ইস্টার সানডে

maxresdefault (2)
জীবনযাপন

ইস্টার সানডে

ভূমিকা

খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলোর একটি হল ইস্টার সানডে। এই দিনটি মূলত যীশু খ্রিষ্টের পুনরুত্থান বা পুনর্জীবনের স্মরণে পালিত হয়। খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করে, যীশু খ্রিষ্টকে তার শক্ররা ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার তিন দিন পর তিনি পুনরুজ্জীবিত হয়েছিলেন। সেই ঘটনাটি ঘটেছিল রবিবারে, যা পরবর্তীতে শুধু ইস্টার বা ‘ইস্টার সানডে’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই দিনটির তারিখ প্রতিবার এক থাকে না। বসন্ত পূর্ণিমার পরে প্রথম রবিবার ইস্টার পালিত হয়। এজন্য প্রতি বছর মার্চের শেষ বা এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ইস্টার সানডে হয়।

খ্রিস্টান উৎসব

খ্রিস্টান ধর্মে অনেক ধর্মীয় দিবস থাকলেও, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল উৎসব মূলত তিনটি। ১. ক্রিসমাস (Christmas) ২. ইস্টার (Easter) এবং ৩. পেন্টেকোস্ট (Pentecost)। আমরা সবাই জানি, ক্রিসমাস যীশু খ্রিষ্টের জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়। ইস্টার মূলত যীশু খ্রিষ্টের পুনরুত্থানের দিবস হিসেবে পালিত হয়। এবং ইস্টারের ৫০ দিন পর পালন করা হয় পেন্টেকোস্ট। খ্রিষ্টানরা মনে করে পেন্টেকোস্টের দিন যীশুর শিষ্যদের ওপর Holy Spirit বা পবিত্র আত্মা  নেমে এসেছিল। এই দিনটিকে খ্রিষ্টান চার্চের জন্মদিন হিসেবেও ধরা হয়।

এই তিনটি উৎসব ছাড়াও Good Friday, Palm Sunday, Ash Wednesday, Lent, Advent, ইত্যাদি উপলক্ষ খ্রিষ্টানরা পালন করে থাকে। তবে প্রথম তিনটি উৎসবই খ্রিষ্টান ধর্মের মূল ও কেন্দ্রীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত।

যদিও বর্তমানে খ্রিষ্টান ধর্মের মূল উৎসব হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ক্রিসমাসের সাথে ধর্মীয় যোগসূত্র খুব কমই রয়েছে। মূলত ১৮শ ও ১৯শ শতাব্দীর ইউরোপ ও আমেরিকায় ক্রিসমাসের উৎসবটি বাণিজ্যিক রূপ নিতে শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায়, ক্রিসমাস এখন পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। ফলে অনেক খ্রিষ্টান নেতাই এখন বলতে শুরু করেছেন: “We must bring Christ back into Christmas.” তারমানে – ক্রিসমাসে অবশ্যই যিশু খ্রিষ্টকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাই অনেক খ্রিষ্টান ধর্মগুরুই মনে করেন, ধর্মীয় মূল্যবোধের জায়গা থেকে বর্তমান সময়ে খ্রিস্টান ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল ইস্টার।

যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণ

খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচিলিত ইতিহাস মতে, যীশু খ্রিষ্টের জীবদ্দশায়, সমগ্র জুডিয়া অঞ্চল ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। সেই ঐতিহাসিক জুুডিয়া হল বর্তমান বৃহত্তর ফিলিস্তিন অঞ্চল, যা পরবর্তীতে ইসরায়েল দখল করে নিয়েছে।

যীশু খ্রিষ্ট যখন সত্য ও ন্যায়ের কথা প্রচার করতে শুরু করেন, তখন তৎকালীন সানহেড্রিন নামে পরিচিত ইহুদি ধর্মের নেতারা যীশুর জনপ্রিয়তা ও শিক্ষাকে তাদের জন্য হুমকি মনে করতে শুরু করে। তৎকালীন ইহুদি ধর্মের নেতারও বুঝতে পারে যে, যিশু যা বলছে তা সঠিক। কিন্তু তারা যদি যিশুর কথা মেনে নেয়, তাহলে সমাজের উপর তাদের আর কোন কর্তৃত্ব থাকে না। তাই তারা যিশুকে মেরা ফেলার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কিন্তু ইহুদি সানহেড্রিনদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না, সে সময়ে এই ক্ষমতা ছিল একমাত্র রোমান শাসকের হাতে।

তৎকালীন সময়ে জুডিয়ার রোমান গভর্নর ছিলেন পন্টিয়াস পিলাত (Pontius Pilate)। ইহুদি ধর্মের নেতারা যীশুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ তুলে পিলাতের কাছে নিয়ে যান। পিলাত বুঝতে পারেন যে, যীশু আসলে নির্দোষ। কিন্তু জনতার চাপে ও রাজনৈতিক জটিলতা এড়াতে, পন্টিয়াস পিলাত শেষ পর্যন্ত যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার আদেশ দেয়। এরপর রোমান সৈন্যরা ক্রুশবিদ্ধ করার কাজটি বাস্তবায়ন করে।

ক্রুশ বিদ্ধ করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করাটা রোমানদের প্রথাগত শাস্তি ছিল। শুধুমাত্র ভয়ংকর অপরাধীদেরকেই মৃত্যুর আগে দীর্ঘ যন্ত্রনা দিয়ে এবং জনসম্মুখে অপমান করে সবশেষে ক্রুশবিদ্ধ করা হত।

খ্রিষ্টানদের মতে, যিশু খ্রিষ্টকে ক্রুশ বিদ্ধ করার পেছনে মূলত দুটি কারণ ছিল, একটি হল তৎকালীন ইহুদি ধর্মীয় নেতাদের ঈর্ষা ও ষড়যন্ত্র এবং দ্বিতীয়ত রোমান শাসকদের ক্ষমতা রক্ষার রাজনৈতিক লড়াই।

ইস্টার সানডে

বাইবেলের মতে, যীশু খ্রিষ্ট শুক্রবার ক্রুশবিদ্ধ হন। সেই শুক্রবার Good Friday নামে পরিচিত। এবং তার তিন দিন পর, অর্থাৎ রবিবারে তিনি পুনরায় জীবিত হন। সেই রবিবার ইস্টার সানডে নামে পরিচিত।

যিশু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যাবার পর, তার দেহ নামিয়ে এনে মোম ও সুগন্ধি দিয়ে মোড়ানো হয়। এরপর তাঁর একজন ধনী অনুসারীর দান করা একটি পাথরের কবর বা সমাধিতে তাকে শায়িত করা হয়। এই কবরটি ছিল এক পাহাড়ের গায়ে খোঁদাই করা গুহার মতো এবং বড় একটি পাথর দিয়ে এর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বিশৃঙ্খলা এড়াতে রোমান সৈন্যরা সেই সমাধির সামনে পাহাড়ায় ছিল।

ইস্টার সানডের সকালে যিশুর কিছু নারী অনুসারী যিশুর সামধিতে তাকে দেখতে যান। তারা গিয়ে দেখে সমাধির মুখে থাকা পাথরটি সরানো এবং ভেতরে যিশুর দেহটি নেই। এরপর যিশু নিজেই তাঁর শিষ্যদের সামনে হাজির হন, তাদের সাথে হাঁটেন, কথা বলেন, এমনকি খাবার খান।
কেউ কেউ প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি, কিন্তু যিশু তাঁর হাতে ও পায়ে ক্রুশের দাগ দেখিয়ে সবাইকে বোঝান যে তিনি সত্যিই পুনরুত্থিত হয়েছেন। এই ঘটনার মাধ্যমে খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করেন, যীশু মৃত্যুকে পরাজিত করেছেন। খ্রিষ্টান বিশ্বাস অনুযায়ী, যীশু মানুষের পাপমোচনের জন্য পুনরুত্থিত হয়েছিলেন। এবং খ্রিষ্টান মতে ইস্টার সানডের প্রমাণ করে যে যীশু চিরন্তন জীবনের প্রতীক।

