ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের শেষ কোথায়
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের শেষ কোথায়
অনিশ্চিত যুদ্ধ
বর্তমানে ইরান ও ইসরায়েলের যুদ্ধ একটি ব্যয়বহুল ও কৌশলনির্ভর যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিকে বলা হয় “War of Attrition” বা “ক্ষয়যুদ্ধ”। অর্থাৎ এই যুদ্ধের মূল প্রতিযোগিতা হচ্ছে, কার অস্ত্রের মজুদ কতোটা সম্বৃদ্ধ, কে কতোদিন টিকে থাকতে পারে, এবং কার আন্তর্জাতিক বন্ধুর সংখ্যা বেশি।
এই যুদ্ধের সকল কৌশলগত দিক থেকে ইসরায়েলে এগিয়ে আছে। কিন্তু ইসরায়েলের সেই সক্ষমতা তৈরী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সহ তাদের পশ্চিমা মিত্রদের সহায়তায়। অন্যদিকে ইরান দীর্ঘকাল ধরে সমগ্র বিশ্ব থেকে একঘরে হয়ে থেকেও, নিজের বলে তৈরী করছে অভাবনীয় সামরিক সক্ষমতা আর শক্তিশালী ক্ষেপনাস্ত্রের ভান্ডার।
ইরানের ক্ষেপনাস্ত্র
ইরান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সামরিক পরাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয় মূলত তাদের স্বনির্ভর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রযুক্তির জন্য। নানা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও চাপের মধ্যেও ইরান নিজেদের সামরিক উৎপাদন সক্ষমতা বজায় রেখেছে এবং বহু বছর ধরে অত্যন্ত কার্যকর একটি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন বাহিনী গড়ে তুলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে ইরানের হাতে রয়েছে প্রায় তিন থেকে চার হাজারের মতো বিভিন্ন ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র এবং কয়েক হাজার সশস্ত্র ও নজরদারিমূলক ড্রোন।
এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বল্প, মধ্যম ও দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল, যেমনঃ Fateh-110, Shahab-3, Emad ও Sejjil। এই মিসাইলগুলোর পাল্লা ২০০ কিমি থেকে শুরু করে ২০০০ কিমিরও বেশি হতে পারে, যা ইরানকে পুরো ইসরায়েল বা সৌদি আরব পর্যন্ত আঘাত হানার সক্ষমতা দেয়। অন্যদিকে, ইরানের ড্রোন প্রযুক্তি—বিশেষ করে Shahed-136, Mohajer এবং Ababil সিরিজের ড্রোন—নানা রকম আত্মঘাতী ও নজরদারি অভিযানে ব্যবহার হয়। এই ড্রোনগুলো ইরান কেবল নিজেরাই ব্যবহার করে না, বরং তারা ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও সিরিয়ায় বিভিন্ন মিত্র গোষ্ঠীগুলোকেও সরবরাহ করে থাকে।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ইরান যদি গড়ে প্রতিদিন ১০০ থেকে ২০০টি ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন নিক্ষেপ করে, তাহলে তাদের এই বিপুল অস্ত্রভাণ্ডার ২০ থেকে ৪০ দিনের মতো স্থায়ী হতে পারে। তবে এটি কেবল একটি অনুমান নির্ভর হিসাব। বাস্তব যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অস্ত্র ব্যবহার হয় পরিস্থিতির জটিলতা ও কৌশলের ওপর ভিত্তি করে। তবে ইরান হয়ত গোপনে তাদের অস্ত্র তৈরির শিল্প অব্যাহত রেখেছে। নিজস্ব উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি চীন রাশিয়ার মত মিত্রদের মাধ্যমে অস্ত্র মজুদের বিকল্প উপায়ও হয়ত ভাবছে।
আধুনিক যুদ্ধবিমানের সীমাবদ্ধতা
ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে ইরান যতই আত্মনির্ভর হয়ে উঠুক না কেন, তাদের সামরিক শক্তির সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা এখনো থেকে গেছে, আর তা হল আধুনিক যুদ্ধবিমান না থাকা। আজকের দিনে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোনই যথেষ্ট নয়; আকাশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেতে হলে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত, চতুর্থ বা পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানে কোন বিকল্প নেই।
