বোয়িং এর বিমান কেন বারবার বিধ্বস্ত হয়

maxresdefault (9)
কি কেন কিভাবে

বোয়িং এর বিমান কেন বারবার বিধ্বস্ত হয়

ভূমিকা

একটা সময় ছিল, যখন বোয়িং কম্পানির বিমানগুলোকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ বিমান মনে করা হত। সেকারণেই একটি কথা প্রচলিত ছিল যে, “If it’s not Boeing, I’m not going!” তারমানে বোয়িং না হলে, পাইলট বা যাত্রীরা কেউ সেই বিমানে উঠতেই চাইত না। বোয়িংয়ের প্রতি যাত্রী এবং পাইলটদের সেই অন্ধ বিশ্বাস সময়ের সাথে সাথে বদলেছে গেছে।

বর্তমানে বোয়িং এর ব্রান্ড ইমেজে বিশ্বস্ততার বদলে যুক্ত হয়েছে, অবহেলা জনিত নিরাপত্তা ত্রুটি, কর্পোরেট দুর্নীতি আর অতি মুনাফা লোভী কম্পানির তকমা। যার ফলে বোয়িং নামটি এখন ভয়, ক্রোধ আর কান্নার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। 

বিগত কয়েক বছরে বোয়িং ৭৩৭ বিমানের একাধিক দুর্ঘটনার পর, সাম্প্রতিক সময়ে এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার দুর্ঘটনায়; বোয়িং বিমানের ত্রুটি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

বোয়িং এর বিমান কেন বারবার বিধ্বস্ত হয় ?

দুর্ঘটনার শুরু

বোয়িং এর দুর্ঘটনার সবচেয়ে ঘৃণিত অধ্যায় রচিত হয় ২০১৮ সালের শেষ দিকে। সেবছর ইন্দোনেশিয়ার Lion Air নামের একটি বিমান সংস্থা তাদের একটি নতুন Boeing 737 MAX বিমানে যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। বিমানটি উড়ার মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেটি আকাশ থেকে সোজা জাভা সাগরে আছড়ে পড়ে। এবং বিমানের ১৮৯ জন আরোহীর সকল যাত্রী ও কর্মী মারা যায়।

প্রথমে সবাই ভেবেছিল হয়তো পাইলটদের ভুল, কিংবা বিমান সংস্থার ত্রুটির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তখনো কেউ বোয়িংকে সন্দেহ করেনি। কারণ তখনও পর্যন্ত বোয়িং মানেই ছিল নিরাপত্তা আর বিশ্বাস।

কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার সেই বিমান দুর্ঘটনার মাত্র পাঁচ মাস পরে, ইথিওপিয়ায় আরেকটি 737 MAX বিমান একইভাবে আকাশ থেকে আছড়ে পড়ে। সেই দুর্ঘটনায় নিহত হয় আরও ১৫৭ জন।

সামান্য কয়েক মাসের ব্যবধানের বোয়িং 737 MAX বিমান দুটির একইভাবে দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার ঘটনা সারা বিশ্বকে অবাক করে দেয়। কারণ একই মডেলের দুটি িবমান, একইভাবে দুর্ঘটনায় পড়ার মত কাকতালীয় ঘটনা বিমান পরিসেবার ইতিহাসে বিরল। সেই দুটি দুর্ঘটনার পরই, সবাই বোয়িং কে সন্দেহ করতে শুরু করে। আর তার ফলেই সবার সামনে বেরিয়ে আসে এক ভয়ংকর গোপন সত্য।

MCAS সফটওয়্যার

বোয়িং তাদের 737 MAX বিমানগুলোতে MCAS নামের একটি নতুন ধরনের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা যুক্ত করেছিল। MCAS অর্থ হল Maneuvering Characteristics Augmentation System। এর কাজ হল বিমানের নাক বেশি ওপরে উঠে গেলে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিমানের নাক নিচের দিকে ঠেলে দেয়া, যেন বিমানটি স্বাভাবিক অবস্থায় ভেসে থাকতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই সিস্টেমটা পাইলটদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। বিমানের কোন ম্যানুয়াল বা ট্রেনিংয়েও বিষয়টি সম্পর্কে জানানো হয়নি।

দুর্ঘটনাগুলো ঘটার কারণ হল, বিমানের ত্রুটিপূর্ণ একটি সেন্সর ভুলভাবে জানান দিতে থাকে যে বিমানটির নাক উচা হয়ে যাচ্ছে, তখন MCAS বারবার বিমানটির নাক নিচের দিকে ঠেলে দিতে শুরু করে। তখনও পাইলটরা জানতই না MCAS নামে কিছু একটা আছে, তাই তারা বুঝতেই পারে না কেন হঠাৎ করে বিমান নিচের দিকে যাচ্ছে। MCAS বারবার বিমানের নাক নিচে ঠেলে দিত, আর পাইলটরা সেটাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়তেন।

সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হল, এই অবস্থা প্রতিরোধ করার জন্য পাইলটদের হাতে ছিল মাত্র ১০ সেকেন্ড। মাত্র ১০ সেকেন্ডের মধ্যে যদি পাইলটরা বুঝতেন কী করতে হবে, তবেই তারা সবাই বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু এই অবস্থা থেকে বাঁচা তো দূরের কথা, তারা এই সিস্টেম সম্পর্কেই জানত না।

