অন্তবর্তীকালীন সরকার

maxresdefault (20)
কি কেন কিভাবে

অন্তবর্তীকালীন সরকার

ভূমিকা

ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন; বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সে কারণে ২০২৪ সালের এর এই গণঅভ্যুত্থান কে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা।

একটি বৈষম্যহীন দেশ গঠনের লক্ষ্যে স্বৈরাচারের পতন ঘটানো হলেও, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা কেমন হবে তা নিয়ে সবাই সঙ্কিত ছিল। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার – উজ – জামান বলেছিলেন, দেশে একটি Interim Government বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।

২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসকে বেছে নেন। ভাগ্যের কী পরিহাস, যে ড. ইউনূস ছিল শেখ হাসিনার চোখের বালি, সেই ড. ইউনুসই হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের হাল ধরতে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা ডঃ ইউনুসকে নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের কটুক্তি করেছেন। [টুস করে]

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা। এর মধ্য দিয়েই তারা কার্যত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া কে গলা টিপে হত্যা করেছিল।

ড. ইউনুসের নেতৃত্বে পরিচালিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেকটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতোই কাজ করবে; তবে সেই সাথে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আরো বেশ কিছু অতিরিক্ত দায়িত্বও রয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ কী ?

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উৎপত্তি

নব্বই এর দশকের শুরুতে বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। তখন প্রশ্ন উঠেছিল কার অধীনে নির্বাচন হবে – ক্ষমতাসীন সরকার, নাকি নির্দলীয় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার? সেই বিতর্কের অবসান হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, যখন ক্ষমতাসীন বিএনপি প্রবল বিক্ষোভের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। সেই থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে মাথা-চাড়া দিয়ে উঠেছে।

নব্বই-এর দশকে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করেছে এবং বিএনপি তাতে রাজি ছিল না। ত্রিশ বছর পরে, অবস্থাটা ঠিক উল্টে যায়। এরপর থেকে বিএনপি বারবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানাতে থাকে, কিন্তু আওয়ামী লীগ বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া আর কিছুতেই সম্ভব নয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি ৭২ এর সংবিধানে উল্লেখ ছিল না। ১৯৯০ সালে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের পতনের পর, সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর অধীনে ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে বিএনপি জয় লাভ করে। বিএনপি সরকার গঠনের পর থেকেই আওয়ামীলীগ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাথে মিলিত হয়ে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিএনপি সরকারকে চাপ দিতে থাকে৷ সর্বপ্রথম জামায়াত এবং তারপর আওয়ামী লীগ ১৯৯৩ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিল সংসদ সচিবালয়ে পেশ করে৷ এতে বলা হয়, জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ ও নির্বাচনের সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবমুক্ত করার জন্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে সংযোজন করা উচিত৷ কিন্তু বিএনপি প্রথম থেকেই এ দাবি অসাংবিধানিক বলে অগ্রাহ্য করতে থাকে। ১৯৯৪ সালের ২৭ জুন সংসদ ভবনে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা প্রদান করে৷ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ওই রূপরেখাকে অসাংবিধানিক ও অবাস্তব বলে ঘোষণা করেন৷।

পরবর্তীতে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে, ১৪৭ জন সংসদ সদস্য এক যোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিএনপি সরকার সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করে। কিন্তু সকল বিরোধী দল সেই নির্বাচন শুধু বর্জনই নয়, ব্যাপক বিক্ষোভের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। বিতর্কিত এই নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন বিরোধী দলগুলোর ব্যাপক আন্দোলনের মুখে, ১৯৯৬ সালের ২৬শে মার্চ তৎকালীন বিএনপি সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে চতুর্থ ভাগে “২ক পরিচ্ছদ : নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার” নামে নতুন পরিচ্ছেদ যোগ হয়৷

এরপর ১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। দেশে-বিদেশে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। নির্বাচনে পরাজিত দল বিএনপি নির্বাচনে ‘পুকুর চুরির’ অভিযোগ আনলেও, তাদের সেই দাবি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করে, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। সে নির্বাচনে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী জোট ব্যাপকভাবে জয়লাভ করে। তখন আওয়ামীলীগ নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব এবং কারচুপির অভিযোগ আনে। কিন্তু সে অভিযোগ খুব বেশি পাত্তা পায়নি; বরং ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পর সংবিধানের বেশ কয়েকটি বিষয় সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। এই সংশোধনী গুলোর মধ্যে ছিল, সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫টি করা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা, এবং সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ছবি প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা। এসব সংশোধনীর মধ্যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়ানোর বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে দূরভিসন্ধিমূলক ছিল বলে অনেকে মনে করেন। কারণ সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি।

