ফারাক্কার বিপরিতে বাঁধ বানালে কি সমাধান হবে

maxresdefault (24)
বাংলাদেশ

ফারাক্কার বিপরিতে বাঁধ বানালে কি সমাধান হবে

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নদী হলো গঙ্গা, যা বাংলাদেশে প্রবেশের পর পদ্মা নাম ধারণ করেছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এই নদীর এক পাশে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা, অপর পাশে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলা। মুর্শিদাবাদ জেলারই ছোট্ট একটি পৌর শহর ফারাক্কা। আর এই ফারাক্কাতেই রয়েছে মদীমাতৃক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গলার কাঁটা ফারাক্কা বাঁধ। গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত এই বাঁধের মাধ্যমে; গ্রীষ্মকালে ভারত পানি আটকে রেখে বাংলাদেশের পদ্মা অববাহিকাকে পরিণত করে মরুভূমিতে আর বর্ষাকালে বাঁধের গেট খুলে ভাসিয়ে দেয় বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল।

ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে চালানো ভারতের পানি আগ্রাসন রুখে দিতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে  নেটিজেনদের অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশেও ফারাক্কা বাঁধের বিপরীতে আরেকটি বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।

ফারাক্কার বিপরীতে বাঁধ দিলে কি সমাধান হবে ?

ফারাক্কা বাঁধের কাজ কী

ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের মূল উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গা নদীর পানি একটি কৃত্রিম খাল এর মধ্য দিয়ে পরিবহন করে হুগলি-ভাগীরথী নদীতে প্রবাহিত করার মাধ্যমে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা সংকট দূর করা। কোথায় কলকাতা আর কোথায় ফারাক্কা। ফারাক্কা থেকে কলকাতা বন্দরের দূরত্ব ৩০০ কিলোমিটারেরও বেশি। ফারাক্কা বাঁধ থেকে যে কৃত্রিম খালের মাধ্যমে হুগলি ভাগীরথী নদীতে পানি পরিবহন করা হয়, সেই কৃত্রিম খালের দৈর্ঘ্যও প্রায় ৪০ কিলোমিটার। এই ধরনের অপরিণামদর্শী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায়। ভারতেরই বহু পরিবেশ অধিকার কর্মীরা দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছে, অববাহিকা ভিত্তিক পানি বন্টনের ক্ষেত্রে প্রথমেই বিজ্ঞান, তারপর অর্থনীতি এবং সবশেষে রাজনীতিকে বিবেচনায় নিলে পানি বন্টনের বিষয়টি অনেক বেশি কার্যকর হতো। কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্থূল বুদ্ধি দিয়ে, গায়ের জোড়ে ভারত পানি আটকে রাখে। এতে ভারতের ক্ষতি হলেও তবুও তারা বাংলাদেশকে পানি দিবে না; শুধুমাত্র এই ধরনের মানসিকতার কারণেই ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় দেশেরই প্রাকৃতিক পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করা হয়েছে।

তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে কলকাতা বন্দরকে টিকিয়ে রাখার জন্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল, ৫০ বছর ধরে ফারাক্কা বাঁধের পানি কলকাতা বন্দরে প্রবাহিত করেও সেই কলকাতা বন্দর কে বাঁচানো যায়নি। এমনকি কলকাতা বন্দর সচল রাখতে বর্তমানে যে পরিমাণ ড্রেজিং করতে হয়, ফারাক্কা বাঁধ চালু করার আগেও এতটা ড্রেজিং দরকার হত না। তারমানে যে উদ্দেশ্যে এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল এটি তার আসল উদ্দেশ্য পূরণেই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তবে ফারাক্কা শুধুমাত্র একটি বাঁধই নয়, এই অবকাঠামোটি সড়ক ও রেল যোগাযোগ সেতু হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এবং ফারাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রেও এই বাঁধ থেকে জল সরবরাহ করা হয়।

ফারাক্কার রাজনীতি

ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হয়েছিল সেই পাকিস্তান আমলেই। কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বাড়ানোর জন্য, ১৯৫১ সালে ভারত সরকার এই বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল। ১৯৬১ সালে ভারত ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু করার পর, তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হয়। এরপর ভারত গোপনে গোপনে অত্যন্ত ধীর গতিতে এই বাঁধের কাজ এগিয়ে নিতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তাদের আর কোন বাঁধা থাকে না। এবং ১৯৭৪ সালের মধ্যে ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ।

১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টন বিষয়ে আলোচনা করেন। এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে, উভয় দেশ একটি চুক্তিতে আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না। কিন্তু ফারাক্কা থেকে যে কৃত্রিম খালের মাধ্যমে কলকাতা বন্দরে পানি পৌঁছানো হবে, সেই খালটি ঠিকমতো কাজ করছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য ভারত বাংলাদেশের কাছে সাময়িক অনুমতি চায়। ভারত বলে ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ শে মে পর্যন্ত মাত্র ৪১ দিনের জন্য তারা পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো এরপরে ৪১ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেলেও ভারতের সেই ৪১ দিনের পরীক্ষামূল কার্যক্রম আর শেষ হয় নি।

