হজ থেকে কত টাকা আয় করে সৌদি আরব
হজ থেকে কত টাকা আয় করে সৌদি আরব
ভূমিকা
মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন হল হজ্জ। সারা পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান প্রতি বছর হজ করতে সৌদি আরবে যান। মুসলিমদের এই সফর সৌদি আরবের কাছে শুধু আধ্যাত্নিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি সৌদি অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তিও বটে। হজ্জের মৌসুমে সৌদি আরবের আর্থিক লেনদেনের হার অনেক বেড়ে যায়। অনেকেই বলে থাকেন, সৌদি আরব তেল বিক্রি করে যত টাকা পায়, হজ্জ থেকে তার চেয়ে বেশি টাকা আসে। তবে এই দাবি মোটেও সত্যি নয়। ২০২৩ সালে সৌদি আরব খনিজ তেল থেকে অায় করেছে ৪৪০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, এই সময়ে শুধু হজ্জ থেকে সৌদি আরবের সরাসরি রোজগার হয়েছে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরেও হজ্জ থেকে সৌদি আরবের আরো বেশ কিছু পরোক্ষ উপার্জনের পথ আছে।
হজ্জ যাত্রীর সংখ্যা
ইসলামের পূর্ব যুগ থেকেই বিশ্বের নানা প্রান্তের লোক তীর্থ যাত্রার উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা নগরীতে উপস্থিত হত। তখন থেকেই মক্কার লোকেরা এখানে আগত তীর্থযাত্রীদের সাথে ব্যবসা বানিজ্য করে উপকৃত হত।
বর্তমানেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসলিম হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে গমন করেন। এর বাইরে সৌদি আরবে অবস্থানরত বহু প্রবাসী এবং সৌদি নাগরিকও প্রতিবছর হজ্জ ও উমরা পালন করেন। সাধারণত প্রতিবছর প্রায় ২০ থেকে ৩০ লক্ষ মুসলিম পবিত্র হজ্জ পালন করেন।
হজ্জ এবং উমরার মধ্যে একটি প্রধান পার্থক্য হল, বছরে শুধু একটা নির্দিষ্ট সময়েই হজ অনুষ্ঠিত হয়; কিন্তু উমরা সারাবছর করা যায়। ১৯৮৮ সাল থেকে সৌদি সরকার একটি নতুন নিয়ম করে। যার ফলে প্রতিটি দেশ থেকে কত জন হজে আসতে পারবেন, তার একটা কোটা নির্ধারণ করা হয়। বিভিন্ন দেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার কোটা সবচেয়ে বেশি। সেখান থেকে দুই লক্ষ ২০ হাজার মানুষ প্রতি বছর হজে যান। যা মোট হজযাত্রী সংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ। এরপরেই রয়েছে পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশের কোটা। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের কোটাই সমস্ত হজ্জ যাত্রীর প্রায় ১১ শতাংশ। এবং বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হাজীদের সংখ্যা সমগ্র হজযাত্রীর ৮ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে নাইজেরিয়া, ইরান, তুরষ্ক এবং মিশর; এই দেশগুলোর কোটাও বাংলাদেশের কাছাকাছি।
এর বাইরেও হাজীদের আরেকটি বড় অংশ হল সৌদি আরবের বাসিন্দা। সৌদি আরবের ভেতর থেকে হজ্জে যাওয়া ব্যক্তিরা আবার দুই ভাগে বিভক্ত। একদল হলেন সৌদি আরবের নাগরিক; এবং অন্যরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাজের উদ্দেশ্যে আসা সৌদি আরব অভিবাসী। প্রতিবছর যত লোক হজ্জ পালন করেন, তার প্রায় অর্ধেক লোকই সৌদি আরবের বাসিন্দা। এর একটা বড় কারণ হল, তাদের থেকে মক্কা খুব নিকটে। তাই ধর্মীয় কর্তব্য মনে করে তারা বেশ কম খরচে হজের ফরজ আদায় করেন নেন।
সৌদি আরবের পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, ২০২২ সালে দেশী এবং বিদেশী মিলিয়ে ২ কোটি ৪৭ লাখেরও বেশি মানুষ উমরা পালন করেছেন (২৪, ১৭৫,৩০৭)। এদের মধ্যে বিদেশ থেকে উমরা পালন করতে গেছে প্রায় ৮৩ লাখ ৭২ হাজার মানুষ (৮,৩৭২,৪২৯)। এবং ১ কোটি ৬৩ লাখ ৪২ হাজার সৌদি নাগরিক এবং আরবে বসবাসকারী প্রবাসীরা উমরা পালন করেছেন (১৬,৩৪২,৮৭৮)।