২০০৩ সালে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান কে এম হাসান। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অভিযোগ তোলে যে, বিএনপি তাদের পছন্দসই ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা করার ব্যবস্থা করেছে। সংবিধান সংশোধনীতে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স-সীমা বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কেএম হাসান অবসরের পরপরই যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন। আওয়ামী লীগের অভিযোগ ছিল, কেএম হাসান ‘বিএনপির লোক’, তিনি বিএনপির কমিটিতে ছিলেন এবং এক সময় তিনি বিএনপি থেকে নির্বাচনও করতে চেয়েছিলেন। বিচারপতি কেএম হাসান যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে না পারেন সেজন্য ২০০৪ সাল থেকেই তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করে।

আওয়ামী লীগের আন্দোলন ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ ছিল বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে। তারা বুঝতে পারছিল যে, ২০০৭ সালের নির্বাচনে তাদের পক্ষে জয়লাভ করা সহজ হবেনা। তাছাড়া, ১৯৯১ সালের পর থেকে কোন সরকার পরপর দুইবার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। সেকারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের কব্জায় রাখার মাধ্যমে বিএনপি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চেয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সহিংস আন্দোলনের মুখে বিচারপতি কেএম হাসান, ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

সংবিধান অনুযায়ী সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব না নিলে তার আগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সংবিধানের সবগুলো বিকল্প না দেখে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর থেকে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। আওয়ামী লীগ অভিযোগ তোলে তিনি বিএনপির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে চারজন সদস্য পদত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর তীব্র আপত্তির মুখেও ২০০৭ সালের ২২ শে জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তখন রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করলে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙ্গে দেয়। এরপর সেনাবাহিনীর সমর্থনে নতুন আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।

১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকার

২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি জরুরী অবস্থা জারীর মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর সমর্থনে ড: ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। ড: ফখরুদ্দিন আহমেদের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামীলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং এইচএম এরশাদসহ মহাজোটের নেতারা। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কে আওয়ামীলীগের আন্দোলনের ফসল বলে উল্লেখ করেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মত প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বহু নেতাকর্মী সহ খোদ শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করেছিল। শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বাদ দেবার জন্য তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠে। সেই পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে, বাংলাদেশের জনগণ সত্যিকার অর্থেই লাভবান হত। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি পরিবারতন্ত্রের কালো ছায়ামুক্ত, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারত।

ক্ষমতাগ্রহণের শুরুতে ফখরুদ্দিন আহমেদের ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও, তার সরকারের রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল এবং বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনীতিতে এর সুদূর প্রসারী প্রভাব রয়েছে। ১/১১ র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বেশ কিছু ভালো কাজের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা। ড: ফখরুদ্দিন আহমেদের সরকার তাদের কাজের পরিধি এতটাই বিস্তৃত করেছিল যে অনেক বিষয় তাদের কাজের আওতার মধ্যে ছিলনা। রাজনীতিবিদরা নাখোশ হলেও রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগকে নাগরিক সমাজের অনেকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন করেছিল। তবে অনেক বিশ্লেষক আবার মনে করেন তথাকথিত রাজনৈতিক সংস্কার চেষ্টা ব্যর্থ হবার কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং দলের ভেতরে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার অবস্থান আরও মজবুত হয়েছে।

বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, ১/১১ র তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ড: ফখরুদ্দিন আহমেদ সরকার প্রধান হিসেবে থাকলেও, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ।  তবে মইন ইউ আহমেদ তার প্রকাশিত একটি বইতে লিখেছেন তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সকল কাজে সহযোগিতা করা; কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া নয়। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডের পর, অবশেষে ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন দেয়। যার মাধ্যমে সকল দলের অংশগ্রহণে দুই বছর পর দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হল কেন?

