কুরবানী ইদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
কুরবানী ইদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
ভূমিকা
বাংলাদেশের বৃহত্তম ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবগুলোর মধ্যে ঈদ উল আযহা বা কোরবানীর ঈদ অন্যতম। শুধু ধর্মীয় বা সামাজিক দিক থেকেই নয়, অর্থনৈতিক কারণেও কোরবানীর ঈদ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রতি বছর কোরবানীর ঈদ কে কেন্দ্র করে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রায় লক্ষ কোটি টাকা লেনদেন হয়। এর মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যে শুধু কোরবানীর পশু বিক্রি হয়। এছাড়াও ইদের আগে পরে মিলিয়ে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মশলা, পশু খাদ্য, দেশীয় ছুরি চাপাতি, পশুর চামড়া, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি পন্যের হাজার হাজার কোটি টাকার বানিজ্য হয়। এর বাইরেও ইদে ঘরমুখো মানুষের যাতায়াতের জন্য পরিবহণ খাতের উপার্জন তো আছেই।
কুরবানীর পশু
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় এক কোটি ২০ লক্ষ কোরবানীর পশুর চাহিদা আছে। এবং প্রতিবছরই এই চাহিদা বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কোরবানীর পশুর বাজারে প্রায় দেড় কোটি পশুর সরবরাহ থাকে। সেকারণে অনেক পশু অবিক্রিতও থেকে যায়। কিন্তু একটা সময় বাংলাদেশে কোরবানীর পশুর চাহিদার একটি বড় অংশ মিটত ভারত থেকে আসা গরুর মাধ্যমে। নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার পর ভারতে থেকে বাংলাদেশে গরু আসা অনেক কমে যায়। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো কোরবানির পশুর ব্যাপক সংকট তৈরি হয়।
ভারত থেকে ব্যাপকভাবে গরু আসা কমে যাওয়া উল্টো বাংলাদেশের জন্য আর্শিবাদ হয়ে দাঁড়ায়। মূলত তখন থেকেই বাংলাদেশের সরকার এবং খামারিরা উপলব্ধি করে, দেশের ভেতরেই গবাদি পশুর সংখ্যা বাড়াতে হবে। আর সেই থেকেই বাংলাদেশ কোরবানীর পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে আগাতে থাকে।
বাংলাদেশ প্রাণী সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর তথ্য মতে, ব্রাহমা জাতের গরু ব্যাপকহারে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সংকট সামাল দিয়েছে বাংলাদেশ। এই জাতের গরু লালন পালন করে অধিক মাংস উৎপাদন এবং সহজে গরু মোটাতাজা করণের মত পদক্ষেপ সফল হয়েছে। ভারত থেকে গরু আসা কমে যাওয়ার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে কয়েকবছর সময় লাগলেও, এটি এখন বাংলাদেশের গ্রামীন অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কুরবানীর বাজার
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, প্রতি বছর গড়ে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার কোরবানির পশু বিক্রি হয়। প্রায় ৯৯ শতাংশ কোরবানির পশুই কেনা হয় দেশের গরিব মানুষদের কাছ থেকে; যারা কোরবানি উপলক্ষে এই পশুগুলো লালন পালন করেন। এতে গরিবের অর্থনৈতিক চাকা সচল হয়। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে গ্রামগঞ্জের বাজারগুলো সচল হয়ে ওঠে। প্রতিবছর দেশে কোরবানির আগে ও পরে মিলিয়ে এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে, গবাদি পশুর বানিজ্য ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়।
অনেকেই মনে করেন, পশু বিক্রির বাইরে শুধু চামরার ব্যবসাই জমজামট হয়। কিন্তু বিষয়টি মোটেও সেরকম নয়। কোরবানির সময় চামড়ার বাণিজ্য ছাড়াও, গরু জবাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ছুরি বঁটির ব্যবসা হয়। গরুকে খাওয়ানোর খড় এবং খৈল ভূষির দেদার বেচাকেনা হয়। জবাইয়ের সময় পাটের চট, বাঁশের চাটাই এগুলোর দরকার হয়। আর হাজার হাজার টন মাংস রান্নার জন্য দরকার হয় বিপুল পরিমাণ মশলা। এছাড়া মাংস সংরক্ষণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি জিনিস রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ। এরসঙ্গে গরু আনা-নেওয়া, বেচাকেনায় সহায়তা এবং জবাই ও মাংস তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমের বিনিময় মূল্যও উল্লেখযোগ্য। সব মিলিয়ে একটি বিরাট অংকের টাকা মাত্র দুই সপ্তাহে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়। এই বড় অংকের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয় এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে।
আদমানি-রপ্তানিতে অবদান
