হালাল টুরিজম

maxresdefault (8)
কি কেন কিভাবে

হালাল টুরিজম

ভূমিকা

পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল একটি শিল্প হল টুরিজম বা পর্যটন। গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্প খাতের নতুন এক ধারণা হল “হালাল টুরিজম”। আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে ২০১৪ সালে, হজ্জ এবং ওমরা বাদেই মুসলিমরা পর্যটনের জন্য খরচ করছে প্রায় ১৪২ বিলিয়ন ডলার। যা বিশ্বের মোট পর্যটন ব্যয়ের প্রায় ১১ শতাংশ। করোনা মহামারির কারণে বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পে ভাটা পড়লেও; বর্তমানে আবারো সারা বিশ্বে হালাল টুরিজমের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। সিঙ্গাপুর ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হালাল ট্রিপ ধারণা করছে ২০২৮ সালের মধ্যে হালাল টুরিজমের বাজার হবে প্রায় ২২৫ বিলিয়ন ডলারের।

হালাল টুরিজম কেন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ?

হালাল টুরিজম কী ?

যারা ইসলামের মূলনীতিগুলো মেনে চলেন, তাদের জন্য প্রচলিত পর্যটন গন্তব্যগুলো মোটেও উপযোগী নয়। বিশেষ করে বেড়াতে গিয়ে খাবার-দাবার খাওয়া এবং ৫ ওয়াক্ত নামাজের জন্য ভালো জায়গা পাওয়া নিয়ে মুসলিমদের বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আর এটিই হালাল টুরিজম সেবার মূল বিষয়।

বিমান পরিসেবা থেকে শুরু করে হোটেল রিসোর্ট এর আবাসন সহ ভ্রমণের প্রতিটি ধাপেই মুসলিমরা নানাভাবে তাদের ধর্মীয় রীতির সাথে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। বিশেষ করে মুসলিম নারীরা ভ্রমণের সময় সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হন। কারণ অধিকাংশ পর্যটন গন্তব্যই নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার জায়গা। ইসলামের পর্দার বিধান পালন করা নারীরা চাইলেও অনেক জায়গায় যেতে পারেন না। শুধু নারীদের জন্যই নয়, মুসলিম পুরুষদের জন্যও বহু জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য, অনেকটাই প্রতিকূল। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর সমুদ্র সৈকত, স্পা এবং অবকাশ যাপন কেন্দ্রগুলো; যেখানে নারীরা স্বল্প বসনা হয়ে অবাধে ঘুরে বেড়ায়, সেখানে ধর্ম পালনকারী কোন মুসলিম পরিবার স্বাচ্ছন্দে বেড়াতে পারে না।

যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত ৯/১১ ঘটনার পর থেকে হালাল টুরিজমের আবির্ভাব ঘটেছে। সেসময় মুসলিম দেশগুলোর পর্যটকেরা একটি মুসলিম দেশ থেকে অন্য মুসলিম দেশে ভ্রমণে যেতে শুরু করে। তখন মুসলিম পর্যটকদের বিশেষ বিশেষ চাহিদার কথা বিবেচনা করে, পর্যটন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো নানা ব্যবস্থা নিতে শুরু করে, যার ফলে হালাল টুরিজম পর্যটনের একটি সম্পূর্ণ নতুন সম্ভাবনাময় শাখা হিসেবে ধরা দেয়। তুরস্ক, সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া সর্ব প্রথম হালাল ট্যুরিজম নিয়ে উদ্যোগ নিয়েছিল।

হালাল টুরিজমের সম্ভবনা

ইসলাম বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল ধর্ম। বর্তমানে বিশ্বের মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ১৯০ কোটির বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা হবে প্রায় ২৮০ কোটি। মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে, ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পণ্য বা সেবার চাহিদাও ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও পৃথিবীর মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। বিশেষ করে মুসলিমদের মাথাপিছু আয় বাড়ার হার অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। সেই সাথে মুসলিম তরুণরা পর্যটনের প্রতি আগের চেয়ে আরো বেশি আগ্রহী হওয়ায় হালাল টুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হালাল হোটেলের পরিসরও অনেক বেড়েছে। শরিয়া ভিত্তিক ব্যাংকিং এবং বিনিয়োগের সফলতার পর, প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের হালাল পণ্য ও সেবার বিস্তারে মনোয়োগ দিয়েছে। অনেক বিমান পরিবহণ সংস্থাও হালাল টুরিজমের অংশ হিসেবে, হালাল খাবার পরিবেশন করতে শুরু করেছে। অমুসলিম দেশগুলোও হালাল ব্রান্ডিং এর অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে সচতেন হয়ে, তারাও একে সাদরে গ্রহণ করছে। সেকারণে পর্যটন বাদেও হালাল ব্রান্ডিং এর ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার তৈরী হয়েছে।