২০০৭ সালে জরুরী অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের মেয়াদ অতিক্রম করে অবৈধ ভাবে দুই বছর ক্ষমতায় থেকেছিল। সেই সাথে দেশের রাজনীতি পরিচ্ছন্ন করার নামে এখতিয়ার বর্হিভূত অনেক কাজ করে। ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের সরকারের বিতর্কিত কর্মকান্ডের বাইরেও, সামগ্রিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বেশ কিছু অসুবিধা ছিল। বিচার বিভাগে রাজনীতির অশুভ প্রভাব এর মধ্যে অন্যতম। মেয়াদ শেষে কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবে সে অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান বিচারপতি নিয়োগের নীলনকশা তৈরী করত। রাষ্ট্রীয় দৈনন্দিন রুটিন কাজ করার নির্দেশনা ভেঙে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নীতি নির্ধারণী কাজে জড়িত হত। এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে, ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরোধী একটি রিট আবেদনকে সামনে নিয়ে আসে। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কে আওয়ামীলীগের আন্দোলনের ফসল এবং শেখ হাসিনার “ব্রেন চাইল্ড” বলা হয়, যে  আওয়ামীলীগ ১৯৯০ এর দশকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সারাদেশ আন্দোলনে উত্তাল করেছিল, তারাই পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে, বিরোধীদলের অংশগ্রহণ ছাড়াই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে বাতিল করা হয় ।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা, সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, পরাজিত পক্ষের নির্বাচনী ফলাফল মেনে না নেওয়ার সংস্কৃতি সহ বেশ কিছু বিষয় সমাধান করতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু এই বিষয়গুলোর কোন ধরনের সমাধান না করেই, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধান থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।

বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে আবারো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব কিনা, এই প্রশ্নে আওয়ামীলীগ এবং বিএনপির নেতারা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থানে চলে যায়। আওয়ামী লীগ বলেছে, এই ব্যবস্থা অসাংবিধানিক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আর কোন নির্বাচন সম্ভব নয়। অন্যদিকে বিএনপি বলেছে, আইনের মধ্যে থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা সম্ভব এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। ক্ষমতার পালাবদলে তিন দশক আগে, আওয়ামীলীগ বলেছে বিএনপির কথা, বিএনপি বলেছে আওয়ামীলীগের কথা। এ থেকেই বোঝা যায়, উভয় দলই আসলে সংবিধান রক্ষার নামে অনেক বড় বড় কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে কোন দলই সংবিধান, গণতন্ত্র বা জনগণ কোন কিছুরই পরোয়া করে না। তাদের আসল উদ্দেশ্য হল যে কোন উপায়ে দেশের ক্ষমতায় যাওয়া এবং লুটপাট আর দুর্নীতি করে নিজেদের পকেট ভারী করা।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কার পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হওয়ার পর থেকে, তারা দেশ সংস্কারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। সেই চেতনা থেকেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্বায়িত্ব হল বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো সংস্কার এবং সুষ্ঠু ও অবাধ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরী করা।

সাধারণত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ হল, অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন পরিচালনা। কিন্তু বর্তমানে যেহেতু নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ, মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পর্যন্ত সকল জায়গায়, ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের আজ্ঞাবহ দাসরা প্রশাসন পরিচালনা করছে; এমন অবস্থায় একটি সুষ্ঠু অবাধ গণতান্ত্রিক নির্বাচন সম্পন্ন করা শুধু মুশকিলই নয়, বরং অসম্ভবের কাছাকাছি।

সে কারণেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্যই হবে রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থেকে, দুর্নীতিগ্রস্ত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রেতাত্মাদের অপসারণ করা। তবে এই কাজটি হবে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। কারণ সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আজ্ঞাবহ ব্যক্তিদের দূর করতে গিয়ে, সেখানে বিএনপি ঘেঁষা কেউ যে প্রশাসনে ঢুকে পড়বে না, তার নিশ্চিত করা খুব কঠিন হবে।

ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে মনোনীত করায় দেশ দুদিক থেকে লাভবান হতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদ ডঃ ইউনুস দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, নোবেলজয়ী এই অধ্যাপকের বহির্বিশ্বে বেশ সুনাম রয়েছে। যা আবারো বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জল করার ব্যাপারে সহায়ক হবে।

দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতির সংস্কারের পর, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি সাধারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতোই অবাধ ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন আয়োজন করবে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।