জাপানি মাফিয়া গোষ্ঠী ইয়াকুজা কতটা ভয়ংকর
জাপানি মাফিয়া গোষ্ঠী ইয়াকুজা কতটা ভয়ংকর
সূচনা
বিশ্বের শান্তি প্রিয় দেশের তালিকা করা হলে, সবার উপরের দিকে থাকে জাপান। কিন্তু সেই জাপানেই আছে বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর এক অপরাধী চক্র ইয়াকুজা। জাপানের ইয়াকুজা এমন একটি সংগঠিত অপরাধী গোষ্ঠ, যাদেরকে অনেক সময় জাপানের মাফিয়া হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। এরা মূলত জুয়া, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মানবপাচার, অস্ত্র চোরাচালান এবং কর্পোরেট ব্ল্যাকমেইল এর মত প্রায় সকল অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকে।
যদিও অতীতে একসময় ইয়াকুজা কিছু কিছু সামাজিক ও মানবিক কাজের সাথেও যুক্ত ছিল। কিন্তু ইয়াকুজা কিভাবে তাদের অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলল, আর কেনই বা জাপানিরা এদের ভয় পায়।
ইয়াকুজার উৎপত্তি কীভাবে?
ইয়াকুজা নামের পেছনে লুকিয়ে আছে এক মজার গল্প। জাপানে এক সময় খুব জনপ্রিয় এক ধরনের তাসের খেলা ছিল, যার নাম “ওইচি-কুবু”। সেই খেলায় ৮, ৯ আর ৩ নম্বর কার্ডের কম্বিনেশনকে ধরা হতো সবচেয়ে বাজে। সেই বাজে কম্বিনেশনকেই বলা হতো “ইয়াকুজা” (ya-ku-sa)। মানে, ৮, ৯, ৩। এই কার্ড যার হাতে পড়ত, তার ভাগ্য একেবারে খারাপ! সমাজের নিচুস্তরের কিছু মানুষ একসময় এই নামটাই নিজেদের পরিচয় হিসেবে বেছে নেয়। কারণ সমাজের চোখেও তারা ছিল “হারানো তাসের মতো” অর্থাৎ অবহেলিত আর অবাঞ্ছিত।
আর সেখান থেকেই ১৭শ শতকে, জাপানের এদো যুগে ইয়াকুজা গোষ্ঠীর গোড়াপত্তন হয়। তখন মূলত দু’ধরনের গোষ্ঠী গড়ে ওঠে: ১. টেকিয়া (Tekiya) এবং ২. বাকুটো (Bakuto)।
টেকিয়ারা সাধারণত বিভিন্ন মেলা বা উৎসবে ছোট ছোট দোকান চালাত, রাস্তার ধারে দোকানে ভুয়া বা নকল পণ্য বিক্রিও করতো। অন্যদিকে বাকুটোরা অবৈধ জুয়ার সাথে জড়িত ছিল। এই দুই গোষ্ঠী সময়ের সঙ্গে সংগঠিত অপরাধ চক্রে রূপ নেয় এবং ‘ইয়াকুজা’ নামে পরিচিতি পায়।
ইয়াকুজা গোষ্ঠীগুলো সামরিক বা পারিবারিক শৃঙ্খলার মত করে চলত। প্রতিটি গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতাকে বলা হয় “ওয়ায়াবুন” (oyabun) যার অর্থ “পিতা” এবং তার অধীনস্থদের বলা হয় “কোবান” (kobun) অর্থাৎ “সন্তান”।
তাদের মধ্যে অনুগত্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেউ ভুল করলে শাস্তি হিসেবে আঙুল কেটে নেতা বা গোষ্ঠীর সামনে পেশ করতে হত। এটাই ক্ষমা চাওয়ার এক ধরনের প্রথাগত পদ্ধতি। একে বলা হত “ইবিতসুমে”।
ইয়াকুজা সদস্যদের সারা শরীর জুড়ে ট্যাটু অাঁকা থাকত এবং তাদের আলাদার পোশাক আশাকও ছিল। এগুলো দেখেই ইয়াকুজা সদস্যদের আলাদা করে চেনা যেত।
মানুষ কেন ভয় পেত?
