বিগ থ্রি
বিগ থ্রি
BIG THREE
পৃথিবীর বৃহৎ সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পেছনে রয়েছে এক অদৃশ্য কর্পোরেট সাম্রাজ্য; তাহলে নিশ্চই অবাক হবেন।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, মাত্র তিনটি বিশাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। ভ্যানগার্ড, ব্ল্যাকরক এবং স্টেট স্ট্রিট – এদের একসাথে বলা হয় “বিগ থ্রি”। অ্যাপল, ফেসবুক, গুগল, টেসলা, অ্যামাজন, কোকাকোলাসহ বিশ্বের হাজারো শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে তাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে।
বর্তমানে বিগ থ্রির অধীনে রয়েছে প্রায় ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার, বা প্রায় ৩১ কোটি ৫৫ লক্ষ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের ২০২৫ সালের জিডিপির চেয়ে প্রায় ৫৪ গুণ বেশি। এরা এত বড় প্রতিষ্ঠান কিন্তু এদের সম্পর্কে বিশ্ববাসী কিছুই জানে না কেন? কারণ এরা গোপন থাকতেই পছন্দ করে, যাতে তাদের বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে কেউ কিচ্ছু জানতে না পারে।
অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি
ভ্যানগার্ড, ব্ল্যাকরক এবং স্টেট স্ট্রিট-এরা মূলত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। আমরা হয়ত অনেকেই জানি না, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি আসলে কী? মনে ধরুন, আপনার একটি বিশাল কোম্পানি আছে। যে কম্পানির হাতে প্রচুর টাকা। এখন এই টাকা আপনি কোথাও বিনিয়োগ করতে চান। কিন্তু কোথায় বিনিয়োগ করবেন? কীভাবে করবেন? কতটুকু করবেন? সময়ের অভাবে বা যথেষ্ট দক্ষতার অভাবে হয়তো এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতেই মানুষ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির স্মরনাপন্ন হয়। সহজ করে বললে- অন্যের টাকাকে জমিয়ে, গুছিয়ে, কোথায় কতটুকু বিনিয়োগ করা হবে, কোথায় বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি থাকবে না, তা ঠিক করে দেয় অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো। বিনিময়ে তারা লাভের একটা অংশ গ্রহণ করে। এভাবেই শেয়ারহোল্ডিংয়ের মাধ্যমে এই কোম্পানিগুলো অন্যের টাকা ম্যানেজ করে বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করছে। যার ফলে এভাবেই আস্তে আস্তে বিশ্বের সকল লাভজনক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে, বিগ থ্রি গোটা বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এসেছে।
BlackRock, Vanguard এবং State Street নিজেরা কোনো পণ্য তৈরি করে না, কোনো কারখানাও চালায় না। কিন্তু শেয়ারহোল্ডিংয়ের মাধ্যমে প্রযুক্তি, বাজার, সরকার, এমনকি যুদ্ধনীতিতেও বিশাল প্রভাব বিস্তার করছে তারা।
বিগ থ্রি আসলে কারা
BlackRock, Vanguard ও State Street এর শেয়ার মালিকানা ঘেঁটে দেখলে একটি চমকপ্রদ চক্র লক্ষ্য করা যায়। যেমন, BlackRock-এর উল্লেখযোগ্য শেয়ারধারী হচ্ছে Vanguard এবং State Street। আবার, State Street-এর মালিকানায় অংশ রয়েছে BlackRock এবং Vanguard এরও। অন্যদিকে, Vanguard-এর শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যেও রয়েছে BlackRock। অর্থাৎ, উপরিভাগ থেকে আলাদা প্রতিষ্ঠান মনে হলেও, ভেতরে এরা একই সূত্রে গাঁথা। একে অপরের ভেতরে মিশে থাকা এক ধরনের ছদ্মবেশ। আর এই ছদ্মবেশেই বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। একটি মজার বিষয় হলো- আমরা মনে করি কোকা-কোলা ও পেপসি একে অপরের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু বাস্তবতা হল, এই দুই ব্রান্ডের উল্লেখযোগ্য শেয়ারও Vanguard এবং BlackRock-এর হাতে। তারমানে উপর দিয়ে যাদের আমরা প্রতিদ্বন্দী মনে করি, তারাও আসলে ভেতরে ভেতরে বিগ থ্রির হাতে বন্দী। তাদের মালিকানার একটি বড় অংশ একই জায়গায় কেন্দ্রীভূত।
BlackRock
