ফিলিস্তিন কেন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায় না
ফিলিস্তিন কেন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায় না
ভূমিকা
সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি প্রস্তাব বিপুল ভোটে পাশ হয়েছে। কিন্তু তারপরও হয়ত ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করতে পারবে না। কারণ অতীতেও বহুবার ফিলিস্তিনের পক্ষে নানা প্রস্তাব পাশ হলেও, সেসব প্রস্তাব বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি।
জাতিসংঘের প্রস্তাব
২০১২ সাল থেকে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের অ-সদস্য পর্যবেক্ষক হিসেবে রয়েছে। সহজ করে বলতে গেলে, ফিলিস্তিন হল জাতিসংঘের দর্শক, তারা অন্যান্য রাষ্ট্রের কার্যকলাপ দেখে, কিন্তু জাতিসংঘের কোন কার্যক্রমে তাদের মত প্রকাশ করার বা, সদস্য রাষ্ট্রের মত কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকার নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদে, ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য করার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য দেশ ১৯৩টি। এদের মধ্যে ১৪৩ টি দেশই ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। তারমানে জাতিসংঘের প্রায় ৭৫ শতাংশ সদস্য ফিলিস্তিনকে পূর্ণ রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে একমত। অন্যদিকে এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে মাত্র ৯টি দেশ। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং আর্জেন্টিনা সহ আরো কয়েকটি অগুরুত্বপূর্ন ছোট দেশ ফিলিস্তিন কে সদস্য করার বিপক্ষে রয়েছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড এবং কানাডা সহ ২৫ টি দেশ এই প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত ছিল।
জাতিসংঘে কোন প্রস্তাব পাশ হওয়ার জন্য নূন্যতম ১১৮ ভোটের দরকার হয়। আশা করা হচ্ছিল ফিলিস্তিন হয়ত ১২০ থেকে ১৩০ টির মত ভোট পেতে পারে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রস্তাবের পক্ষে ১৪৩ ভোট পড়ায়; ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু এখানেই সবকিছূ চূড়ান্ত হয়ে যায়নি। কারণ এই প্রস্তাবটি আবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাশ হতে হবে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে আছে ইসরায়েলের ঘনিষ্ট মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। অনেকটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘের অন্তর্ভূক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিবে। সাধারণ পরিষদের এই ভোটের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদ না পেলেও, এই রায় ফিলিস্তিনের পক্ষে একটি বৈশ্বিক স্বীকৃতি হিসেবে কাজ করবে। জাতিসংঘে প্রস্তাবটি এমন সময়ে পাশ হয়েছে, যখন ইউরোপীয় বেশ কিছু দেশ ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ফিলিস্তিন জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হতে না পারলেও, এই স্বীকৃতির ফলে তারা বাড়তি কিছু সুবিধা ভোগ করতে পারবে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে, সাধারণ পরিষদের অন্যান্য সদস্য দেশের পাশে তারা আসন পাবে। সেই সাথে জাতিসংঘের যেকোন বিতর্কে অংশগ্রহণ, এজেন্ডা প্রস্তাব এবং কমিটি নির্বাচনে প্রতিনিধি রাখতে পারবে ফিলিস্তিন। তবে এখনও কোন প্রস্তাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে না তারা।
ভোটের আগে জাতিসংঘে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের দূত রিয়াদ মানসুর বলেন, আমরা শান্তি চাই, আমরা স্বাধীনতা চাই, একটা হ্যাঁ ভোট ফিলিস্তিনের অস্তিত্বের ভোট, এটা কোন রাষ্ট্রের বিপক্ষে নয়।
অন্যদিকে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের দূত, গিলাদ এরদান বলে, জাতিসংঘ একটি ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে’ স্বাগত জানাল। অধিবেশনে বক্তব্য রাখার সময়, মানুষ রূপী এই পশু জাতিসংঘ সনদের একটি কপি ছিড়ে ফেলে। সে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বলে, আপনাদের অনেকেই ইহুদী বিদ্বেষী। এই নরপশু তারা বক্তব্যের পুরোটা সময় জুড়ে এমনসব ভয়াবহ মিথ্যাচার করতে থাকে, যা কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কোন প্রস্তাব পাশ হওয়ার পর, তা চূড়ান্ত করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের ভোট দরকার হয়। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য ১৫টি দেশ। এদের মধ্যে ৫টি স্থায়ী সদস্য হল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন এবং ফ্রান্স। এবং বাকি ১০ টি অস্থায়ী সদস্য পালাক্রমে দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে। যে কোন প্রস্তাবে যদি একটি স্থায়ী সদস্য ভেটো প্রদান করে, তবে সেই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।