ইরান ক্ষেপনাস্ত্র প্রযুক্তিতে এতটা এগিয়ে গেলেও, কেন যুদ্ধ বিমান তৈরী করতে পারলো না? এর কারণ মূলত দুটি: ১. প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং ২. আর্থিক ও রাজনৈতিক অবরোধ।
আধুনিক যুদ্ধবিমান তৈরির প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। এটি শুধু একটি দেশের পক্ষে এককভাবে তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। একটি যুদ্ধবিমান তৈরিতে কয়েক হাজার অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশ দরকার হয়। যার প্রতিটিই ভিন্ন ভিন্ন দেশে উদ্ভাবিত বা উৎপাদিত। রাডার তৈরি হয় এক দেশে, ইঞ্জিন আরেক দেশে, কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল অন্য কোথাও। এমনকি সফটওয়্যার ও সেন্সর প্রযুক্তিও আলাদা দেশের ওপর নির্ভরশীল।
চীনের মতো শীর্ষ প্রযুক্তিসম্পন্ন দেশও একটি বিমান সম্পূর্ণ নিজে তৈরি করতে পারে না। ২০২৩ সালের The Economist-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চীনের COMAC C919 যাত্রীবিমানের রাডার, ইঞ্জিন ও সফটওয়্যার আসে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে। চীন নিজেরা যুদ্ধবিমান তৈরির দাবি করলেও, অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিদেশি প্রযুক্তির অনুকরণে বানানো। বিশেষ করে J-20 স্টিলথ ফাইটারের ইঞ্জিন এখনো পুরোপুরি দেশীয় নয়, এবং এর কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এছাড়াও রাডার, সেন্সর, এভিওনিক্স ও চিপসেটের ক্ষেত্রেও চীন আমদানি ও বিদেশী প্রযুক্তি নির্ভরতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, বহু বছর ধরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা ইরানের পক্ষে, আন্তর্জাতিক সহযোগীতা নিয়ে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান তৈরী করাটা কল্পনাতীত। তারা আন্তর্জাতিক বাজারে সরাসরি বাণিজ্য করতে পারে না, ডলারে লেনদেন করতে পারে না, এবং পশ্চিমা দেশের মেধাসম্পদ বা প্রযুক্তিও কিনতে পারে না। সেকারণেই ইরান যুদ্ধবিমান প্রযুক্তিতে পিছিয়ে রয়েছে।
ইসরায়েলের যুদ্ধ বিমান
ইসরায়েল অত্যন্ত ছোট একটি দেশ হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের মদদে তারা এমন সব সামরিক প্রযুক্তি অর্জন করেছে, যা বহু বড় বড় দেশের কাছেও কল্পনাতীত। তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ হল F-35 স্টিলথ যুদ্ধবিমান।
F-35 Lightning II হলো যুক্তরাষ্ট্রের Lockheed Martin কোম্পানি নির্মিত একটি পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ ফাইটার জেট। এটি পৃথিবীর অন্যতম প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ও ব্যয়বহুল যুদ্ধবিমান। ইসরায়েল এই বিমানটি কিনেছে এবং কিছুটা পরিবর্তন করে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী ‘F-35I Adir’ নামে ব্যবহার করছে, যার অর্থ “দুর্ধর্ষ” বা “শক্তিশালী”। এই প্রকল্পটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে হলেও এতে ন্যাটো এবং ১৫টি মিত্র দেশ মিলে যৌথভাবে অর্থায়ন, গবেষণা ও প্রযুক্তি আদান-প্রদান করেছে। তারমানে ইসরায়েল পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সামরিক সক্ষমতার দেশের সহায়তা নিয়ে, অতি সহজেই সকলের চেয়ে এগিয়ে গেছে।
F-35 এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর স্টিলথ প্রযুক্তি। এর গঠন এমনভাবে তৈরি যে এটি সাধারণ রাডারে ধরা পড়ে না। এর ফলেই মূলত ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান বেশিরভাগ রাডার সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়ে ইরানের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছে। এবং ইরানে হামলা চালিয়ে আবার নিরাপদে ইসরায়েলে ফিরে গেছে। এটি যুদ্ধের সময় এক বিশাল কৌশলগত সুবিধা। যা ইরানের নেই।
ইসরায়েলের খরচের বোঝা