ইয়াকুজারা সমাজের নানা ধরনের ভয়ংকর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। তারা একদিকে যেমন শক্তিশালী ছিল, অন্যদিকে তেমনি ছিল নির্দয়। তাদের নাম শুনলেই মানুষ কেঁপে উঠত, কারণ তারা চাইলে যেকোনো ব্যবসায়ী বা সাধারণ মানুষকে শাস্তি দিত।
ইয়াকুজাদের নানা ধরনের অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল চাঁদাবাজি। কেউ টাকা না দিলে ভয় দেখাত, দোকানপাট ভাঙচুর করত কিংবা মারধর করত। তারা মাদক ব্যবসাও করত, যেখানে নেশার জিনিস বিক্রি করে অনেক টাকা উপার্জন করত। অস্ত্র চোরাচালানও তাদের একটা বড় কাজ ছিল, তারা গোপনে বন্দুক বা ছুরি বিক্রি করত।
এছাড়া তারা অবৈধ জুয়ার আসর বসাত, যেখানে মানুষ টাকা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যেত। অনেক ইয়াকুজা মানব পাচারেও যুক্ত ছিল, যেখানে তারা মানুষকে ফাঁদে ফেলে অন্য দেশে বিক্রি করত। আর সবচেয়ে ভয়ংকর হলো, তারা কর্পোরেট ব্ল্যাকমেইল করত, যা জাপানে সোকাইয়া নামে পরিচিত। বড় কোনো কোম্পানির গোপন কথা জানলে, সেই কথা ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তারা টাকা আদায় করত।
এমন ভয় আর অপরাধের জন্যই ইয়াকুজার নাম শুনলেই সাধারণ মানুষ দূরে থাকতে চাইত। কারণ একবার তাদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ালে, সহজে রেহাই পাওয়া যেত না। তাই ইয়াকুজা হয়ে উঠেছিল জাপানের এক ভয়ংকর নাম, যা আজও মানুষের মনে আতঙ্কের জন্ম দেয়।
অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, ইয়াকুজা শুধু ভয়ই দেখাত না। কখনও কখনও মানুষকে সাহায্যও করত। যেমন, ভূমিকম্প বা সুনামির পর তারা দুর্গতদের কাছে খাবার আর পানি পৌঁছে দিত। এর ফলে সাধারণ মানুষের একটি অংশ ইয়াকুজাদেরকে “রক্ষক” ভাবত, যদিও তারা আসলে অপরাধ করেই অর্থ উপার্জন করত।
আধুনিক সময়ে ইয়াকুজা
বর্তমানে ইয়াকুজার প্রভাব অনেকটাই কমেছে। জাপান সরকার ১৯৯০-এর দশক থেকে ইয়াকুজা নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন চালু করে। এখন কোন ব্যাংক বা কম্পানি ইয়াকুজার সঙ্গে লেনদেন করেতে চায় না। তবে এখনো তারা কিছু শিল্প ও কর্পোরেট জগতে ব্ল্যাকমেইল বা “সোকাইয়া” কৌশলে (corporate extortion) টাকা আদায় করে। পুলিশও নিয়মিত অভিযান চালানোর ফলে অনেক ইয়াকুজা গোষ্ঠী ছোট হয়ে গেছে। অনেকে আবার নিজেরা বলছে, তারা এখন অপরাধ ছাড়তে চায়। তবে পুরোপুরি তারা সমাজ থেকে হারিয়ে যায়নি।
তবে জাপানি সিনেমা বা টিভি ড্রামায় ইয়াকুজা আজও এক রহস্যময় চরিত্র। মানুষ তাদের ভয়ও পায়, আবার রোমঞ্চিতও হয়।