ব্ল্যাকরক এর প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি ফিঙ্ক (Larry Fink) একজন মার্কিন ইহুদি ব্যবসায়ী। তিনি ১৯৮৬ সালে একটি ভুল বিনিয়োগের কারণে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়েন। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ল্যারি ফিঙ্ক তার বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ব্ল্যাকরক। তারপর থেকে ব্ল্যাকরক ধীরে ধীরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ফার্মে পরিণত হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্ল্যাকরকের কাজ ছিল অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শ দেওয়া – কোথায়, কীভাবে, কতটুকু বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি কম হবে, কীভাবে পোর্টফোলিও গঠন করলে ভবিষ্যতের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্ল্যাকরক শুধু পরামর্শকেই থাকেনি, হয়ে উঠেছে এক গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট পাওয়ারহাউস।
আজ তারা স্টক, বন্ড, রিয়েল এস্টেট থেকে শুরু করে ক্লাইমেট-ফোকাসড ফান্ড পর্যন্ত সব ধরনের সম্পদে বিনিয়োগ করে। শুধু তাই নয়, তারা এখন সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করছে।
বিশেষ করে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক ধসের সময় ব্ল্যাকরক যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের হয়ে কাজ করে। সেসময় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া বিশাল বড় বড় কোম্পানিগুলোর সম্পদ পুনর্ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্ল্যাকরকের হাতে। সেই সময় ব্ল্যাকরক Aladdin নামের একটি সফটওয়্যার তৈরী করে; যার মাধ্যমে আগে থেকেই নির্ধারণ করা যায়, কোথায় বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি বেশি এবং কোথায় লাভ বেশি। বিশ্বের বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও টেক জায়ান্ট যেমন Apple, Microsoft, এমনকি গুগলের মালিকানা প্রতিষ্ঠান Alphabet পর্যন্ত এই সফটওয়্যারের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে আলাদিন সফটওয়্যারের উপর ভিত্তি করেই ব্ল্যাকরক ১১.৬ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ পরিচালনা করছে।
Vanguard
১৯৭৫ সালে জন সি. বোগল ভ্যানগার্ড প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে তিনি ওয়েলিংটন ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে কাজ করতেন। তিনিও সেই কম্পানির একটি ব্যর্থতার কারণে চাকরি হারান। তবে সেই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে শুরু হয় ভ্যানগার্ডের পথচলা। ভ্যানগার্ড মূলত একটি মিউচুয়াল ফান্ড কোম্পানি, যা বিশ্বের প্রথম কম খরচের ইনডেক্স ফান্ড চালু করে। ১৯৭৬ সালে তারা বাজারে আনে S&P 500 ইনডেক্স ফান্ড, যা মার্কিন শেয়ারবাজারের ৫০০ শীর্ষ কোম্পানির রিটার্ন ট্র্যাক করত। প্রথম দিকে মাত্র ১১ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে পারলেও আজ তাদের পরিচালিত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০.৪ ট্রিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে ভ্যানগার্ডের অধীনে রয়েছে ২০৩টি মার্কিন তহবিল এবং ২২৭টি আন্তর্জাতিক তহবিল রয়েছে। এদের ৫০ মিলিয়নেরও বেশি বিনিয়োগকারী রয়েছে, যারা নিজেরাই এই কোম্পানির মালিক। অর্থাৎ ভ্যানগার্ড এর একক কোন মালিক নেই, যারা শেয়ারহোল্ডার তারাই মালিক।
ব্ল্যাকরক বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ পরিচালনা করে, ভ্যানগার্ড হল সেই ব্ল্যাকরকের প্রায় ৮.৬৩% শেয়ারের মালিক। তারমানে বিনিয়োগের দুনিয়ায় যেদিকেই তাকান, কোনো না কোনোভাবে ভ্যানগার্ডের ছায়া দেখতে পাবেন।
State Street
স্টেট স্ট্রিট কর্পোরেশন একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, যা বর্তমানে প্রায় ৪.৭ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ পরিচালনা করছে। বিশ্বের শীর্ষ ব্যাংক, পেনশন ফান্ড এবং বড় বড় কর্পোরেশনগুলোর বিনিয়োগ রক্ষণাবেক্ষণের বড় দায়িত্ব এদের কাঁধে। যদিও নাম শুনে স্বাধীন, আলাদা বা নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান মনে হয়, বাস্তবে এটি মূলত ব্ল্যাকরক ও ভ্যানগার্ডের ছদ্মবেশমাত্র।
২০১৪ সালে স্টেট স্ট্রিটের শেয়ারহোল্ডারদের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, এই প্রতিষ্ঠানে Vanguard-এর মালিকানা ১৩.০৩% এবং BlackRock-এর ৮.৯৮%। ভ্যানগার্ড ও ব্ল্যাকরক সরাসরি দখল না করেও স্টেট স্ট্রিটের মালিকানার বড় অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দিয়েছে, যেন বাইরে থেকে স্টেট স্ট্রিটকে আলাদা বা স্বতন্ত্র মনে হয়-কিন্তু বাস্তবে এই তিন প্রতিষ্ঠান (Big Three) ঘুরে ফিরে একই। মজার ব্যপার হলো, ব্ল্যাকরকের ৪.০৭% শেয়ারও ধরে রেখেছে স্টেট স্ট্রিট। এ যেন এক গোলক ধাঁধাঁ।
এদের সাম্রাজ্য কত বড়?