বাংলাদেশ থেকে যেসমস্ত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়, তারমধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চামড়া। বাংলাদেশে উৎপাদিত চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য সমগ্র বিশ্বের ২ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন বলছে, বাংলাদেশে সারা বছর যত চামড়া বাজারে আসে তার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই আসে কোরবানী ঈদের সময়। ইদের সময়ে সংগৃহীত চামড়াকে কেন্দ্র করে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর চামড়াজাত পণ্য রফতানি করা হয়।
চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের অন্যতম উপাদান হল লবণ। কোরবানির সময় লবণের ব্যবসাও চাঙ্গা হয়। কোরবানি উপলক্ষে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার টন লবণ আমদানি করা হয়। চামড়া সংরক্ষণের কাজে বিপুল জনবলের প্রয়োজন হয়। এসময় শ্রমিকরাও ভালো মজুরি পায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে লক্ষ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ২২ লক্ষ টন পেঁয়াজ, ৫ লক্ষ টন রসুন এবং ৩ লক্ষ টন আদার চাহিদা থাকে। এর উল্লেখযোগ্য অংশই ব্যবহার হয় কোরবানিতে। অন্যদিকে গরমমসলা বিশেষ করে এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা, তেজপাতার উল্লেখযোগ্য অংশ কুরবানিতে ব্যবহার হয়। সবকিছু মিলিয়ে কোরবানির বাজারে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মশলা কেনাবেচা হয়। কোরবানির মাংস সংরক্ষণের জন্য বছরের যে কোনও সময়ের তুলনায় ফ্রিজ বিক্রির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ফ্রিজ ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যমতে, দেশে বছরে ১৪ লাখ ফ্রিজের চাহিদা আছে। এই চাহিদার ৩০ ভাগ ফ্রিজই বিক্রি হয় কোরবানি ঈদে। একইভাবে কোরবানির পশু কেনার পর কোরবানি দাতা পশুটিকে ২/৩দিন নিজের কাছে রাখেন। এসময় পশু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চটের বস্তা, পশুকে খাওয়ানোর জন্য খড়, খৈল ভূষি ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। এসব কেনার ক্ষেত্রের কয়েকশ কোটি টাকা হাত বদল হয়। কোরবানীর সময় কামারের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদাও অনেক বেড়ে যায়। কারন এসময় দেশীয় ছুড়ি, চাকু, বটি, চাপাতি এবং রামদা দরকার হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কোরবানির বাজারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কামারের উৎপাদিত পণ্য ১ হাজার কোটি টাকার বেশি মুল্যে বিক্রি হয়। তাছাড়াও কোরবানির সময় বাঁশ-খুঁটিরও কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়।
পরিবহণ ও অন্যান্য খাতে অবদান
কুরবানী উপলক্ষ্যে ট্রাক ও পিক আপ জাতীয় পরিবহণ ব্যবসাও চাঙা হয়ে ওঠে। গ্রাম থেকে শহরে গরু নিয়ে আসার জন্য ট্রাক এবং হাঁট থেকে বাসায় গরু নেয়ার জন্য পিকআপের ব্যাবহার বহুগুণে বেড়ে যায়। এছাড়া কুরবানী উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের ভীড়ও বাড়ে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এ সময় পরিবহন খাতে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যবসা হয়।
কুরবানীর পশু যবাইয়ের পর মাংস কাটা এবং চামড়া ছাড়ানোর জন্য কসাইদের চাহিদা বেড়ে যায়। এ উপলক্ষে বহু লোক মৌসুমী কসাই হিসেবে গ্রাম থেকে শহরে আসে। তারা ২/৩ জন মিলে একেকটি গরু কাটার সমস্ত কাজ করে দেয়। একটি গরু কাটতে গড়ে ৫ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ নেওয়া হয়। তবে গরুর আকারের উপর এই দাম ওঠা নামা করে। অনেকে আবার গরুর দামের হাজার প্রতি একশ টাকা নিয়ে থাকে। যেমন, গরুর দাম যদি হয় ১ লক্ষ টাকা, তাহলে কসাইকে দিতে হবে ১০ হাজার টাকা।
কোরবানীর পশু বিক্রি থেকে সরকারও নানাভাবে বহু টাকা রাজস্ব আদায় করে। সরকারি নিয়ম অনুসারে, প্রতিটি গরু-মহিষের জন্য ৫০০ টাকা, দুম্বা বা ছাগলের জন্য ২০০ টাকা এবং উটের জন্য ৬ হাজার টাকা রাজস্ব দিতে হয়। প্রতি বছর কোরবানীর সময় সরকার কমপক্ষে এক কোটি পশু বিক্রির রাজস্ব পেলেও, তা বেশ বড় একটি অঙ্ক দাড়ায়। এছাড়া পশুর হাট ইজারা দেওয়াও স্থানীয় সরকারের একটি উপার্জনের উৎস। শুধু ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনই পশুর হাট ইজারা দিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা আয় করে।
কোরবানী ইদের সময় এত বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন হলেও, পুরো আর্থনৈতিক প্রবাহটাই ঘটে অনেকটা বিক্ষিপ্তভাবে। সেকারণে এর সঠিক হিসাব করাটা খুবই কঠিন। তবে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিকল্পিতভাবে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত করা গেলে তা জিডিপিকে আরো সমৃদ্ধ করবে। সেই সাথে কোরবানীর অর্থনীতি সরকারের রাজস্ব ভান্ডারকেও সমৃদ্ধ করতে পারবে।