একটা সময় হালাল টুরিজমের সবচেয়ে বড় বাজার দখলে ছিল মালয়েশিয়ার। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া হালাল টুরিজমে শীর্ষে রয়েছে। এর বাইরে হালাল টুরিজমের সবচেয়ে সেরা জনপ্রিয় গন্তব্যগুলো রয়েছে তুরষ্কে।

হালাল সার্টিফিকেশন

হালাল টুরিজম প্রসার ঘটানোর জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল হালাল সার্টিফিকেশন। একজন মুসলিম পর্যটক বেড়াতে গিয়ে সেখানে কী ধরনের হালাল পরিবেশ পাবে, আগে থেকে যদি তার একটি ধারণা পায়, তাহলে তাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা করা সহজ হয়।

মাস্টারকার্ড ক্রিসেন্ট রেটিং হালাল ট্রিপ নামের সিঙ্গাপুর ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান এই কাজটিই করে। তারা হালাল পর্যটনের গন্তব্যগুলোকে রেটিং করে থাকে। ২০১৪ সালে Global Islamic Economic Summit এ প্রতিষ্ঠানটি Global Muslim Travel Index বা GMTI নামে একটি তালিকার সূচনা করেছে। GMTI মুলত হালাল পর্যটনের গন্তব্য নির্ধারণে সহায়তা করে। যার মাধ্যমে পর্যটকেরা যেমন সুবিধামত হালাল পর্যটন পরিসেবা গ্রহণ করতে পারবে; একইভাবে বিনিয়োগকারীরা এই তালিকা দেখে হালাল পর্যটন ব্যবসায় বিনিয়োগও করতে পারবে।

বিশ্বে ৪৮ টি মুসলিম প্রধান দেশ থাকলেও, শুধুমাত্র মালয়েশিয়া এবং ব্রুনাই তে সরকারীভাবে হালাল সাটিফিকেশন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অন্যান্য দেশে বেসরকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এই বিষয়টি নিশ্চিত করে। শুধুমাত্র ইউরোপেই শতাধিক হালাল সার্টিফিকেশনের কম্পানি রয়েছে। যাদের অধিকাংশই খাদ্য-দ্রব্যের হালাল সার্টিফিকেশন নিশ্চিত করে। ফিলিপাইনের ৮০ শতাংশ মানুষ খ্রিষ্টান হলেও, দেশটির সরকার হালাল টুরিজমের জন্য আলাদা সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা চালু করেছে। এর মাধ্যমে হোটেল, রিসোর্ট এবং রেস্টুরেন্টগুলো হালাল এর মান নির্ধারণ করা হয়।

হালাল সার্টিফাইড রেস্টুরেন্ট গুলোতে এলকোহল জাতীয় পানীয় পরিবেশন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, সেই সাথে সারাক্ষণ গান বাজতে থাকা মিউজিক লাউঞ্জ এবং ক্লাব হাউজগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে তাদের উপার্জন তো কমছেইনা; বরং কিছু কিছু হোটেল রিসোর্টের বাৎসরিক আয় ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলিম পর্যটকদের জন্য যেসব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তাতে অমুসলিম পর্যটকেরাও বিরক্ত হচ্ছেন না। এর ফলে পর্যটন ব্যবসার সাথে জড়িতরা তাদের পণ্য বা সেবায় হালাল সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য আরো বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। তাছাড়া সিঙ্গাপুর এবং জাপানও মুসলিম পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে এয়ারপোর্ট সহ বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্যে হালাল খাবার এবং নামাজের ব্যবস্থা করেছে।

তবে হালাল টুরিজমের প্রসারের জন্য আরো সমন্বিত পদক্ষেপের দরকার। যা শুধু হোটেল বা ট্রাভেল কম্পানির বাস্তবায়নের বিষয় নয়। এটি সম্পূর্ণ সরকারী পৃষ্ঠপোশকতার উপর নির্ভর করছে।

হালাল টুরিজম কী সম্পূর্ণ ধর্মীয় ?