২০২২ সালে সর্বমোট হজ্জ পালন করেছেন ৯ লাখ ২৬ হাজার মানুষ। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ এবং ২১ সালে সীমিত পরিসরে হজ্জ অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে ২০২২ সালেও এই সংখ্যাটা ছিল বেশ কম। সেকারণে ২০২৩ সালেই হজ্জ পালনকারীদের সংখ্যা ৫৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। গত এক দশকে প্রতিবছর গড়ে ২৫ লক্ষ মুসলমান হজ করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৪ সালেও স্বাভাবিক সময়ের মত প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ মুসলিম হজ্জ পালন করবেন।
হজ্জ থেকে উপার্জন
পবিত্র হজ্জ ও উমরা থেকে সৌদি আরবের প্রকৃত আয় কত, তার সঠিক হিসাব জানা যায়না। তবে বেশ কিছু পরিসংখ্যান এবং অনুমানের ওপর নির্ভর করে হজের মোট আয় ধারণা করা হয়।
মক্কার চেম্বার অব কমার্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাইরের দেশ থেকে আসা মুসলমানরা গড়ে মাথাপিছু ৪ হাজার ৬০০ ডলার ব্যয় করেন, এবং স্থানীয়দের খরচ হয় মাথাপিছু প্রায় ১ হাজার ৫০০ ডলার। তবে একেক দেশ থেকে আসা হজযাত্রীদের খরচ একেক রকম। যেমন বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে হজ্জে যেতে নূন্যতম খরচ হয় ৬ হাজার ৫০০ ডলার। বাংলাদেশী টাকায় যা প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি। কিন্তু নূন্যতম এই খরচের বাইরেও হাজীদের অারো কিছু অতিরিক্ত অর্থ খরচ হয়। সেই সাথে হাজ্জযাত্রীদের ব্যক্তিগত খরচও যুক্ত হয়, যা কোনো না কোনোভাবে সৌদি অর্থনীতিতেই প্রবেশ করে।
সবকিছু মিলিয়ে হজ্জ থেকে সৌদি আরব প্রতিবছর প্রায় ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এবং উমরা থেকে আরো অতিরিক্ত ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার সৌদি অর্থনীতিতে যুক্ত হয়।
উপার্জনের খাত
সৌদি আরবের রাজস্ব খাতগুলোর মধ্যে খনিজ তেলের উপার্জনের পরেই হজ্জের অবস্থান। তেল ব্যতীত অন্যান্য পণ্য বা সেবার মধ্যে থেকে সৌদি আরবের জিডিপির ২০ শতাংশই আসে হজ্জ থেকে। এবং দেশটির সমগ্র জিডিপির ৭ শতাংশ হল হজ্জের রাজস্ব।
হজ্জ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ থেকে সৌদি অর্থনীতি সম্বৃদ্ধ হয়। যার মধ্যে রয়েছে ভিসা ফি, আবাসন, পরিবহন, খাদ্য ও পানীয় এবং স্থানীয় ব্যবসা। হজ করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে সৌদি আরবে যেতে প্রথমেই ভিসার দরকার হয়। দেশভেদে ভিসা বাবদ জনপ্রতি ৮০ থেকে ৫০০ ডলার পর্যন্ত খরচ করতে হয়। লক্ষ লক্ষ হাজীদের কাছ থেকে আদায় করা ভিসা ফি থেকেই সৌদি আরব বিপুল পরিমাণ আয় করে থাকে।
সৌদি আরবের মক্কা-মদিনার আবাসন শিল্প হজের সময় ব্যাপক চাঙ্গা হয়ে ওঠে। স্বল্প মূল্যের হোটেল থেকে শুরু করে বিলাসবহুল হোটেল পর্যন্ত; এমনকি তাঁবুর শহর মিনাতে থাকার জন্য হাজিদের হজ্জ বাজেটের একটি বড় অংশ চলে যায়। হাজীদের জনপ্রতি প্রায় দুই থেকে ৫ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ করতে হয় শুধু আবাসনের পেছনে।
সৌদি আরবের ভেতরে হাজীদের যাতায়াতও রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস। পরিবহন খাতের মধ্যে বিমান পরিসেবা, বাস, ট্রেন এবং ট্যাক্সিতে হাজীদের বেশ অনেক অর্থ খরচ হয়। হাজীদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে সৌদি আরব নানা ধরনের মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হলো হারামাইন হাই স্পিড রেলওয়ে। দ্রুতগতির এই রেল সেবার মাধ্যমে হাজিরা খুব সহজে মক্কা থেকে মদিনা মধ্যে যাতায়াত করতে পারে।
হজের সময় বিপুল পরিমাণ লোক সমাগমের কারণে সৌদি আরবের খাদ্য চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। এসময় ছোটখাটো খাবারের দোকান থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট এবং সুপারমার্কেট গুলোতে বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্য বিক্রি হয়। ধারণা করা হয় একজন হাজি গড়ে প্রায় ৩০০ থেকে ৫০০ ডলারের খাবার খেয়ে থাকেন।