বাংলাদেশের সাথে মিথ্যা কথা বলে সম্পূর্ণ প্রতারণার মাধ্যমে ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হয়েছিল। সুদীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের পদ্মা নদী ফারাক্কা বাঁধের কারণে পানি বঞ্চিত হয়ে রীতিমতো মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে বর্ষাকালে যখন পানি প্রবাহের দরকার পড়ে না, তখন ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশ কে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। যা করার কোন ধরনের অধিকার ভারতের নেই। গঙ্গা-পদ্মা একটি আন্তর্জাতিক নদী; এই নদীর পানিতে উজানের দেশ হিসেবে ভারতের যেমন অধিকার আছে, ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশেরও ঠিক ততটুকুই অধিকার আছে।

 বাঁধের বিপরীতে বাঁধ

সাম্প্রতিক সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের ডম্বুর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের গেট খুলে দেওয়ার পর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে নজিরবিহীন বন্যা পরিস্থিতি তৈরী হয়। এরপর থেকে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই বলাবলি করছে ফারাক্কার বিপরীতে আমরা ফারাক্কার চেয়ে আরো উঁচু আরেকটি বাঁধ নির্মাণ করে, ভারতের বন্যার পানি আবার ভারতেই ফিরিয়ে দিব।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাঁধের বিপরীতে বাধ নির্মাণ করলে বাংলাদেশের লাভের বদলে ক্ষতিই বেশি হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতের শিলিগুড়িতে তিস্তা নদীর উপর গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছে। তার কিছুটা ভাটিতে বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলায় নদীর উপর তৈরি করা হয়েছে তিস্তা ব্যারেজ। অল্প দূরত্বে এরকম দুটি বাঁধ থাকার কারণে বাংলাদেশের আরো ভাটির দিকে তিস্তা নদী সম্পূর্ণ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।

তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের সকল নদীর অবস্থান ভাটির দিকে। এবং ভারতের নদীগুলোর অবস্থান উজানে। নদীর পানি সবসময় উজান থেকে ভাটির দিকে প্রবাহিত হয়। তাই বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলে বাঁধ দিলেও, সেই পানি কখনোই ভারতের দিকে ফিরে যাবে না। ভারতের বাঁেধর বিপরীতে আমরা যত উঁচু বাঁধই নির্মাণ করি না কেন, বর্ষাকালে নদীর পানি জমতে জমতে একসময় তা বাঁধ ভেঙে ফেলবে; অথবা নদীর পানি বাঁধ উপচে আশেপাশের অঞ্চল প্লাবিত করবে। এর ফলে বাংলাদেশে আরো বেশি আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং নদী ভাঙ্গনের তীব্রতাও অনেক বেড়ে যাবে। তাই বাঁধের বিপরীতে বাঁধ নির্মাণ করা কখনোই সমাধান হতে পারে না। বরং ভারতের যেসকল নদীতে বাঁধ আছে সেসমস্ত বাঁধও সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলতে হবে।

সমাধানের পথ

ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের আগে স্থানীয় অধিবাসীদের বলা হয়েছিল, ফারাক্কা চালু হলে এখানে আর বন্যা হবে না। কিন্তু অতীতের তুলনায় এই অঞ্চলে আরো ভয়াবহ বন্যা দেখা গেছে শুধুমাত্র বাঁধের কারণে। প্রতিবছর ফারাক্কার কারণে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থামাতে, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

নদীতে এ ধরনের বাঁধের ফলে যদি লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হয়, সেক্ষেত্রে তা তুলে ফেলার একাধিক নজীর ইউরোপ আমেরিকায়ও রয়েছে। তাই বাংলাদেশ ভারত উভয় দেশের জন্য অভিশাপ স্বরূপ এই ফারাক্কা বাঁধ অবিলম্বে সরিয়ে ফেলাই হবে সকলের জন্য মঙ্গলকর।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং সামরিক শক্তি আরো জোরদার করার মাধ্যমে ভারতকে অভিন্ন নদীর সকল বাঁধ ভাঙতে বাধ্য করতে হবে। ভারতের এইসব অভিন্ন নদী যদি চীনের সাথে থাকতো; ভারত কখনোই একতরফা ভাবে নদীর পানি আটকে রাখার সাহস করত না। সেই সাথে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে ভাটির দেশকে ভাসিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও ভারত ১০০ বার চিন্তা করতো। কিন্তু দীর্ঘদিন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে ভারত বাংলাদেশের সাথে নিজেদের একটি উপনিবেশের মত আচরণ করেছে। এর বিনিময়ে শেখ হাসিনা পেয়েছিল অন্যায়ভাবে তার গদিতে টিকে থাকার নিশ্চয়তা।

২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে দুটি বিষয়ে খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, প্রথমত বাংলাদেশের তরুণ সমাজ তাদের জীবদ্দশায় আর কখনো ভারতের দালাল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না; এবং দ্বিতীয়ত বাংলাদেশকে আর কখনোই ভারতের পরিকল্পনা মত চলতে দেওয়া হবে না।

বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি; তাই একাত্তর সালে কারা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে মেতে ছিল সেইসব গল্প বলে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ নেই। এই যুগে যারা ভারত সহ বিদেশি শক্তির দালালি করে, দেশবিরোধী চক্রান্ত করছে, তারাই বর্তমান প্রজন্মের কাছে দেশের প্রধান গণশত্রু।

৭১ এর চেতনা যদি হয় পাকিস্তানের দৃশ্যমান পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করা, তাহলে ২৪ এর চেতনা হলো ভারতের অদৃশ্য গোলামীর শৃঙ্খল থেকে মুক্তি।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।