ক্যাভিয়ার বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার

maxresdefault
খাবার

ক্যাভিয়ার বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার

ভূমিকা

বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার সম্পর্কে আলোচনা করলেই সবার আগে উঠে আসবে ক্যাভিয়ারের নাম। ক্যাভিয়ার মূলত স্টার্জন মাছের ডিম। এটি এক সময় সাধারণ মানুষের খাবার থাকলেও, সময়ের সাথে সাথে ক্যাভিয়ার বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল ও দামি খাদ্যে পরিণত হয়েছে। মাত্র এক কেজি ক্যাভিয়ারের দাম প্রায় ২৫ লাখ টাকারও বেশি হতে পারে।

ক্যাভিয়ারের বিশেষত্ব শুধু এর স্বাদে নয়, বরং এর দুষ্প্রাপ্যতা, প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি এবং ঐতিহাসিক মর্যাদার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। ক্যাভিয়ার একসময় রাশিয়ার জার বা ইউরোপের রাজপরিবারের প্রিয় খাদ্য ছিল। বর্তমান সময়েও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিশ্বের ধনী ও রুচিশীল ব্যক্তিরা তাদের খাদ্য তালিকায় ক্যাভিয়ার যোগ করেন।

ক্যাভিয়ারের ইতিহাস

ক্যাভিয়ারের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। এই খাবারটি প্রথম জনপ্রিয় হয় পারস্য অঞ্চলে। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালেরও আগে পারস্য সাম্রাজ্যের রাজারা স্টার্জন মাছের ডিম খেতেন, এবং তারা বিশ্বাস করতেন এই খাবার শক্তি ও সহনশীলতা বাড়ায়। এমনকি “কাবিয়ার” নামটি এসেছে পারসিয়ান শব্দ “khav-yar” থেকে, যার অর্থ ‘জীবনের শক্তি’।

মধ্যযুগে রাশিয়া এবং পরবর্তীতে ইউরোপের রাজ পরিবারে ক্যাভিয়ার অত্যন্ত মূল্যবান খাবারে পরিণত হয়। রাশিয়ার জাররা তাদের শাসনামলে এটিকে রাজকীয় ভোজের অপরিহার্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন। তখনকার সময় রাশিয়া ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্যাভিয়ার উৎপাদক দেশ।

১৮০০ সালের দিকে ক্যাভিয়ার পশ্চিম ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং ধনী পরিবার ও রাজন্যবর্গের ডাইনিং টেবিলে জায়গা করে নেয়। তবে মজার বিষয় হলো, ১৯০০ সালের শুরুর দিকে আমেরিকায় ক্যাভিয়ার এতটাই সহজলভ্য ছিল যে, এটি বিভিন্ন বারে ফ্রি স্ন্যাকস হিসেবে দেওয়া হতো।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্টার্জন মাছের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে এবং ক্যাভিয়ারের প্রাপ্যতা কমে যায়। এর ফলে ক্যাভিয়ারের দাম বেড়ে যেতে থাকে এবং এটি হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল খাবারগুলোর একটি। বর্তমানে ক্যাভিয়ার শুধু একটি খাবার নয়, এটি এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’।

স্টার্জন মাছের ডিম

বিশ্বের অন্য যেকোন ব্যয়বহুল খাবার একাধিক মূল্যবান উপাদানের সংমিশ্রণে তৈরী হলেও, ক্যাভিয়ারের মূল উপাদান মূলত একটিই; আর তা হলো স্টার্জন মাছের ডিম। এই ডিমগুলো ছোট, গোলাকার, চকচকে এবং মুখে দিলে এক বিশেষ রকমের নরম বিস্ফোরণের অনুভূতি হয়। ক্যাভিয়ার উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি একইসাথে অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ, জটিল ও সংবেদনশীল। স্টার্জন মাছের জীবনের গুণগত মান ঠিক রেখে, দীর্ঘ ১০ থেকে ২০ বছর সঠিক উপায়ে পরিচর্যার পর ক্যাভিয়ার পাওয়া যায়।

