ শুধুমাত্র তার আমলাতন্ত্র দিয়ে কখনোই বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিসিএস এর প্রতি আগ্রহটা আসলে সামাজিক ব্যাধি নয়; এটি সমাজে ছড়িয়ে থাকা অন্য এক ভয়াবহ রোগের উপসর্গ মাত্র। সরকারি চাকরিতে মূল বেতনের বাইরে দুর্নীতির মাধ্যমে বহু টাকা আয় করার সুযোগ রয়েছে। প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ পিয়ন পর্যন্ত অনেকেই হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হবার খবর সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সামনে এসেছে। রাজনীতিবিদদের বাইরে শুধু সরকারি চাকরিজীবীরা দেশের যত টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করেছে, সেই টাকা যদি দেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করা যেতো; তাহলেও দেশের বেকার সমস্যা সম্পূর্ণ দূর করা সম্ভব হতো।