ইসলাম ধর্মে যিশু

খ্রিষ্টান ধর্মের কেন্দ্রীয় পুরুষ যিশু খ্রিষ্ট, ইসলাম ধর্মে হযরত ঈসা (আ) হিসেবে পরিচিত। তিনি ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত একজন সম্মানিত নবী। পবিত্র কুরআনে ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর চেয়েও বেশি বার হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাই পবিত্র কুরআন থেকেও যিশু খ্রিষ্ট বা ঈসা (আ) এর জীবন ও মৃত্যু সংক্রান্ত বিষয়ে জানা যায়।

ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, ঈসা (আঃ) কে কখনোই হত্যা বা ক্রুশবিদ্ধ করা হয়নি। পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ১৫৭-১৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে –

“আর ‘আমরা আল্লাহর রসূল মাসীহ ঈসা ইবনু মারইয়ামকে হত্যা করেছি’ তাদের এ উক্তির জন্য। কিন্তু তারা না তাকে হত্যা করেছে, না তাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে, কেবলমাত্র তাদের জন্য (এক লোককে) তার সদৃশ করা হয়েছিল, আর যারা এ বিষয়ে মতভেদ করেছিল তারাও এ সম্পর্কে সন্দেহে পতিত হয়েছিল। শুধু অমূলক ধারণার অনুসরণ ছাড়া এ ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। এটা নিশ্চিত সত্য যে, তারা তাকে হত্যা করেনি।”

এই আয়াতের বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, কোথাও বলা হয়েছে যে, ঈসা (আ) এর একজন অনুসারীকে তার মত চেহারা করে দেওয়া হয়েছিল; অথবা ইহুদিরা ইসা (আ) কে হত্যা করার জন্য যে লোককে প্রেরণ করেছিল, তার চেহারাই ঈসা (আ) এর মত হয়ে যায়। ফলে উপস্থিত লোকদের মধ্যেই চরম মতভেদ ও বিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। তাই কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে যে, যারা ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে নানা মত পোষন করে নিশ্চয় এ ব্যাপারে তারা সন্দেহে পতিত হয়েছে। পরবর্তীতে রোমানরা সেই নকল ব্যক্তিকেই শুলে চড়িয়ে হত্য করে।

ইসলামী মতে, ঈসা (আঃ) কে আল্লাহ জীবিত অবস্থায় আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি জীবিত অবস্থায় আসমানে আছেন। কিয়ামতের আগে তিনি পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। এই বিষয়টি অনেক সহিহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তারমানে খ্রিষ্টান ধর্ম মতে যিশু খ্রিষ্ট ইস্টার সানডে তে পুর্নজীবন লাভ করলেও, ইসলামী মতে ঈসা (আ) কে হত্যাই করা হয়নি।

খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ক্রিসমাস বা বড়দিন নিয়েও নানা ধরনের বিতর্ক রয়েছে। ধর্ম গ্রন্থের বর্ণনা এবং ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে, ২৫ ডিসেম্বর যিশু খিষ্ট্রের জন্মদিন হবার বিষয়ে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং ২৫ ডিসেম্বরের সাথে জড়িয়ে আছে অতীতের মূর্তিপুজারী প্যাগানদের নানান আচার অনুষ্ঠান। প্রাচীন প্যাগান রীতিনীতি কিভাবে ক্রিসমাস বা বড়দিন নামে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রধান উৎসবে পরিণত হয়েছে, সে সম্পর্কে জানতে চাইলে কিকেনকিভাবে র এই ভিডিওটি দেখতে পারেন।

যিশু খ্রিস্ট কি সত্যিই মারা গেছেন ?

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।