ড্যারিয়েন গ্যাপ

maxresdefault (1)
কি কেন কিভাবে

ড্যারিয়েন গ্যাপ

ভূমিকা

পানামা ও কলম্বিয়ার মাঝে অবস্থিত ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এক পাহাড়ি বনাঞ্চল ড্যারিয়েন গ্যাপ নামে পরিচিত। এই জায়গাটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক ও রহস্যময় স্থানগুলোর একটি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ এই ড্যারিয়েন গ্যাপ ব্যবহার করেই অবৈধ ভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের চেষ্টা করে। এই পথটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে থাকা মানুষদের কাছে এটিই একমাত্র বিকল্প হয়ে উঠেছে।

অভিবাসন প্রত্যাশীদের কাছে ড্যারিয়েন গ্যাপ যেন জীবন-মরণ যুদ্ধের নির্মম এক প্রান্তর; এখানে মানুষ উন্নত জীবনের আশায় নিজেদের জীবনকে সীমাহীন ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।

ড্যারিয়েন গ্যাপ

পৃথিবীর দীর্ঘতম সড়ক ব্যবস্থাটি প্যান আমেরিকান হাইওয়ে নামে পরিচিত। এই মহাসড়কটি উত্তর আমেরিকার আলাস্কা থেকে শুরু হয়ে, দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনায় গিয়ে শেষ হয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাসড়কের মাঝে মাত্র ১০০ কিলোমিটারের একটি গ্যাপ আছে। আর সেই গ্যাপটিই ডারিয়েন গ্যাপ নামে পরিচিত।

এই জায়গাটিতে কোন সড়ক না থাকার কারণ হল, এখানে রয়েছে ঘন জঙ্গল, ভয়ানক বন্যপ্রাণী এবং ভয়ংকার কাঁদা যুক্ত জলাভূমির মত একাধিক প্রতিবন্ধকতা। এই পাহাড়ি জঙ্গল পায়ে হেঁটে অতিক্রম করাটাও অতন্ত কঠিন এবং কারো কারো কাছে প্রায় অসম্ভব। সেকারণে এখানে কোন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি।

প্রাকৃতিকভাবেই ডারিয়েন গ্যাপ এলাকাটি দুর্গম হবার কারণে পানামা বা কলাম্বিয়ার কোন দেশের সরকারই এখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই এখানে গড়ে উঠেছে অবৈধ মাদক ব্যবসা ও মানব পাচারের নেটওয়ার্ক।

ড্যারিয়েন গ্যাপ কতটা ভয়ংকর

ড্যারিয়েন গ্যাপকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর পথগুলোর একটি বলা হয়। ড্যারিয়েন গ্যাপ এমন এক জায়গা, যেখানে না আছে রাস্তা, না মোবাইল নেটওয়ার্ক, না খাবার-পানি। এখানকার ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে বিষধর পোকমাকড়, সাপ আর হিংস্র বন্যপ্রাণী। এই জায়গায় কোনও রাস্তা নেই, ফলে পায়ে হেঁটে বা নৌকায় করেই পার হতে হয়। যাত্রাপথে রয়েছে গভীর কাদা, খাড়া পাহাড় আর স্রোতস্বিনী নদী। প্রতিদিন বহু মানুষ এখানে হারিয়ে যায়, আহত হয় বা মারা যায়, এটিই এখানকার নির্মম বাস্তবতা।

শুধু প্রাকৃতিক ঝুঁকিই নয়, ড্যারিয়েন গ্যাপে সক্রিয় রয়েছে অস্ত্রধারী বহু অপরাধী চক্র। এই অঞ্চল দিয়ে মাদক পাচার, মানব পাচার, ডাকাতি ও যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধ প্রায় নিয়মিতভাবে ঘটে। অনেক সময় সশস্ত্র ডাকাত দল বা সন্ত্রাসীরা অভিবাসীদের পথরোধ করে অর্থ বা সহায়তা ছিনিয়ে নেয়। নারীদের জন্য এই পথ আরও বেশি বিপজ্জনক, কারণ অনেকেই এখানে নিয়মিত ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন।

এই এলাকায় ফোনের কোনও নেটওয়ার্ক নেই, নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা বা খাদ্য সরবরাহ। অসুস্থ হলে বা কেউ নিখোঁজ হলে সাহায্য পাওয়ারও কোন সুযোগ নেই। ফলে ছোট একটি ভুল বা দুর্বলতা এখানে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। ড্যারিয়েন গ্যাপের পাহাড়ি পথ, কাদা আর নদী যেন এক মরণফাঁদ। এই পথগুলো এতটাই বিপজ্জনক যে, এখানে একবার পড়ে গেলে কেউ আর উঠতে পারে না।  

সব মিলিয়ে ড্যারিয়েন গ্যাপ শুধু একটি ভৌগোলিক বাধা নয়, এটি একটি জীবন্ত দুঃস্বপ্ন। হাজার হাজার মানুষ জীবন বাজি রেখে ডারিয়েন গ্যাপ অতিক্রম করে শুধু একটু ভালো জীবনের আশায়।