হাজিরা হজ থেকে ফিরে আসার সময় আত্মীয়-স্বজনের জন্য উপহার, জামা কাপড়, স্বার্ণালঙ্কার এবং নানা ধরনের ধর্মীয় সুভিনিয়র কিনে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশি হাজীদেরকে জায়নামাজ, তসবি, টুপি, আতর, খেজুর, জমজমের পানির মত বিভিন্ন ধরনের বস্তু সৌদি আরব থেকে উপহার হিসেবে নিয়ে আসতে দেখা যায়। এসবের পিছে হাজিরা গড়ে প্রায় ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ করে থাকেন।
এছাড়া হাজিরা হজের মূল কার্যক্রম শেষে সৌদি আরবের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যান। হজ পালন করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া হাজিদের চিকিৎসার বাবদও সম্মিলিতভাবে একটি মোটা অংকের অর্থ খরচ হয়। এসবের বাইরেও হজ্জ যাত্রীদের টেলিযোগাযোগ, লন্ড্রি, প্রযোজনীয় মুদি মালামালের পিছে যা খরচ হয়, তার সবই সৌদি অর্থনীতিতে যুক্ত হয়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
২০২২ সালের মধ্যে হজের মাধ্যমে ৩০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল সৌদি সরকার। কিন্তু মহামারির কারণে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়ায়, সৌদি সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সাল নাগাদ ৩ কোটি মানুষের জন্য হজ ও ওমরাহ পালনের সুযোগ তৈরি করা। যখন কয়েক কোটি লোক মক্কা শহরে সমবেত হবে, তখন ভীড় সামলানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াবে। ২০২২ সালের হজ্জে মাত্র ৯ লাখ লোকের ভিড় সামলাতে সৌদি সরকার প্রায় ২ লাখ ৩৬ হাজার কর্মী নিয়োগ দিয়েছিল। হজ্জের পরিসর বৃদ্ধি সাথে সাথে সৌদি আরবে আরো বিপুল কর্মস্থানেরও সৃষ্টি হচ্ছে। তবে কোটি লোকের সমাগম প্রথাগত পদ্ধতিতে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই সৌদি কর্তৃপক্ষ ক্রাউড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে ডাটা এনালিটিক্স, এআই এর মত উন্নত কার্যকর প্রযুক্তি গড়ে তোলা পেছনেও বিনিয়োগ করছে।
কোটির বেশি মুসলিমের জমায়েত হওয়ার জন্য পবিত্র মসজিদ আল হারামকে এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের মাধ্যমে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। সেই সাথে হারামাইন হাই স্পিড রেলওয়েও মক্কা মদিনার বাইরে জেদ্দা সহ অন্যান্য শহর পর্যন্ত বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ হজ্জযাত্রীর আগমন নির্বিঘ্ন করতে কিং আব্দুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে বিশাল একটি নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে।
দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ার ফলে নির্মাণ ও আবাসন শিল্পের জন্য নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। মক্কা নগরীতে প্রায় লক্ষাধিক হোটেল রুম রয়েছে। এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হোটেল রুম থাকবে মক্কায়। অন্যদিকে মদিনায় বর্তমানে ১৮ হাজারের বেশি হোটেল রুম আছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। হোটেল রুমের বাইরেও বিপুল পরিমাণ হাজীদের আবাসনের বন্দোবস্ত করতে অসংখ্য আবাসিক ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। হজ্জ কে কেন্দ্র করে সৌিদ আরবে পরিচালিত এসব অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প থেকেও দেশটির অর্থনীতি ব্যাপক লাভবান হচ্ছে।
পর্যটন বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে ‘ধর্মীয় পর্যটন’ই হবে সৌদি আরবের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। ফিউচার মার্কেট ইনসাইটসের তথ্যানুসারে, ২০৩২ সালের মধ্যে ওমরাহ ও হজযাত্রীর পাশাপাশি পর্যটন থেকে সৌদি আরব ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করবে বলে আশা করা হচ্ছে।