পিরানহা মাছ কতটা ভয়ংকর
পিরানহা মাছ কতটা ভয়ংকর
ভূমিকা
পিরানহা নামটি শুনলেই কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। ছোট অথচ ভয়ংকর এই মাছগুলো দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে ঘেরা নদী-নালায় বাস করে। বিশেষ করে আমাজন নদী এদের সবচেয়ে বড় বাসস্থান। পিরানহা নামটি এসেছে স্থানীয় আদিবাসী ভাষা থেকে, যার মানে দাঁড়ায় “দাঁতালো মাছ”। আর সত্যি বলতে, দাঁত আর কামড় দেওয়ার ক্ষমতার দিক থেকে পিরানহা পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর মাছ।তবে পিরানহাদের নিয়ে যে ভয়াবহ সব গল্প আমরা শুনি, তার সবই একেবারে পুরোপুরি সত্যি নয়।
শারীরিক গঠন ও আচরণ
পিরানহা মাছ সাধারণত ছোট আকারের হয়, যাদের দৈর্ঘ্য ১৪ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এদের শরীর চ্যাপ্টা এবং শক্তিশালী পেশীযুক্ত। এদের রঙ সাধারণত রুপালি, লাল বা কালো হযয়ে থাকে। তবে পিরানহার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো তাদের তীক্ষ্ণ, ত্রিকোণাকৃতির দাঁত। এ দাঁত দিয়ে পিরানহার একটি দল নিমিষেই একটি শিকারকে কঙ্কালে পরিণত করতে পারে।
পিরানহারা সাধারণত দলবদ্ধভাবে বাস করে, যাকে “শোল” বলা হয়। কখনও কখনও ২০-৩০টা মাছ একসঙ্গে থাকে। এরা শিকার দেখার পর, পুরো দল একযোগে আক্রমণ করে। এই দলবদ্ধ আচরণ তাদের শিকার ধরতে এবং নিজেদের রক্ষা করতে সহায়তা করে।
পিরানহা মাছ প্রধানত মাংসাশী, তবে কিছু প্রজাতি সর্বভুক। এরা মূলত ছোট মাছ, পোকামাকড়, ক্রাস্টেসিয়ান এবং মৃত প্রাণীর দেহ খায়। কিছু প্রজাতি গাছপালা এবং ফলমূলও খায়। পিরানহার খাদ্যাভাস পরিবেশের খাদ্যশৃঙ্খলের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা মৃত প্রাণী এবং দুর্বল মাছ খেয়ে নদীর পরিবেশ পরিষ্কার রাখে। যখন নদীতে খাবার কমে যায়, তখন নিজের প্রজাতির দুর্বল সঙ্গীকেও কামড়ে খেয়ে ফেলতে পারে।
পিরানহাকে আক্রমণাত্মক প্রাণী হিসেবে মনে করা হলেও, এরা বেশিরভাগ সময়ই শান্ত থাকে। এরা শুধুমাত্র ক্ষুধার্ত বা হুমকির সম্মুখীন হলেই আক্রমণ করে। তবে পিরানহা মানুষকে আক্রমণ করার ঘটনা খুবই কম। সাধারণত পানিতে কেউ যদি হঠাৎ পড়ে যায় আর পিরানহার দল যদি ক্ষুধার্ত থাকে, তাহলে তারা হামলা করতে পারে। অন্যথায়, পিরানহারা সহজে মানুষের কাছে আসে না।
পিরানহা কি বিষাক্ত?
পিরানহা সম্পর্কে আরেকটি প্রচলিত ভূল ধারণা হল, এরা হয়ত বিষাক্ত মাছ। কিন্তু পিরানহা মাছ আসলে বিষাক্ত নয়। এদের শরীরে কোনো বিষাক্ত পদার্থ বা বিষ উৎপন্ন হয় না। তবে, তাদের তীক্ষ্ণ দাঁত এবং শক্তিশালী চোয়ালের কারণে এরা মানুষ বা অন্য প্রাণীর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। পিরানহার কামড় গভীর ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে, এবং ক্ষত সংক্রমিত হলে জটিলতা দেখা দিতে পারে। কিন্তু এটি বিষের কারণে নয়, বরং ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ফলে ঘটে থাকে।
আমাজন অববাহিকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে পিরানহা মাছ জনপ্রিয় খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এদের মাংস স্বাদে অন্যান্য স্বাদুপানির মাছের মতোই। তবে, পিরানহার মাংসে কাঁটা বেশি থাকে।
পিরানহা ভয়ংকর মাছ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে হলিউড সিনেমার অবদান রয়েছে। সিনেমায় পিরানহাকে এমনভাবে দেখানো হয়েছে যেন একদল পিরানহা মুহূর্তের মধ্যে গোটা মানুষটাকে কঙ্কালে পরিণত করে। কিন্তু বাস্তবে এমন ঘটনা খুবই বিরল।
এর সূত্রপাত হয়েছিল ১৯১৩ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট আমাজন সফরে গিয়েছিলেন। সেসময় স্থানীয়রা তাকে দেখানোর জন্য এক জায়গায় প্রচুর ক্ষুধার্ত পিরানহাকে আটকে রেখেছিল। সেখানেই রুজভেল্ট দেখেছিলেন কীভাবে পিরানহার দল একটা গোটা গরুকে কয়েক মিনিটে শেষ করে দেয়! এই গল্পই গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আর তখন থেকে মানুষ মনে করতে থাকে যে পিরানহা অনেক ভয়ংকর প্রাণী।
অনেক দেশেই পিরানহা চাষ এবং বিক্রি নিষিদ্ধ, কারণ এরা স্থানীয় পরিবেশের জন্য ভয়ংকর হতে পারে। বাংলাদেশেও ২০০৮ সালে পিরানহা আমদানি, বিপণন, খামার বা প্রজনন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছ। কারণ এরা আমাদের দেশের নদী-নালায় ছড়িয়ে পড়লে, দেশীয় মাছদের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গায় পিরানহার সমগ্রোত্রীয় পাকু মাছ চাষ এবং বিক্রি হতে দেখা গেছে।