স্টার্জন এমনিতেই অত্যন্ত বিরল প্রজাতির মাছ। এই মাছগুলো সাধারণত কাস্পিয়ান সাগর, কৃষ্ণ সাগর, রাশিয়া ও ইরান অঞ্চলে পাওয়া যায়। তবে বর্তমান সময়ে বিভিন্ন দেশের ফিশ ফার্মে কৃত্রিমভাবেই মূলত এই মাছ চাষ করা হয়।

ক্যাভিয়ার উৎপাদনের একটি খামারে একদম ছোট অবস্থা থেকে স্টার্জন মাছের পরিচর্যা করা হয়। মাছগুলো পরিপক্ব হওয়ার পর, আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে, মাছের পেটের ভিতরে থাকা ডিম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়। একদম সঠিক সময় না হলে, মাছের পেট থেকে ডিম বের করা হয় না। কারণ ডিমের আকার ঠিকঠাক না হলে ক্যাভিয়ারের মান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

মূলত দুইভাবে ডিম সংগ্রহ করা হয়: ১. Traditional method বা পুরনো পদ্ধতি এবং ২. Modern method বা নতুন ও টেকসই পদ্ধতি। পুরনো পদ্ধতিতে মাছটিকে জবাই করে তার ডিম বের করা হয়। এই পদ্ধতি খুব সাধারণ, কিন্তু এতে একটি মাছ থেকে একবারই ডিম নেওয়া সম্ভব হয়। অন্যদিকে  নতুন টেকসই পদ্ধতিতে মাছের “Cesarean section” বা “stripping method” ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে মাছের পেটের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় ফুটো করে, তার পেট থেকে ডিম সংগ্রহ করা হয় এবং ডিম সংগ্রহ শেষে আবারো মাছের পেট সেলাই করে তাকে খামারে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে এক মাছ থেকে বারবার ডিম পাওয়া যায়।

ক্যাভিয়ার উৎপাদন

স্টার্জন মাছের ডিম সংগ্রহের পর শুরু হয় ক্যাভিয়ার উৎপাদনের জটিল প্রক্রিয়া। দীর্ঘ ১০/১৫ বছর কঠোর পরিচর্যার মাধ্যমে ডিম উৎপাদন করা হলেও, সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত না করলে ক্যাভিয়ার সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

ডিম সংগ্রহের পর সেগুলো খুব নরম ও স্পর্শকাতর অবস্থায় থাকে। তাৎক্ষণিকভাবে ডিমগুলো ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে নেওয়া হয়, যাতে কোনও রক্ত বা অপ্রয়োজনীয় অংশ না থাকে। এরপর এগুলোকে আকার, রং, ঘনত্ব এবং গন্ধের ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়।

ক্যাভিয়ার উৎপাদনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ হল মাছের ডিমের সাথে লবণ যোগ করা। এসব ডিমে অল্প পরিমাণ লবণ দেওয়া হয়, যাকে বলে “malossol” পদ্ধতি। এটি ডিমকে সংরক্ষণযোগ্য করে এবং স্বাদ বাড়ায়। খুব কম বা বেশি লবণ দিলে ডিম দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে; তাই পরিমাণটা নিখুঁত হওয়া জরুরি। পর্যাপ্ত লবণ মেখে ডিমগুলোকে প্রস্তুত করার পর, সর্বশেষ ধাপ হিসেবে ক্যাভিয়ারকে কাঁচের জারে বা ধাতব কৌটায় সংরক্ষণ করে বাজারে পাঠানো হয়। উচ্চমানের ক্যাভিয়ার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্বর্ণের কৌটা ব্যবহারেরও প্রচলন রয়েছে।

ক্যাভিয়ারের দাম এত বেশি কেন

ক্যাভিয়ারের মধ্যে সবচেয়ে দামি হল ‘আলমাস’ ক্যাভিয়ার, যা বিরল প্রজাতির ইরানি বেলুগা স্টার্জন মাছ থেকে পাওয়া যায়। এগুলো স্বর্ণের কৌটায় প্যাকেজ করা হয় এবং এর এক কেজির দাম প্রায় ২৫-৩০ লাখ টাকা।

আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে যে, মাছের ডিমের দাম এত লাখ লাখ টাকা হবার কারণ কী? এর প্রধান কারণই হল স্টার্জন মাছ অত্যন্ত ধীর গতিতে বড় হয়। এবং ডিম দেওয়ার বয়সের পৌছাতে ১০ থেকে ২০ বছর সময় লাগে। আধুনিক পদ্ধতিেত একটি ক্যাভিয়ার থেকে একাধিকাবার ডিম সংগ্রহ করা হলেও। মাছগুলো একবার ডিম দেওয়ার পর দ্বিতীয়বার ডিম দিতেও কয়েক বছর সময় লেগে যায়। এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় বলে, উৎপাদন হার অনেক কম।

স্টার্জন মাছ প্রাকৃতিকভাবে শুধু কাস্পিয়ান সাগর বা কৃষ্ণ সাগরের মত নির্দিষ্ট কিছু নদী বা সাগরে পাওয়া যায়। এই মাছ ধরার অনুমতি পেতে সরকারী নানা নিয়ম মানতে হয়। অতিরিক্ত শিকারের কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়ে স্টার্জন মাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। বর্তমান সময়ে উৎপাদিত ক্যাভিয়ারের অধিকাংশই আসে কৃত্রিমভাবে চাষ করা স্টার্জন মাছ থেকে। কিন্তু খামারে স্টার্জন মাছ চাষ করাও অত্যন্ত কঠিন। মাছগুলোকে অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের মধ্যে লালন পালন করতে হয়। এদের পরিচর্যায় সামান্য ঘাটতি হলেই, কাঙ্খিত মানের ক্যাভিয়ার পাওয়া যায় না।

তাছাড়া স্টার্জন মাছের ডিম সংগ্রহ করাও খুব স্পর্শকাতর কাজ। এসব মাছের পেট থেকে খুব সাবধানে ডিম বের করা হয়, কারণ সামান্য ভুল হলেই পুরো ব্যাচ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সবসময় মাছটিকে সঠিক বয়স, স্বাস্থ্য ও সময় অনুযায়ী প্রস্তুত করতে হয়, যেটা অনেক দক্ষতা ও সেরা প্রযুক্তির ব্যাপার। বর্তমান সময়ে চীনে বেশ কিছু খামার অত্যন্ত উন্নতি প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্টার্জন মাছ থেকে অল্প সময়ে ক্যাভিয়ার উৎপাদনের পদ্ধতি প্রয়োগ করছে। কিন্তু এসব চীনা খামারেও ১০ বছরের আগে ক্যাভিয়ার উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।

ডিম সংগ্রহ করার পর পরিষ্কার করা, লবণ দেওয়া, সংরক্ষণ এবং প্যাকেজিং—সবকিছু একদম নিখুঁতভাবে করতে হয়। কারণ ক্যাভিয়ার খুব স্পর্শকাতর খাবার, এগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর এর স্বাদ ও গুণমান ঠিক রাখতেও দরকার হয় বিশেষ পদ্ধতি ও অভিজ্ঞ লোকবল। তাছাড়া উচ্চমানের ক্যাভিয়ার খুব ঠান্ডা তাপমাত্রায় রাখতে হয়। সেই সাথে এগুলো পরিবহনের জন্যও বিশেষ শর্ত মানতে হয়।

বিশ্বের অনেক ধনী ব্যক্তি, বিলাসবহুল হোটেল এবং ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টে ক্যাভিয়ারের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এর দুষ্পাপ্রতার কারণেই মূলত, চাহিদা থাকা সত্তেও ক্যাভিয়ারের সরবরাহ অনেক কম। সবকিছু মিলিয়ে স্টার্জন মাছের দুষ্প্রাপ্যতা, জটিল লালন পালন পদ্ধতি এবং ডিম সংগ্রহের স্পর্শকাতর প্রক্রিয়ার কারণে ক্যাভিয়ার বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবারে পরিণত হয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার ক্যাভিয়ার !

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।