ট্রাম্প কি শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেতে পারে

maxresdefault (23)
জীবনযাপন

ট্রাম্প কি শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেতে পারে

 নোবেল শান্তি পুরস্কার আসলে কী?

নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় এমন ব্যক্তি বা সংগঠনকে, যারা যুদ্ধ, সংঘাত, সহিংসতা কমাতে, দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে, মানবাধিকার রক্ষা করতে, কিংবা দারিদ্র্য, রোগ, বৈষম্য দূর করতে উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। নরওয়ের নোবেল কমিটি এই পুরস্কার প্রদান করে।

কেউ নিজে নিজে এ পুরস্কারের জন্য আবেদন করতে পারে না। অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাঁদের মনোনয়ন দেয়। যেমন যে কোনো পার্লামেন্ট মেম্বার, প্রফেসর, বা আন্তর্জাতিক সংস্থার লিডার মনোনয়ন দিতে পারেন। সেকারণে ইসরায়েলের যুদ্ধপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবারের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছে। এ জন্য নোবেল কমিটির কাছে একটি চিঠিও লিখেছে নেতানিয়াহু।

অতীতে ট্রাম্প নিজেই বহুবার নিজের কাজের জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কার দাবি করেছেন। এবং এখনও শান্তিতে নোবেল না পাওয়ার জন্য বিরক্তিও প্রকাশ করতে দেখা গেছে তাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে বোমা ফেলার পর, তার কট্টর ইহুদিবাদী সমর্থকেরা, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তিকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়ার জোড় দাবি তুলেছে।

ট্রাম্প কি শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেতে পারে ?

শান্তি পুরস্কারের মনোনয়ন

অতীতেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেশ কয়েকজন ভক্ত রাজনীতিবিদ তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছেন। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের সাথে বৈঠক করা এবং ইসরায়েলের সঙ্গে কয়েকটি আরব দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ‘আব্রাহাম চুক্তি’র কারণে কিছু রাজনীতিবিদ বা প্রতিষ্ঠান তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছিল।

দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকেই নিজেকে একজন ‘শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী’ হিসেবে তুলে ধরছিলেন ট্রাম্প। তিনি ইউক্রেন আর ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান সর্বাত্মক যুদ্ধ বন্ধে নিজের আলোচনার দক্ষতা কাজে লাগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে প্রবেশের পর, উদ্বোধনী ভাষনেই ট্রাম্প নিজেকে শান্তি এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে তুলে ধরেন। [ভাষণ]

মাত্র কিছুদিন আগেও তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ভারত-পাকিস্তান এবং সার্বিয়া-কসোভোর মধ্যকার সংঘাতে লাগাম টানার ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নরওয়ের নোবেল কমিটি উপেক্ষা করেছে। 

ট্রাম্পের সমর্থকদের মতে সাম্প্রতিক সময়ে ইরানে আক্রমণ চালিয়ে, ট্রাম্প অনেক বড় যুদ্ধ বন্ধ করেছে। তাই এই কারণে তার শান্তিতে নোবেল পাওয়া উচিত। ট্রাম্পের ইরান আক্রমণে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে নেতানিয়াহু। তাই ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হবার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে তৃতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র সফর করে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে এক নৈশভোজে গণহত্যাকারী নেতানিয়াহু শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়ে লেখা চিঠির একটি কপি ট্রাম্পের হাতে তুলে দেয়।

তারপর থেকেই ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরষ্কার পাওয়ার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে।

তবে, মনোনয়ন পাওয়া মানেই নোবেল জয়ী হওয়া নয়। প্রতিবছর ২০০-৩০০ জনের বেশি মানুষ বা প্রতিষ্ঠান মনোনয়ন পান, কিন্তু শেষমেশ বিজেতা হন এক বা দুই জন। ট্রাম্প এখনও সেই ফাইনাল লিস্টে পৌঁছাতে পারেনি।

মার্কিন প্রেসিডেন্টদের নোবেল শান্তি পুরস্কার

এখনও পর্যন্ত তিনজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। তারা হলেন থিওডোর রুজভেল্ট, উড্রো উইলসন এবং বারাক ওবামা। থিওডোর রুজভেল্ট ১৯০৬ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে শান্তিচুক্তি করানোর জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। উড্রো উইলসন ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘের পূর্বসূরি লীগ অব নেশন্স গঠনের জন্য নোবেল পান। এবং বারাক ওবামা ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে উদ্যোগের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।

ওবামার নোবেল পাওয়া নিয়ে তখন বেশ বিতর্ক হয়েছিল। বারাক ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার মাত্র ৯ মাস পর নরওয়ের নোবেল কমিটি ঘোষণা করে যে, বারাক ওবামা নোবেল শান্তি পুরস্কার পাচ্ছেন। কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি বলে যে, ওবামা বিশ্বের মানুষকে শান্তির জন্য আশা ও নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। বিশেষ করে ওবামা পারমাণবিক অস্ত্র কমানোর ডাক দিয়েছেন এবং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করছেন। নোবেল কমিটি ওবামার “ভিশন” বা ভবিষ্যতে শান্তির স্বপ্নের জন্যই ওবামাকে শান্তি পুরষ্কারে সম্মানিত করে।

