ইন্টারপোলের কাজ কি

maxresdefault (3)
কি কেন কিভাবে

ইন্টারপোলের কাজ কি

      ভূমিকা

পৃথিবীর প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব পুলিশ বাহিনী আছে, যারা দেশের ভেতরে অপরাধীদের ধরতে কাজ করে। কিন্তু কোনো অপরাধী যদি এক দেশ থেকে পালিয়ে অন্য দেশে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে, তখন কী হবে? তখন প্রয়োজন পড়ে এমন এক আন্তর্জাতিক পুলিশের, যারা দেশের সীমানার বাইরে গিয়েও অপরাধীদের খুঁজে বের করতে পারে। এই দায়িত্বই পালন করে ইন্টারপোল। বিশ্বের সব দেশের পুলিশের মধ্যে যেন তথ্য বিনিময় সহজ হয়, অপরাধ দমন ও প্রতিরোধে যেন একে অপরকে সহযোগিতা করা যায়, সেই লক্ষ্যেই ইন্টারপোল গড়ে তোলা হয়েছে।

ইন্টারপোলের ইতিহাস

ইন্টারপোলের ইতিহাস প্রায় একশ বছরের পুরনো। ১৯ শতকের শেষ দিকে ইউরোপজুড়ে অপরাধ বাড়তে থাকে এবং অনেক অপরাধী সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। তখনই বোঝা যায়, এক দেশের পুলিশ একা এই ধরনের আন্তর্জাতিক অপরাধ রুখতে পারবে না। বিশ্ব জুড়ে অপরাধ দমন ও অপরাধীদের শনাক্তকরণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা থেকেই একটি যৌথ আন্তর্জাতিক পুলিশের পরিকল্পনা আসে।

১৯১৪ সালে মোনাকোতে প্রথমবারের মতো International Criminal Police Congress নামে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২৪টি দেশের পুলিশ কর্মকর্তা অংশ নেন এবং আন্তর্জাতিকভাবে পুলিশের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়।

তবে প্রকৃত ইন্টারপোল প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৩ সালে, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে।
সেই সময় এর নাম ছিল International Criminal Police Commission বা ICPC।
এটি প্রতিষ্ঠা করেন Johann Schober, তিনি অস্ট্রিয়ার তৎকালীন পুলিশ প্রধান ও পরবর্তীতে চ্যান্সেলর ছিলেন।

১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, সংস্থাটি পুনর্গঠিত হয়। কারণ নাৎসি জার্মানির সময় এটিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। এরপর ১৯৫৬ সালে, এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় INTERPOL – যা ইংরেজি “International Criminal Police Organization”-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। সেই সময় থেকেই ইন্টারপোল পুরোপুরি নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক একটি সংস্থা হিসেবে কাজ করতে শুরু করে।

বর্তমানে ইন্টারপোল

বর্তমানে ইন্টারপোলের সদস্য দেশের সংখ্যা ১৯৫। এটি জাতিসংঘের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংস্থা। সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় রয়েছে ফ্রান্সের লিওন শহরে। বিশ্বব্যাপী অপরাধীদের দমনে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দপ্তরও ১৯৮৬ সালে বোমা হামলার শিকার হয়েছিল। তারপর ১৯৮৯ সালে ইন্টারপোল ফ্রান্সের লিওনে তাদের সদর দপ্তর স্থানান্তর করে। বর্তমানে ইন্টারপোলের সদর দপ্তর প্রযুক্তিগতভাবে বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ ভবন গুলোর একটি।

ইন্টারপোলের নিজস্ব পুলিশ বা বাহিনী নেই, তবে তারা তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে সদস্য দেশগুলোর পুলিশদের সহায়তা করে। তবে ইন্টারপোল এখন আর শুধুই একটি সমন্বয়কারী সংগঠন নয়। এটি একটি পরিপূর্ণ, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর, বহুস্তরবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। এই সংস্থাটি খুব সুসংগঠিতভাবে কাজ করে, যাতে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে বিভিন্ন দেশের পুলিশের মধ্যে সহযোগিতা নিশ্চিত করা যায়।

ফ্রান্সের লিওন শহরে ইন্টারপোলের মূল সদরদপ্তর ছাড়াও বিশ্বব্যাপী তাদের আরো বেশকিছু কার্যালয় রয়েছে। সিঙ্গাপুরে ইন্টারপোলের রয়েছে গ্লোবাল ইনোভেশন কমপ্লেক্স। এটি মূলত সাইবার ক্রাইম ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ে কাজ করে। এছাড়া পুরো বিশ্বের পুলিশ বাহিনীকে রিয়েল-টাইম তথ্য ও সমন্বয় সেবা দেওয়ার জন্য ইন্টারপোলের রয়েছে গ্লোবাল কমান্ড সেন্টার। এই অংশটি ২৪ ঘন্টা সক্রিয় থাকে। এর বাইরেও আর্জেন্টিনা, কেনিয়া, ক্যামেরুন সহ আরও কয়েকটি অঞ্চলে  ইন্টারপোলের সাপোর্ট সেন্টার রয়েছে।

বর্তমানে যেহেতু ১৯৫ টি দেশ অর্থাৎ পুরো বিশ্বই ইন্টারপোলের সদস্য, তাই প্রতিটি দেশেই এই সংস্থাটির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রত্যেক সদস্য দেশেই একটি করে “National Central Bureau” বা NCB থাকে, যেটি সেই দেশের পুলিশ এবং ইন্টারপোলের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। বাংলাদেশেও একটি ইন্টারপোল NCB আছে, যা বাংলাদেশ পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট বা CID এর অধীনে পরিচালিত হয়।