বিগ থ্রির সাম্রাজ্য কত বিশাল তা বোঝা খুব বেশি কঠিন কিছু নয়। মনে করুন আপনি সকালে ঘুম থেকে উঠেই হাতে নিলেন আইফোন এবং ফেসবুক স্ক্রল করা শুরু করলেন। কিচেনে ঢুকে বানালেন নেসলের কফি। বাসা থেকে বের হয়ে উবার ডাকলেন অফিসে যাওয়ার জন্য। অফিসে গিয়ে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড খুলে কাজ শুরু করলেন। দুপুরে কেএফসির ফ্রাইড চিকেন অর্ডার করে খেলেন। কোকা-কোলা খেতে খেতে বাসায় ফিরলেন। বিকেলে অবসর সময় কাটালেন নেটফ্লিক্সের পছন্দের সিরিজ দেখে। রাতে ঘুমানোর আগে ইউটিউবের কিছু ভিডিও দেখলেন।
এখানে সারাদিন এই ব্যক্তি যতগুলো পণ্য বা সেবা ব্যবহার করেছে, তার সবই বিগ থ্রির মালিকার পণ্য। শুধু এখানেই শেষ নয় পুরো বিশ্বের হাজার হাজার কোম্পানির শেয়ার কিনে রেখেছে এরা। বিশ্বাস না হলে finance.yahoo.com এ গিয়ে বিশ্বের যে কোন বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে সার্চ করুন। তাদের শেয়ারহোল্ডিং এ ভ্যানগার্ড, ব্ল্যাকরক এবং স্টেট স্ট্রিট এর নাম পাবেন না, এমন কোম্পানি পাওয়া প্রায় দুষ্কর। শুধু তাই নয়, আমেরিকার শেয়ার বাজারের শীর্ষ ৫০০ কম্পানির ৮৮ শতাংশের মালিক এই বিগ থ্রি। এদের নামের তালিকা দিলে শেষ হবে না, শুধু এতটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়, যতগুলো আমেরিকান কম্পানি আপনি চেনেন, তাদের সবারই মালিকানায় শেয়ার আছে ব্ল্যাকরক, ভ্যানগার্ড এবং স্টেট স্ট্রিটের।
বিগ থ্রির যুদ্ধ ব্যবসা
বিশ্বের সকল প্রান্তে প্রতিদিন যত লেনদেন হয়, তার একটি বড় অংশ যেমন বিগ থ্রি পায়। ঠিক একইভাবে বিশ্বের কোথাও যদি একটি বুলেট চলে, বোমা পড়ে বা রক্ত ঝরে তাহলেও এই কোম্পানিগুলোর মুনাফা বড়ে।
কারণ সমগ্র বিশ্বের সিংহভাগ অস্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান Lockheed Martin, Raytheon, General Dynamics, Northrop Grumman এবং Boeing এর মত কম্পানিগুলোর মালিকানাও আছে এদের হাতে। অর্থনৈতিক পরাশক্তি বিগ থ্রির মত, বিশ্বের অস্ত্র উৎপাদনকারী শীর্ষ ৫টি কম্পানিকে বলা হয় বিগ ফাইভ।