অতীতে মুসলিমদের ভ্রমণের একমাত্র সেরা গন্তব্য ছিল হজ্জ পালন করার উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা নগরীতে গমন করা। সেই সাথে হাজ্জিরা সৌদি আরবের মদিনা শহরেও ভ্রমণ করত। হালাল টুরিজম বলতে এই ছিল মুসলিমদের যাতায়াতের জায়গা। কিন্তু সেই ধারণায় এখন অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে।

মুসলিমরা এখন শুধু হজ্জ ওমরা পালনের পরিবর্তে, বিশ্বের অন্যান্য দেশ ভ্রমণেও বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সেকারণে হালাল পর্যটন নিয়ে বেশ কিছু বিতর্কও আছে। অনেকেই বলে থাকেন যারা প্রকৃত ইসলাম চর্চা করে, তাদের প্রমোদ ভ্রমণের বিষটি নিয়েই আপত্তি থাকার কথা। অনেকে আবার বলেন, অযথা টাকা খরচ করে ঘুরে বেড়ানোটা ইসলামের মূলনীতির সাথেও সাংঘর্ষিক।

হালাল টুরিজমের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা মুসলিমদের কে হালাল পর্যটনে যেতে বাধ্য করছেন না। তাদের দাবি, যেসমস্ত মুসলিম কোথাও বেড়াতে যেতে চান তারা তাদের জন্য ইসলামী মূল্যবোধের আদলে ঘুরে বেড়ানোর পরিবেশ করে দিচ্ছেন মাত্র।

সাম্প্রতিক সময়ে দুবাই কে হালাল টুরিজমের একটি শীর্ষ গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করা হলেও; দুবাই সকল দিক থেকে হালাল পরিবেশ দিতে পারছে না বলে মনে করছেন অনেকেই। বরং দুবাই এর অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে উঠেছে যে, স্থানীয় বাসিন্দারাও এই বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত। রমজান মাসে প্রকাশ্যে ধুমপান এবং খাবার খাওয়া, বিদেশী নাগরিকরা স্বল্প বসনা হয়ে ঘুরে বেড়ানো এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির মত যুগলরা জনসম্মুখে অন্তরঙ্গ অবস্থায় সময় কাটানো সহ নানা কারণে এখানে ইসলামিক পরিবেশ আর নেই বললেই চলে।

বর্তমানে প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় হালাল শুধু ধর্মের সাথেই সম্পর্কিত বিষয় নয়। হালাল একটি লাইফ স্টাইল; যা শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, বরং সবার জন্য। হালালের ধর্মীয় অর্থ বাদ দিলে বলা যায়, খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে হালাল কে বলা যায়, এটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সর্বোচ্চ স্তর; এবং ভ্রমণের ক্ষেত্রে হালাল কে বলা যায়, সর্বোচ্চ নিরাপদ এবং পর্যটক বান্ধব ভ্রমণ ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে বলা যায়, হালাল হল সকল ক্ষেত্রে টেকসই ব্যবস্থা এবং বিনম্র জীবন যাপনের এক অসাধারণ মেলবন্ধন। সেকারণেই এখন শুধু মুসলিমরাই নয়, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী পশ্চিমারাও হালাল খাবার এবং হালাল পর্যটনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে হালাল টুরিজমের সম্ভবনা

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে যে ১০টি দেশে হালাল ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা রয়েছে, তার মাধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। কিন্তু যে ১০টি দেশ হালাল ট্যুরিজমের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের নাম নেই।

প্রতিবেশী দেশ শ্রীলংকা এবং ভারত অমুসলিম দেশ হওয়া সত্তেও, তারা হালাল টুরিজম নিয়ে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলিম এবং বেশ কিছু ইসলামি ঐতিহ্যবাহী অসাধারণ পর্যটন গন্তব্য থাকার পরও আমরা এই খাতে কোন উদ্যোগই নিচ্ছি না। শুধু তাই নয়, হালাল পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশকে খুব বেশি বেগও পেতে হবে না। কারণ এই দেশের অধিকাংশ খাবার হোটেল এবং আবাসিক হোটেল হালাল ভাবেই পরিচালিত হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সকল পর্যটন গন্তব্যগুলোর আশে পাশেই মসজিদ রয়েছে, যেখানে পুরুষরা সহজেই নামাজ আদায় করতে পারবে। সেই সাথে নারীদের জন্য পৃথকভাবে নামাজ এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা করা গেলে, বাংলাদেশে হালাল পর্যটনের পরিসর বাড়ানো যাবে। বিদেশী পর্যটকই নয়, শুধুমাত্র দেশীয় টুরিস্টদের হালাল পর্যটনের চাহিদা মেটাতে পারলেও, বাংলাদেশ এই খাতে অনেক এগিয়ে যাবে। 

কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেখানে হালাল ট্যুরিজমকে কাজে লাগিয়ে নতুন সম্ভাবনার মুখ দেখছে, সেখানে এই খাতে আমাদের কোনো বিনিয়োগই নেই। সম্ভাবনার চতুর্থ স্থানে থাকার পরও বাংলাদেশ এই খাতকে কাজে লাগাতে পারছে না।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।