ইন্টারপোলের রয়েছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ডেটাবেস। এই ডাটাবেসে থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভান্ডারগুলো হল: ১. নিখোঁজ ব্যক্তি ও আন্তর্জাতিক অপরাধীর তালিকা ২. চুরি হওয়া গাড়ির তথ্য ৩. জাল পাসপোর্ট ও ভিসার তথ্য এবং ৪. সন্ত্রাসবাদ ও অস্ত্র চোরাচালানের তথ্য। এই ডেটাবেসগুলো ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে এবং সদস্য দেশের পুলিশ বাহিনী যেকোনো সময় প্রবেশ করতে পারে।

ইন্টারপোল কিভাবে কাজ করে

ইন্টারপোল বিভিন্ন স্তরের অপরাধীদের ধরতে বিভিন্ন রঙের নোটিশের মাধ্যমে সতর্কতা জারি করে। এগুলো মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো “Red Notice”। কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই রেড নোটিশ জারির মানে হল, সমগ্র বিশ্বে তাকে যেখানেই দেখা যাবে, সেখানেই গ্রেফতার করতে হবে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৬৫ হাজারেরও বেশি ব্যক্তির নামে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে।

রেড নোটিশ ছাড়াও ইন্টারপোলের আরো বেশ কিছু রঙের নোটিশ রয়েছে। যেমন: Blue Notice মানে হলে এই  ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, Green Notice মানে হল, এই ব্যক্তিকে সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে সতর্ক বার্তা জারি করা হল। এছাড়া কোন নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে পেতে সহায়তার জন্য Yellow Notice জারি করা হয়। এবং অজ্ঞাত পরিচয়ের মৃতদেহ চিহ্নিত করতে সাহায্য ইন্টারপোল Black Notice জারি করে। এগুলোর বাইরেও আরো দু ধরনের নোটিশ রয়েছে। একটি হল Purple Notice যার মাধ্যমে অপরাধীরা নতুন কৌশলে বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ করলে, তা অন্য দেশগুলোকে জানানো হয়। এবং আরেকটি হল Orange Notice, এটি কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য, বিপজ্জনক চিঠি বা প্রাণঘাতী উপকরণ সম্পর্কে সতর্ক করতে ব্যবহৃত হয়।

ইন্টারপোল নিজে কোনো গ্রেফতার বা তদন্ত চালাতে পারে না। তারা শুধুমাত্র তথ্য সরবরাহ ও সমন্বয় করে। এছাড়া সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও পেশাদার থাকার জন্য সংস্থাটি কোনো রাজনৈতিক, সামরিক, ধর্মীয় বা জাতিগত বিষয় নিয়ে কাজ করে না। যদিও অতীতে বেশ কিছু দেশের স্বৈরশাসকের দ্বারা ইন্টারপোলের সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

তাছাড়া ভিন্ন ভিন্ন কারণে ইন্টারপোল বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধার সম্মুখীন হয়। অনেক সময় Red Notice জারির পরও অপরাধী অন্য নামে অন্য দেশে বসবাস করতে থাকে। অনেক দেশ রাজনৈতিক কারণে অভিযুক্ত অপরাধীদের ফেরত পাঠায় না।

ইন্টারপোলের সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে প্রতি বছর General Assembly বসে। যেখানে সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই সভায় নতুন সদস্য নেয়া, বাজেট অনুমোদন, নতুন প্রকল্প গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়।

বাংলাদেশে ইন্টারপোল

১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ইন্টারপোলের সদস্য পদ গ্রহণ করে। ইন্টারপোলের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (NCB) প্রতিটি সদস্য দেশে থাকে, এবং বাংলাদেশেও এই NCB রয়েছে। বাংলাদেশে ইন্টারপোলের কাজ বাংলাদেশ পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট CID এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। CID-এর অধীনে থাকা এই আলাদা ইউনিট NCB Dhaka বা National Central Bureau – Dhaka নামে কাজ করে থাকে।

এটি হলো ইন্টারপোলের বাংলাদেশের একমাত্র অফিসিয়াল প্রতিনিধি সংস্থা। এখান থেকেই আন্তর্জাতিক অপরাধী শনাক্ত, রেড নোটিশ প্রেরণ, এবং বিদেশ থেকে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার কাজগুলো পরিচালিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: মনে করুন এক লোক ব্যাংক জালিয়াতি করে ১০০ কোটি টাকা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে দুবাই চলে গেল। বাংলাদেশের CID সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে এবং আদালতের নির্দেশে ইন্টারপোলের NCB Dhaka একটি Red Notice জারি করে। এই Red Notice এর ভিত্তিতে দুবাইয়ের পুলিশ সেই ব্যক্তিকে আটক করতে পারে। এরপর কূটনৈতিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়।

এখনও পর্যন্ত ৬২ জন বাংলাদেশীর নামে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে। এদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলা, যুদ্ধাপরাধ মামলা, ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সাজা প্রাপ্ত পলাতক আসামীদের নাম রয়েছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের বেশ কিছু গণমাধ্যম পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নামেও ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি হয়েছে বলে খবর প্রচার করে। কিন্তু ইন্টারপোলের অফিশিয়াল রেড নোটিশের তালিকায় শেখ হাসিনার নাম পাওয়া যায়নি।

ইন্টারপোল এর কাজ কী ?

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।