কোটা বিতর্ক

maxresdefault (14)
কি কেন কিভাবে রাজনীতি

কোটা বিতর্ক

ভূমিকা

বর্তমানে দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটা পদ্ধতি। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরির নিয়োগে, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ মোট ৫৬ শতাংশ নিয়োগই হয় কোটা থেকে। বাকি ৪৪ শতাংশ নিয়োগ দেওয়া হয় সাধারণ চাকরি প্রার্থীদের মধ্য থেকে। তারমানে এইসব নিয়োগে প্রকৃত মেধাবীরাই সংখ্যালঘু হয়ে আছে।

৫৬ শতাংশ কোটার মধ্যে নারী কোটা ১০%, জেলা কোটা ১০%, উপজাতি কোটা ৫% এবং প্রতিবন্ধী কোটা এক শতাংশ নিয়ে সাধারণ কোটা মোট ২৬ শতাংশ। অন্যদিকে শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটাই ৩০ শতাংশ। সেকারণে সরকারি চাকরির নিয়োগে এই মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছিল।

অভিযোগ আছে, বাংলাদেশে এত এত কোটা থাকা কারণে কম যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থীদেরই বেশি চাকরি হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কোটা পদ্ধতি রয়েছে। তবে কোনো দেশেই বাংলাদেশের মতো, মেধাবীদের তুলনায় কোটাধারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। আর্থসামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য যে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল, সেটিই এখন বৈষম্যের কারণ হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কোটা আন্দোলনের মূল কারণ কী ?

মুক্তিযোদ্ধা কোটা

বাংলাদেশের অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধারা ছিল গ্রামের সাধারণ জনগণ; যারা তৎকালীন সময়ে সরকারি চাকরি-বাকরি থেকে শুরু করে সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভের ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধে অনেকেই শহীদ হয়েছেন, কেউবা হাত পা হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন; যারা শারীরিক সুস্থতা নিয়ে বেঁচে ছিলেন তাদেরও অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। এমন পরিস্থিতিতে দেশের স্বাধীনতায় অবদান রাখা মহান বীর মুক্তিযোদ্ধারা যেন সমাজে পিছিয়ে না পড়েন, সে কারণে তাদের জন্য সরকারী চাকরীতে বিশেষ কোটার ব্যবস্থা করা হয়।

তবে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই শিক্ষিত ছিলেন না বা তাদের সরকারি চাকরি করার বয়স বা যোগ্যতা ছিল না। সেক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদেরকেও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা সুবিধার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এই কোটা পদ্ধতি তৈরি হয়েছিল একটি অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী নিয়োগ ব্যবস্থার মাধ্যমে। যা পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় যাবত চলমান থেকেছে। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম ছাড়িয়ে তৃতীয় প্রজন্মও, অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি নাতনিরাও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবহারের সুযোগ পেতে থাকে। আর সেখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে আপত্তি শুরু হয়।

সংবিধানে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণীকে সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে নারীদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করা হয়নি। কারণ সকল মুক্তিযোদ্ধাই হতদরিদ্র বা গ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগণ ছিলেন না। অনেক শহুরে এবং ধনীরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন; সে কারণে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এক বাক্যে অনগ্রসর বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করার কোন সুযোগ ছিল না।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। সেই সাথে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে রয়েছে আনসার ও প্রতিরক্ষা সদস্য কোটা, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগে রয়েছে ৫০ শতাংশ নারী কোটা। সবমিলিয়ে এত কোটার ছড়াছড়িতে প্রকৃত মেধাবী এবং যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছিল।

এর ফলে ২০১৮ সালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে নামিয়ে ১০ শতাংশ করা হোক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ২০১৮ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারির মাধ্যমে পুরো কোটা পদ্ধতিই বাতিল করে দিয়েছিল।

কিন্তু ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে পাবার জন্য, উচ্চ আদালতে রিট করেন। তারই প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের জুন মাসের ৫ তারিখে হাইকোর্ট, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত কে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। এর মাধ্যমে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আবারো পুনর্বহাল হয়ে যায়।

হাইকোর্টের ওই রায়ের পর থেকেই তা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। কিছুদিন আন্দোলন চলার পর, কুরবানী ইদের কারণে ২৯শে জুন পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখেন শিক্ষার্থীরা। এরপর গত ৩০শে জুন থেকে ফের আন্দোলন শুরু হয়। এবং ২০২৪ সালের পহেলা জুলাই থেকে এই আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

 দাবি আন্দোলনের শুরুর দিকে শিক্ষার্থীরা চার দফা দাবির কথা বললেও; এখন তারা সেটিকে এক দফায় নিয়ে এসেছে। সেই এক দফা দাবি হলো, সকল গ্রেডে আযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে, সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় এনে সংসদে আইন পাশ করতে হবে। তারমানে শিক্ষার্থীদের মূল কথা হলো, কোটা সংস্কার করে পাঁচ থেকে দশ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে।

সরকারের সিদ্ধান্ত

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটার সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করা এবং পরবর্তীতে সম্পূর্ণ কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়ার পেছনে, সরকারের সুবিবেচনার অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

প্রথম যখন সরকারি চাকরিতে কোটা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়িয়ে, ৫৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটি ছিল আতবেগতাড়িত এবং একতরফা সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে বাতিলের ক্ষেত্রেও, কোটা ব্যবস্থার সংস্কার না করে সরকার এক প্রকার জেদের বসে সকল কোটা বাতিল করে দেয়।

কোটার বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করেছিল, তারাও কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করার দাবি করেনি। ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’এর ব্যানারে যে পাঁচটি বিষয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলে; সেগুলোর অন্যতম ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার। আন্দোলনকারীরা চেয়েছিলেন, ৫৬ শতাংশ কোটার মধ্যে যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ, সেটিকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক। কিন্তু তাদের সেই আন্দোলনের মূল বক্তব্য সরকার মনোযোগ দিয়ে না শুনে, সকল কোটা বাতিল করে দেয়। যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন আরেক সংকট।

তখনই যদি ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করা হত, তাহলে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের আপত্তির সূত্র ধরে নতুন করে আর কোন কোটাবিরোধী আন্দোলন তৈরি হতো না।

সমাধানের পথ

বাংলাদেশের জনপ্রশাসন ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে অতীতে বাংলাদেশ সরকার তিনটি পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্মস কমিশন স্থাপন করেছিল। তিনটি কমিশনই সুস্পষ্টভাবে বলেছিল যে, কোটা একেবারে তুলে দেয়া উচিত। তবে হঠাৎ করে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি তুলে দিলে তা নিয়েও সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে মত দিয়েছিলেন কোন কোন বিশেষজ্ঞ।

২০১৮ সালে সব কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করার পর, কোটা ব্যবস্থা বহালের দাবিতে আন্দোলনে নামে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের স্বজনদের কয়েকটি সংগঠন। নারী অধিকার ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোও আলাদা আলাদাভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে কর্মসূচিতে নামে।

সরকারি প্রশাসনের অনেকেই তখন বলেছিলেন, নারী এবং উপজাতি কোটা পুরোপুরি তুলে দেয়া ঠিক হবে না। সেই সাথে প্রতি পাঁচ বছর পর পর কোটা ব্যবস্থা মূল্যায়ন করতে হবে। তবে এসব পরামর্শ আমলে না নিয়ে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করে দেয় সরকার।

স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ সময় মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে কোন ধরনের অসন্তোষ বা বিতর্ক ছিল না। সমস্যা তৈরি হয় যখন মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা এই কোটার সুবিধা ভোগ করতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন ত্যাগ স্বীকার করেছে; কিন্তু তাদের তৃতীয় প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধার নাতিরা মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবিধা পাওয়া কোনভাবেই যৌক্তিক মনে করেন না বিশেষজ্ঞরা।

তাছাড়া স্বাধীনতার এত বছর পরে বহু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। সেকারনে বহুমুখী যোদ্ধারা নিজেরাই এই কোটা সুবিধা চান না। তারা মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদেরও সাধারণ নাগরিকদের মতো যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা উচিত।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।