ইসরায়েল সামরিক প্রযুক্তিতে বিশ্বসেরা দেশগুলোর অন্যতম হলেও, এই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারের পেছনে বিশাল অর্থনৈতিক চাপ কাজ করে। ইরানের একটি রকেট বানাতে খরচ হয়, প্রায় ১ কোটি টাকা। কিন্তু ইসরায়েলের Iron Dome, David’s Sling, কিংবা Arrow সিস্টেম দিয়ে সেসব রকেট ঠেকাতে খরচ হয় প্রায় ১২ কোটি টাকা। এই পরিমাণ অর্থ শুধু একটি রকেট ধ্বংস করতে খরচ। কিন্ত ইরান যদি দিনে ২০০ টি ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালায়, তাহলে ইসরায়েলের দৈনিক প্রতিরক্ষা ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। ইসরায়েলের যত উন্নত যুদ্ধ প্রযুক্তিই থাকুক না কেন, প্রতিদিন এত বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে এই যুদ্ধ দীর্ঘদিন চালানো অর্থনৈতিকভাবে অসম্ভব।
বর্তমানে ইসরায়েলের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার উপর নির্ভর করে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ইসরায়েলকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য দিয়ে থাকে। যার একটি বড় অংশ যায় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পেছনে। কিন্তু যদি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়, অথবা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহায়তা কমে অাসে, তাহলে প্রযুক্তিগত সুবিধাই ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় দুর্বলতায় পরিণত হতে পারে। সেকারণে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই এই যুদ্ধকে বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে চাইবে না।
যুদ্ধের শেষ কোথায়?
গাজার মতো ছোট, সীমিত ভূখণ্ডে ইসরায়েল সহজেই স্থল অভিযান চালাতে পারলেও; ইরানের মত বিশাল এবং প্রাকৃতিকভাবে শক্তিশালী দেশে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও সরাসরি হামলা করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে দেশটির রাজধানী তেহরান যেন পাহাড় বেষ্টিত একটি দুর্গ। তাই এখন যেভাবে যুদ্ধ চলছে সেভাবেই চলতে থাকবে।
ইরান ও ইসরায়েলের এই সম্ভাব্য সংঘর্ষের শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা কঠিন। তবে বিশ্লেষকরা যুদ্ধের তিনটি সম্ভাব্য পরিণতি কল্পনা করছেন। ১. ইরানের সরকার পতনের চেষ্টা ২. ইরানের পরমাণু অস্ত্র অর্জন এবং ৩. দীর্ঘস্থায়ী ক্ষয়যুদ্ধ।
ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থা বহু বছর ধরে জনঅসন্তোষ ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রয়েছে। ইরানকে সব সময় দুটি যুদ্ধের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। একটি হল, দেশের ভেতরে জনগণের বিদ্রোহ, অভ্যন্তরীণ ভাঙন, এমনকি সরকার পতনের আন্দোলন। অন্যটি হল পশ্চিমা জোটের ক্রমবর্ধমান হুমকি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই চাপ আরও বেড়ে গেছে।
তবে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে, ইরান যদি এরমধ্যে পারমানবিক অস্ত্র তৈরী করতে সক্ষম হয়। এটি কেবল যুদ্ধের গতিই পরিবর্তন করবে না, বরং গোটা অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য ভেঙে দিবে। আর সেই আশঙ্কা থেকেই ইসরায়েল তড়িঘড়ি করে ইরানের উপর হামলা চালিয়েছে। কারণ ইসরায়েল জানে, ইরানের হাতে পারমাণবিক শক্তি মানে ইসরায়েলের অস্তিত্বের হুমকি।
কিন্তু যদি ইরানের সরকার পতন না হয় এবং ইরান পারমানবিক শক্তিও অর্জন করতে না পারে, তাহলে এই যুদ্ধের একমাত্র পরিণত হল দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয়যুদ্ধ। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর থেমে থেমে এই যুদ্ধ চলতে থাকবে। এবং দুই দেশের অর্থনীতি, অস্ত্রভাণ্ডার ও বন্ধুত্বের জোর নির্ধারণ করবে কে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে।