ইসরায়েল যুদ্ধ বিরতি চুক্তি ভঙ্গ করল কেন
ইসরায়েল যুদ্ধ বিরতি চুক্তি ভঙ্গ করল কেন
ভূমিকা
গাজায় পনের মাস ধরে চলা ইসরায়েলি গণহত্যার পর, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যখন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে, তখন সারা পৃথিবী কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল। মনে হয়েছিল এবার হয়তো ফিলিস্তিনে রক্তপাত থামবে।
যুদ্ধবিরতির মাত্র দুই মাসের মাথায় ইসরায়েল আবারো গাজায় ভয়াবহ হামলা শুরু করেছে। যুদ্ধবিরতির এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে ইসরায়েল মূলত নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ
ইসরায়েল ও হামাস যুদ্ধবিরতি মূলত ৩টি ধাপে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। যদিও ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধ করার বিষয়ে কোন লিখিত চুক্তি করেনি। সেসময় শুধু যুক্তরাষ্ট্র, কাতার এবং মিসরের মৌখিক আশ্বাসে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর প্রথম ধাপে সফলভাবে বন্দি বিনিময় হয় এবং গাজা উপত্যকায় কিছুটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে আসে। যদিও গাজাবাসীর শান্তি বলে আর কিছু ছিল না। ডক্টরস উইথআউট বর্ডার এর তথ্য মতে, দীর্ঘ ১৫ মাসের যুদ্ধে ইসরায়েল গাজার ৭০ শতাংশ অবকাঠোমো এবং ৯২ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস করে েফলেছে। এখানে খাদ্য, পানির তীব্র সংকট এবং জ্বালানী, বিদ্যুতের মত জরুরী পরিসেবার অধিকাংশই অচল হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের সময় ইসরায়েল গাজার প্রায় শতভাগ হাসপাতাল ধ্বংস করে দিয়েছে। এমন নরকে বসবাসের মধ্যে যুদ্ধ বিরতির কারণে গাজা বাসীর উপকার শুধু এতটুকই হয়েছিল যে, তাদের মাথার উপরে বৃষ্টির মত বোমা বর্ষণ বন্ধ হয়েছিল।
কিন্তু দুই মাসের মাথায় ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে, গাজায় ফের বিমান হামলা চালায়। যার ফলে এক রাতেই নিহত হয় ৪০০ জনের বেশি মানুষ। হামলার পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলে, এই হামলা “কেবল শুরু মাত্র” এবং “হামাসের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হতে হবে।”
যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ
যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে সকল বন্দি মুক্তি, গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, এবং যুদ্ধের স্থায়ী সমাপ্তির বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছানোর আগেই আলোচনা ভেঙে যায়। ইসরায়েল বলে, হামাস আরও বন্দি মুক্তি দিতে রাজি নয় এবং তারা নতুন করে অস্ত্র সংগ্রহ করছে। অন্যদিকে হামাস বলে, ইসরায়েল নতুন নতুন চুক্তির শর্ত জুড়ে দিয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে।
আগে কথা ছিল যে, ইসরায়েল গাজা উপত্যকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করলে, হামাস সকল ইসরায়েলী বন্দীেদর মুক্তি দিবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এখনই সকল বন্দী মুক্তি দেওয়া জন্য চাপ দিচ্ছে এবং এই যুদ্ধ শেষ করার ব্যাপারেও কোন আশ্বাস দিচ্ছে না। সেই সাথে তাদের মুল লক্ষ্যই হল হামাসের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ ধ্বংস করা।
অথচ ইসরায়েল বলছে, হামাস বন্দিদের মুক্তি না দিয়ে চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তাই ইসরায়েল আবারো গাজায় হামলা শুরু করেছে। যদিও যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে যাওয়ার আগে ইসরায়েল নিজেই আলোচনায় পিছু হটে চুক্তি লঙ্ঘন করেছিল। এবং নতুন করে যেসব শর্ত দেয়, তা পুরোনো চুক্তির সঙ্গে যায় না। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব অনুযায়ী, ইসরায়েল দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা পেছাতে চেয়েছিল। কিন্তু হামাস তাতে রাজি হয়নি। ইসরায়েল তখন হামাসকে চাপ দিতে গাজায় সকল ধরনের ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ করে দেয় এবং সরাসরি হামলা শুরু করে।
হামাসের কাছে ইসরায়েলী বন্দী আটক থাকা অবস্থায়তেই ইসরায়েল গাজার ৯২ শতাংশ ধ্বংস করে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে হামাস যদি সকল বন্দী মুক্তি দেয়, তখন ইসরায়েলের আগ্রাসন কেমন হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
ইসরায়েল বলছে, আলোচনা হবে “আগুনের মধ্যে”। অর্থাৎ, তারা একদিকে গাজায় হামলা চালাবে এবং অন্যদিকে হামাসের সাথে আলোচনা করবে। হামাস বলছে, তারা পুরোনো চুক্তি অনুযায়ী আলোচনা করতে প্রস্তুত, তবে তার আগে হামলা থামাতে হবে।
গোপন রাজনৈতিক বাস্তবতা
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্যই মূলত গাজার যুদ্ধ এতটা প্রলম্বিত করেছে এবং যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে নতুন করে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে। নেতানিয়াহু তার দেশে বিশাল রাজনৈতিক সংকটে রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বহু দুর্নীতির অভিযোগ এবং নানা মুখী রাজনৈতিক চাপ যুদ্ধের মাধ্যমে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে নেতানিয়াহু।
ইসরায়েলে মূলত ৭টি কট্টর ডানপন্থী দলের জোট সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছে লিকুদ পার্টির নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। জোট সরকারের ডানপন্থী দলগুলো হামাসের সাথে যুদ্ধ বিরতির কট্টর বিরোধী। জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর রিলিজিয়াস জায়নিস্ট পার্টির প্রভাবশালী নেতা ইটামার বেন গাভির মন্ত্রী সভা থেকে পদত্যাগ করেছিল।
ক্ষমতাসীন সরকারের এই জোট যদি ভেঙে যায় তাহলে ইসরায়েলে আবার নতুন করে নির্বাচন হবে। ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে রয়েছে, তাই নতুন করে নির্বাচন হলে নেতানিয়াহুর ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।
গাজায় নতুন করে যুদ্ধ শুরুর পর, বেনগাভির আবারো মন্ত্রী সভায় ফিরে এসেছে। তারমানে রাজনৈতিক চাপ মেকাবেলা ও জোটের শরীকদের খুশি রাখতেই মূলত নেতানিয়াহু নতুন করে যুদ্ধ শুরু করেছে।
তাছাড়া অতি সম্প্রতি, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা আঁচ করতে না পারার দায়ে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেটের প্রধান রোনেন বারকে বরখাস্ত করা হয়েছে। গাজা যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূূর্ণ ভূমিকা পালন করা এই কর্মকর্তাকে বহিষ্কারের পেছনে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। কারণ শিনবেটের সাবেক প্রধান নেতানিয়াহুর বহু কুকর্মের সাক্ষী।
বন্দীদের উদ্ধার না করেই নতুন করে গাজায় যুদ্ধ শুরু এবং গোয়েন্দা প্রধানকে বহিষ্কারের ঘটনায় ইসরায়েলজুড়ে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।
যুদ্ধের প্রস্তুতি
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গাজায় যুদ্ধবিরতির পুরো বিষয়টিই ছিল একটি সাজানো নাটক। ইসরায়েল যে আবারো নতুন করে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে এটা তাদের পূর্ব পরিকল্পনাতেই ছিল। ইসরায়েলের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকে জানত যে ইসরায়েল আবার হামলা শুরু করবে।
কারণ যুদ্ধবিরতির এই সময়টাকে ইসরায়েল কাজে লাগিয়েছে নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য। দীর্ঘ ১৫ মাস একটানা যুদ্ধ করে ইসরায়েলের সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই যুদ্ধবিরতিটা গাজাবাসীর স্বস্তির জন্য নয়, বরং ইসরায়েলকে নতুন উদ্যোমে যুদ্ধ করার শক্তি যোগানোর জন্য দেওয়া হয়েছিল।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণা হবার পর ইসরায়েল তার সামরিক বাহিনীকে গাজা সীমান্তে রেখেছিল ঠিকই, তবে প্রথম সারির সৈন্যদেরকে ধাপে ধাপে সরিয়ে নেওয়া হয় বিশ্রামে, যাতে তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করতে পারে।
ইসরায়েলের বিমানঘাঁটিগুলোতে যুদ্ধবিরতির সময় যুদ্ধবিমানগুলোর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। প্রতিটি বিমানের ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ পাল্টানো হয়েছে এবং নতুন অস্ত্র সংযোজনের প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা ও রকেটও সরবরাহ করা হয়, যা যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বে ব্যবহৃত হবে। যুদ্ধবিরতির দুই মাসের মধ্যেই ইসরায়েল বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসস্ত্র আমদানি ও মজুদ করেছে। যুদ্ধবিরতির সময় ড্রোন ঘাঁটিগুলোতেও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালানো হয়েছে। এবং নতুন প্রজন্মের AI-চালিত সশস্ত্র ড্রোন প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যেগুলো গাজায় মোতায়েন করা হবে।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জানান, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করেই হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, হামলার জন্য হামাসই দায়ী এবং যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের এই সমর্থন ইসরায়েলকে আরও আগ্রাসী করে তুলবে। শুধু এবারই না, অতীতে যতবার যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে, প্রত্যেকবারই ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছে।
সত্যিকার অর্থে এই যুদ্ধ এখন আর শুধু বোমা আর গুলির নয়। এটা সত্য আর মিথ্যার লড়াই। যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েল বিশ্ববাসীকে দেখাচ্ছে কিভাবে মিথ্যা তথ্য আর মিডিয়ার মাধ্যমে একটি নির্মম হত্যাযজ্ঞকে “আত্মরক্ষার লড়াই” বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। যেখানে আক্রমণকারীরা নিষ্পাপ আর জুুলুমের শিকার ব্যক্তিরা অপরাধী।