অথচ ওবামার অধীনের আমেরিকা তখনো ইরাক এবং আফগানিস্তানে যুদ্ধ করছিল। ওবামার সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন হামলাও বাড়িয়ে দেয়। আফগানিস্তানে তালেবান ঘাঁটি, ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে, ইয়েমেনে আল-কায়েদার বিরুদ্ধে, সোমালিয়ায় আল-শাবাবের বিরেুদ্ধে এবং পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তানে আল-কায়েদা এবং তালেবানের নেতাদের উদ্দেশ্যে ব্যাপক হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এসব হামলায় অপরাধীদের চেয়ে সাধারণ নিরীহ মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু তাই নয়, ওবামার নির্দেশে ন্যাটো বাহিনী লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধেও আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে সরাসরি হামলা চালায়।

তারমানে ওবামার মত তথাকথিত ক্লিন ইমেজের মানুষও, এত এত মানবতা বিরোধী অপরাধ করে যেহেতু শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছে, সে হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পও নোবেল পাওয়াটা অস্বাভাবিক বিষয় নয়।

ট্রাম্পের নোবেল না পাওয়ার কারণ

ট্রাম্পের নোবেল পাওয়ার কারণের চেয়ে, না পাওয়ার কারণগুলোর তালিকা বেশি লম্বা। ট্রাম্প নিজেকে ঐক্য প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে দাবি করলেও, তার ভাষণ অধিকাংশ সময়ই উস্কানিমূলক হয়ে থাকে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ট্রাম্পের উষ্কানিতে তার সমর্থকরা মার্কিন পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে হামলা করে। ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রকে ট্রাম্প দ্বিধাবিভক্ত করে তুলেছেন। অতীতে কোন রাজনীতিবিদের প্রশ্নে মার্কিনদের মনে এতটা ভিন্নমত ছিল না।

ট্রাম্প মুসলিম দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা বা Muslim Ban করেছিল, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে এবং সমগ্র বিশ্বে ইসলাম বিদ্বেষ অনেক বেড়ে গেছে।। ট্রাম্প জাতিসংঘের প্রস্তাবনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি আরো বেড়ে যায়।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্পের নির্দেশে মার্কিন ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের জেনারেল কাসেম সোলেইমানি-কে হত্যা করা হয়। ট্রাম্প ২০১৭-১৮ সালে সিরিয়ায় কেমিক্যাল অস্ত্র ব্যবহার করার অভিযোগে বাশার আল-আসাদের সামরিক স্থাপনায় বড় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।

এসবের বাইরেও, ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বের হয়ে যায়। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা  থেকেও বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিল ট্রাম্প। সাম্প্রতিক সময়ে কানাডা দখলের হুমকি, পানামা খাল দখলের হুমকি, গ্রীনল্যান্ড দখলের হুমকি সহ খাম খেয়ালীপনা শুল্প বাড়িয়ে, বৈশ্বিক বানিজ্যকে ট্রাম্প অনিরাপদ করে তুলেছে। ট্রাম্পের এসব পদক্ষেপ বিশ্ব শান্তি ও সহযোগিতার ধারণার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।

ট্রাম্প একদিকে কিছু শান্তির চেষ্টা করলেও, তাঁর সামরিক হামলা, উস্কানিমূলক বক্তব্য, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এড়িয়ে চলা, এবং পক্ষপাতমূলক নীতির কারণে, ডোনাল্ড ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য সবচেয়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের একজন।

নোবেল কমিটির দুর্ণীতি

নোবেল পুরষ্কার আসলে কয়েকটি আলাদা আলাদা কমিটি দিয়ে থাকে। সাহিত্য, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসার মত বিষয়গুলোতে নোবেল দেয় সুইডেনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শান্তির নোবেল দেয় নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি। শান্তির নোবেল কমিটি সাধারণত ৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়, যাদের নির্বাচন করে নরওয়ের পার্লামেন্ট। কমিটির সদস্যরা নিজেদের মতো করে আলোচনা করে বিজেতা বাছাই করে।

নোবেল কমিটির বিরুদ্ধে কোনো বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি বা ঘুষ লেনদেনের প্রমাণ কখনো প্রকাশ্যে আসেনি। তবে অনেক সময় “রাজনৈতিক প্রভাব” বা “পক্ষপাতিত্ব” এর অভিযোগ উঠেছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার অনেক সময় রাজনৈতিক বার্তা দিতে ব্যবহার করা হয়। যেমন, ১৯৭৩ সালে কুখ্যাত হেনরি কিসিঞ্জারকে নোবেল দেওয়া হয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ থামানোর জন্য। অথচ তার কারণেই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। এছাড়া বারাক ওবামা বড় বড় লেকচার দিয়েই নোবেল পেয়ে যান, অথচ কাজের কাজ কিছুই করেননি।

নোবেল কমিটি ইউরোপ-আমেরিকার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। অনেক বড় কাজ করা আফ্রিকান, এশিয়ান বা মুসলিম ব্যক্তিদের পুরষ্কারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। তাছাড়া, নোবেল কমিটি কার নাম বিবেচনা করছে, কীভাবে বাছাই করছে সবই গোপনীয়। ৫০ বছর পর সেই তালিকা প্রকাশ করা হয়। এমন গোপনীয়তার কারণেই অনেক সময় সন্দেহের জন্ম হয়েছে।

অাপাত দৃষ্টিতে যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার জেতার কোনই সম্ভাবনা নেই। তবে নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তগ্রহণের অস্বচ্ছতার কারণে, ট্রাম্প যদি এই পুরষ্কার পেয়েও যায়, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।