ফিলিস্তিন এখনও পর্যন্ত জাতিসংঘের পূর্ন সদস্য হতে পারেনি কেন? এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কোন কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে না কেন? এই দুটি প্রশ্নের উত্তর আসলে একই; আর তা হল জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা। যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার অপব্যবহার করেই ইসরায়েল যুগের পর যুগ ধরে ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, জাতিগত নিধন আর সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারছে।
মাত্র কিছুদিন আগেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির একটি প্রস্তাব উঠানো হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগে তা খারিজ হয়ে যায়। গাজায় ইসরায়েলের চালানো মানবতা বিরোধী যুদ্ধে এখনও পর্যন্ত ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেলেও, ভয়াবহ এই যুদ্ধাপরাধ থামানো যাচ্ছে না। কারণ যতবারই গাজায় যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব উঠেছে, তত বারই যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। আমেরিকা শুধু গাজাবাসীর জন্য “উদ্বেগ” প্রকাশ করেই পার পেতে চাইছে। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, সমগ্র বিশ্ব ন্যায়ের পক্ষে থাকলেও, জাতিসংঘকে জিম্মি করে যুক্তরাষ্ট্র একাই অন্যায় চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে।
দ্বি-রাষ্ট্র ব্যবস্থা
ফিলিস্তিনের সমস্যা সমাধানের জন্য বিশ্বের সকল দেশ একটি বিষয়ে একমত, আর তা হল Two-State Solution বা দ্বি-রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে যখন প্রথমবারের মত ফিলিস্তিনের ভূখন্ড ভাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, তখনই দ্বি-রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে বলা হয়। এই ব্যবস্থার অধীনে এই অঞ্চলে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার কথা ছিল, একটি দেশ হবে ইহুদিদের জন্য, যার নাম হবে ইসরায়েল এবং অন্যটি হবে আরবদের জন্য যার নাম হবে ফিলিস্তিন।
তারপর থেকে ফিলিস্তিনীদের দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ইহুদিরা যড়যন্ত্র করে নিজেদের রাষ্ট্র গড়ে তুললেও, তারা চায় না ফিলিস্তিনীরা নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করুক। তাদের যুক্তি হল এ ধরনের রাষ্ট্র গড়ে উঠলে তা ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। তারমানে বিষয়টা অনেকটা এরকম যে, চোর-ডাকাতরা দাবি করছে, দেশে কোন থানা-পুলিশ বা কারাগার নির্মাণ করা যাবে না; কারণ তা চোর-ডাকাতদের অস্তীত্বের জন্য হুমকি।
ইসরায়েলের গডফাদার যুক্তরাষ্ট্রও লোক দেখানো সুরে বলে থাকে, তারাও টু স্টেট সল্যুউশন সমর্থন করে। তবে এই সমাধান আসতে হবে শুধুমাত্র ইসরায়েল ফিলিস্তিনের পারস্পারিক আলোচনার মাধ্যমে। কিন্তু ইসরায়েল ফিলিস্তিনের কোন প্রতিনিধির সাথে আলোচনাই করতে চায় না; এবং ইসরায়েল সরকার প্রকাশ্যেই বলে আসছে তারা ফিলিস্তিনকে কখনই স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে দিবে না। তারমানে আমেরিকাও চায় না ফিলিস্তিন স্বাধীন হোক। তারা শুধু কথার মারপ্যাচে বোঝাতে চাচ্ছে তাদের এখানে কিছুই করার নেই। কিছুদিন আগে যখন ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা দেওয়া কথা আসে, তখন যুক্তরাষ্ট্র বলে এখনও এটা করার সময় হয়নি।
৩৫ হাজারের বেশি লোক মারা যাবার পর, ৮০ হাজার মানুষ মারাত্নক আহত হবার পর, ১৭ লক্ষ লোক ঘরবাড়ি হারানোর পর, ২২ লক্ষ মানুষ দিন রাত নিরবচ্ছিন্ন বোমা হামলার ঝুঁকিতে থাকার পরও ফিলিস্তিনীদের স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার সময় আসেনি?
তবে সত্যি কথা বলতে, ফিলিস্তিনকে যদি জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হিসেবে গ্রহণ করাও হয় এবং বিশ্বের সকল দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিও দেয়; তবুও বাস্তবে আসলে ফিলিস্তিনবাসীর কোন লাভ হবে না। কারণ ফিলিস্তিনের কোন সার্বভৌম ভূখন্ডই নেই। শুধু গাজা নয়, পশ্চিম তীরেরও সিংহভাগ অঞ্চল ইসরায়েলের দখলে। এই বিস্তৃত অঞ্চলে গড়ে ওঠা অবৈধ ইসরায়েল রাষ্টের ভেতর ফিলিস্তিনীরা কয়েকটি ছিটমহলের মত এলাকায় বসবাস করে। তাই পৃথিবীর বিষফোড়া ইসরায়েলকে যতদিন পর্যন্ত উচ্ছেদ করা না হবে, ততদিন পর্যন্ত শুধু ফিলিস্তিন নয়, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে এমনকি সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।