ড্যারিয়েন গ্যাপ অতিক্রম

বিশ্বব্যাপী অভিবাসন প্রত্যাশীদের স্বপ্নের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকা। নিজেদের দেশে নানা সমস্যা, যুদ্ধ, রাজনৈতিক সহিংসতা, অপরাধী গ্যাংদের দৌরাত্ম্য, খাদ্য সংকট বা দারিদ্র্য মানুষকে নিজ দেশ থেকে পালাতে বাধ্য করে। কেউ কেউ জীবন বাঁচাতে, কেউবা আবার ভালো চাকরি, শিক্ষার সুযোগ বা পরিবারের নিরাপদ ভবিষ্যতের আশায় যুক্তরাষ্ট্রে পাঁড়ি জমাতে চায়। এদের অনেকের জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের বৈধ ভিসা পাওয়া কঠিন বা কারো কারো জন্য প্রায় অসম্ভব। তাই তারা অবৈধ পথে, জীবনের ঝুঁকি নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করে। সমগ্র বিশ্ব থেকে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশীদের একটি বড় অংশ ব্যবহার করে ডারিয়েন গ্যাপ।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য প্রথমে নিজ দেশ থেকে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ হয়ে কলম্বিয়ায় পৌঁছায়। সেখান থেকে পাচারকারী বা স্থানীয় গাইডদের সহায়তায় তারা ড্যারিয়েন গ্যাপ অতিক্রমের যাত্রা শুরু করে।

তারা সাধারণত একটি ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পায়ে হেঁটে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলতে থাকে। কয়েকদিন ধরে পাহাড়, নদী, কাদা ও বন্য জঙ্গল পেরিয়ে তারা পানামা সীমান্তে পৌঁছায়। এই পথ পাড়ি দিতে ৫ থেকে ১০ দিন বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে।

এই রাস্তায় খাবার, পানি বা চিকিৎসা পাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। পাচারকারীরা অনেক সময়ই অভিবাসন প্রত্যাশীদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে নিয়ে এসে, তাদের বিপদে ফেলে দেয়। অনেকেই আবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজে নিজেই এই পথে পা বাড়ায়। ড্যারিয়েন গ্যাপ পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া মানুষদের অভিজ্ঞতা এতটাই ভয়াবহ যে তা শোনার পরও বিশ্বাস করা কঠিন।

ডারিয়েন গ্যাপের অন্যতম বিভীষিকা হল এখানকার কাঁদা। এই গভীর কাদার মধ্যে দেবে গিয়ে বা আটকে পড়েও অনেকে মারা যায়। কিন্তু এখান দিয়ে অতিক্রম করা অন্যকেই চাইলেও চোখের সামনে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু বরণ করা অন্য কাউকে সাহায্য করতে পারে না। কারণ অন্যকে সাহায্য করতে গেলে নিজেরও মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই কর্দমাক্ত পথে হাটতে গিয়ে বা নদীর জল খেতে গিয়ে পূর্ববর্তীদের লাশ দেখা একটি স্বাভাবিক বিষয়। কারণ এই মৃত্যুপুরীর পদে পদে বিপদের সম্মুখীন হয়ে, মানুষকে জীবন দিতে হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের অভিশাপ

বহু কষ্ট অার ত্যাগের বিনিময়ে ডারিয়েন গ্যাপ অতিক্রম করলেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিশ্চিত নয়। কারণ ডারিয়েন গ্যাপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কোন সীমান্ত নেই। কলম্বিয়া এবং পানামার মধ্যবর্তী ড্যারিয়েন গ্যাপ অতিক্রম করার পরও, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, এল সালভাদোর, গুয়েতেমালা এবং সর্বশেষ মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে হয়।

এই পুরো পথটিই অবৈধ, বিপজ্জনক এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী। তবুও হাজার হাজার মানুষ এই পথ বেছে নেয়, কারণ তারা মনে করে যুক্তরাষ্ট্রে পৌছাতে পারলেই তাদের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রেও বহু মানুষ গৃহহীন, তারা খাদ্যসংকটে ভুগছে এবং নিয়মিত সহিংসতার শিকার হচ্ছে।

২০২৪ সালেও যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮ লাখ মানুষ গৃহহীন ছিল। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৮% বেশি। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে গৃহহীনতার হার ৩৩% বেড়েছে, যা বেশ উদ্বেগজনক। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১.৮ কোটি পরিবার খাদ্যসংকটে ভুগেছে। অর্থাৎ আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ১৩.৫% লোক পর্যাপ্ত খাবার পায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় ৪ লক্ষ নারী যৌন সহিংসতার শিকার হন, যার মধ্যে অনেকেই প্রতিবাদ করার সুযোগ পান না বা বিচার পান না। যৌন সহিংসতা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান RAINN (Rape, Abuse & Incest National Network) এর তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৬৮ সেকেন্ডে একজন মানুষ যৌন সহিংসতার শিকার হন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫ কোটিরও বেশি মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে, কিন্তু তাদের একটি বড় অংশই চিকিৎসা পায় না। ২০২৩ সালে আমেরিকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেছে, যা দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত বৈষম্য এখনও প্রকট। কৃষ্ণাঙ্গ, মুসলিম, হিস্পানিক এবং অভিবাসীরা অনেক ক্ষেত্রেই হয়রানি বা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। ২০২৩ সালে ১,২০০ জনের বেশি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে ঢোকা অভিবাসীরা বৈধ কাজ পায় না। তারা সাধারণত দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক বা রেস্টুরেন্টে কম বেতনের অনিরাপদ কাজে নিয়োজিত থাকেন। এমনকি বৈধ কাগজপত্র থাকা অভিবাসীরাও অনেক ক্ষেত্রে বর্ণবিদ্বেষ, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা ও স্থানীয় অভিজ্ঞতার অভাবে চাকরি পেতে সমস্যায় পড়েন।

যুক্তরাষ্ট্র উন্নত দেশ হলেও, সেখানে পৌঁছালেই যে জীবন স্বর্গ হয়ে যাবে – এই ধারণা সত্য নয়। তাই জীবন বাজি রেখে তথাকথিত স্বপ্নের দেশ আমেরিকার উদ্দেশ্যে অবৈধ পথে পা বাড়ানোর আগে, বাস্তবতা যাচাই করে শতবার ভেবে দেখা অত্যন্ত জরুরী।

অবৈধভাবে আমেরিকা যাওয়ার রাস্তা ডারিয়েন গ্যাপ

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।