তবে অবাক করার মতো একটি বিষয় হল, ইন্দোনেশিয়ার লায়ন এয়ার দুর্ঘটনার ঠিক আগের দিনই, একই বিমান, একই রুটে উড়ার সময় একই সমস্যায় পড়েছিল। কিন্তু সেদিন বিমানে একজন অতিরিক্ত পাইলট ছিলেন, যিনি জানতেন কীভাবে এই সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। তিনি তখন মূল দুই পাইলটকে একটি বিশেষ সুইচ বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আর তাতেই বিমানটির নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসে এবং সেদিন তারা নিরাপদে অবতরণ করে।

কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হল, সেই গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা পরের দিনের পাইলটদের জানানো হয়নি। তারা জানত না আগের দিন কী ঘটেছিল। ফলে যখন একই সমস্যা আবার দেখা দেয়, তখন তারা বিমানের ম্যানুয়াল পড়ে সমাধান খুঁজতে খুঁজতেই সকল যাত্রী সহ প্রাণ হারায়।

বোয়িং কোম্পানির লোভ

বোয়িং 737 MAX বিমান দুটির ভয়ংকর দুর্ঘটনার পেছনে শুধু একটি MCAS সিস্টেমই নয়, বোয়িং কোম্পানির কর্পোরেট লোভেরও দায় ছিল। অতীতে বোয়িং কম্পািনর মূল লক্ষ্য ছিল তাদের কাজের সেরা মান নিশ্চত করা। সেজন্য নতুন প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে পরিক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপরই বিমানে সংযোজন করা হত।

কিন্তু ১৯৯৭ সালে বোয়িং তাদের প্রতিদ্বন্দী McDonnell Douglas নামের আরেকটি বিমান নির্মাতা কোম্পানিকে কিনে নেয়। এতদিন পর্যন্ত বোয়িং এর নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল কোম্পানির ভেতরকার প্রকৌশলীরা। কিন্তু নতুন কম্পানির সাথে একীভূত হওয়ার পর, শেয়ারবাজারে লাভ করতে চাওয়া ব্যবসায়ী কর্মকর্তারাই বোয়িং এর শীর্ষ পদে আসীন হয়। তখন থেকে বিমানের নিরাপত্তার চেয়ে, বাজারে ‘দ্রুত’ নতুন বিমান ছাড়ার প্রতিযোগিতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বিমানে যখন নতুন একটি প্রযুক্তি অন্তর্ভূক্ত করা হয়, তখন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান থেকে সেই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ছাড়পত্র বের করা একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া। সেই সাথে নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে, বিমানের ক্রেতা এয়ারলাইন্স কম্পানির পাইলটদের আলাদা করে ট্রেনিং দিতেও বহু সময় এবং অর্থ খরচ হয়। আর সেকারণেই বোয়িং তাদের MCAS সিস্টেম গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। যাতে অল্প সময়ে তারা বেশি বিমান বিক্রি করতে পারে।

শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন প্রশাসন কেও তারা ভুল তথ্য দিয়ে বোঝায় যে, এই সিস্টেম খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আর এভাবেই অতি মুনাফালোভী মনেভাবের কারণে, সকলের আস্থার বোয়িং একটি বিশ্বাসঘাতক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

ভারতে বোয়িং দুঃস্বপ্ন

এতদিন মনে করা হত, বোয়িং এর শুধুমাত্র 737 MAX বিমানটিই হয়ত দুর্ঘটনা প্রবণ। কিন্তু অতি সম্প্রতি ভারতে একটি Boeing 787 Dreamliner বিমানেও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এটিই বোয়িং ৭৮৭ সিরিজের প্রথম বড় কোন দুর্ঘটনা।

২০২৫ সালের ১২ জুন, Air India এর একটি ফ্লাইট গুজরাটের আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু বিমানটি উড়ার মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই এটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি মেডিকেল কলেজের ছাত্রবাস ভবনের ওপর ভেঙে পড়ে। যার ফলে বিমানটিতে থাকা ২৪১ জন যাত্রী ও কর্মী নিহত হন। এবং শুধুমাত্র একজন যাত্রী বেঁচে যান।

এয়ার ইন্ডিয়া ২০১৪ সাল থেকে বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমানটি ব্যবহার করছে। একটি ড্রিমলাইনার বিমান কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ বছর যাত্রীসেবা দিতে পারে। সে হিসেবে বিমানটি অতটাও পুরনো নয়।

ভারতের এই বিমান দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি। এই  দুর্ঘটনাও কি বোয়িং এর কোন নিরাপত্তা ত্রুটির কারণে ঘটেছে, নাকি অন্যকোন মানবিক বা যান্ত্রিক ত্রুটির ফসল তা কেবল অনুসন্ধান শেষ হলেই জানা যাবে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে সমগ ‍বিশ্বজুড়েই বিমান দুর্ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। যার ফলে বিমান ভ্রমণের নিরাপত্তা নিয়ে যাত্রীদের মনে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমাগত প্রযুক্তির উন্নতি ও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্ত্বেও বিমান দুর্ঘটনা পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। 

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।