কাশ্মীর হামলা কী মোদি সরকারের সাজানো নাটক
কাশ্মীর হামলা কী মোদি সরকারের সাজানো নাটক
কাশ্মীরই ভারতের একমাত্র মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চল, যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেকারণে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে, কাশ্মীরের প্রতি তারা চূড়ান্ত রকমের বৈষম্য মূলক আচরণ করে আসছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করার মাধ্যমে কাশ্মীরের মুসলিম জনতার অধিকার হরণ করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জম্মু-কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা পেহেলগামে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার পর, এই ঘটনায় বিজেপি সরকারের মদদ থাকার বিষয়ে অনেকেই অভিযোগ করছেন। অতীতে কাশ্মিরের পুলওয়ামা হামলার ঘটনাও ঠিক একইভাবে তীব্র বিতর্ক ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম দিয়েছিল। সমালোচকেরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ের এই হামলা বিজেপি সরকারের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা, রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন, এবং কাশ্মীরের জনগোষ্ঠীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কৌশল হতে পারে।
৩৭০ ধারা
১৯৪৯ সালে ভারতীয় সংবিধানে জম্মু ও কাশ্মীর সম্পর্কে একটি বিশেষ ধারা অন্তর্ভুক্ত হয়। যা ৩৭০ ধারা হিসেবে পরিচিত। এই ধারায় জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে অনন্য স্বায়ত্তশাসন ও বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছিল। এর ফলে শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা, বিদেশ নীতি, অর্থনীতি এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে জম্মু-কাশ্মীরে ভারতীয় আইন প্রযোজ্য হত। বাকি অন্যান্য বিষয়ে এই রাজ্যের নিজস্ব আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ছিল। এমনকি জম্মু ও কাশ্মীরের নিজস্ব সংবিধানও ছিল, যা ১৯৫৬ সালে প্রণীত হয়। শুধু তাই নয় জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের আলাদা পতাকাও ছিল, যা ভারতীয় জাতীয় পতাকার পাশাপাশি ব্যবহৃত হতো। এই রাজ্যের “স্থায়ী বাসিন্দা” হিসেবে স্বীকৃত ব্যক্তিরাই শুধু সম্পত্তি ক্রয়, সরকারি চাকরি, বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির অধিকার পেতেন। বাইরের কোনো ভারতীয় নাগরিক জম্মু-কাশ্মীরে জমি কিনতে পারতেন না। ভারতীয় সংসদের অনেক আইন, যেমন তথ্য অধিকার আইন (RTI) বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, রাজ্যের সম্মতি ছাড়া কাশ্মীরে প্রয়োগ করা যেত না।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট নরেন্দ্র মোদি সরকার ৩৭০ ধারা বাতিল করে দেয়। এর ফলে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন বাতিল হয়ে যায়, এবং ভারতীয় সংবিধানের সব আইন এখানে প্রযোজ্য হয়। তখন রাজ্যটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়, একটি হল জম্মু ও কাশ্মীর এবং অপরটি হল লাদাখ। তখন থেকে অন্যান্য রাজ্যের ভারতীয় নাগরিকরাও জম্মু ও কাশ্মীরে সম্পত্তি কিনতে, বসবাস করতে এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পারছে।
৩৭০ ধারা বাতিলের প্রক্রিয়াটি সংবিধানের নিয়ম মেনে করা হয়নি। শুধু তাই নয়, এই ধারা বাতিলের সময় কাশ্মীরে ব্যাপক নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন, ইন্টারনেট ও যোগাযোগ বন্ধ, এবং স্থানীয় নেতাদের গৃহবন্দী করা হয়েছিল।
পেহেলগাম হামলা
ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের লক্ষ্য শুধু ভারতে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা নয়, বরং তারসাথে ভারত থেকে মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করা। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন হোক বা না হোক, নরেন্দ্র মোদির সরকার অন্তত সেরকম পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সন্তুষ্ট করে আরো বহুদিন ক্ষমতায় থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় একের পর এক নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল, মুসলিমদের ওয়াকফ আইনে হস্তক্ষেপের মত বিতর্কিত বিষয়েও চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াকফ আইন সংস্কার করার পর বিশ্বব্যাপী কিছুটা চাপের মধ্যে ছিল বিজেপি সরকার। সমালোচকেরা বলছেন, হয়ত সেই চাপ কাটিয়ে, ভারতের মুসলিমদেরকেই অপরাধী প্রমাণ করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে কাশ্মীরের হামলা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে।
কাশ্মীর উপত্যকায় কমপক্ষে ৫ লক্ষ নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন থাকে। তার উপর আবার পেহেলগাম কিছুটা দুর্গম পর্যটন এলাকা। এমন কড়া নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের গাফিলতি বা সহযোগীতা ছাড়া পর্যটকদের উপর হামলা করা কোন সহজ কাজ নয়। হামলার পর পরই কোন ধরনের প্রমাণ ছাড়াই ভারত এর জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে। যদিও পাকিস্তান থেকে এই জায়গার দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। ভারতে কোনো সন্ত্রাসী হামলা ঘটার সাথে সাথে কোন তদন্ত ছাড়াই পাকিস্তানকে দায়ী করা ভারতের একটি নিয়মিত কার্যক্রম।
পেহেলগাম হামলার পর নামের এক অখ্যাত সংগঠন এই হামলার দায় স্বীকার করেছিল। কিন্তু তারা পরবর্তীতে জানায় যে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র তাদের হয়ে এই প্রচার চালিয়েছিল। টিআরএফ এই হামলার সাথে জড়িত নয় বলে দাবি করেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিক্ষোভকে অন্য দিকে সরানোর জন্য এবং আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে এটি মোদি সরকারের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হতে পারে।
ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন
নিজের ক্ষতি করে শত্রুর ওপর দোষ চাপানো কে বলা হয় ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন। যার মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজের আসল উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়। ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশনে বিজেপি সরকার এবারই প্রথম নয়, অতীতেরও বহুবার এ ধরনের ষড়যন্ত্রে জড়ির থাকার অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। গুজরাটের কসাই হিসেবে পরিচিত নরেন্দ্র মোদিকে ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশনের গ্রান্ড মাস্টার বললেও ভুল হবে না।
২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সুত্রপাত হয়েছিল, সবরমতী এক্সপ্রেস নামের একটি ট্রেনে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের কামরায় আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সেই ঘটনা কারা ঘটিয়েছে তার কোন তদন্ত না করেই দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয় মুসলিমদের উপরে। যার ফলে ভারতের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ দাঙ্গার সৃিষ্ট হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সেই দাঙ্গায় প্রায় ১,০৪৪ জন নিহত হন, যার মধ্যে ৭৯০ জন মুসলিম এবং ২৫৪ জন হিন্দু। সেই সাথে প্রায় লক্ষাধিক মুসলিমকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সেই ভয়াবহ দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ক্ষতি হলেও, লাভ হয়েছিল একজনের; আর সেই ব্যক্তি হল নরেন্দ্র মোদি।
তৎকালীন গুজরাটের মূখ্য মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হিন্দু দাঙ্গাবাজদের প্রশ্রয় দিয়ে বনে যান সর্বভারতীয় কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের সুপ্রিম লিডার। যার ফলাফল হিসেবেই নরেন্দ্র মোদি বর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন বলে অনেকেই মনে করেন।
সাম্প্রতিক সমযের পেহেলগাম হামলার মত আরো একটি ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশনের উদাহরণ হল ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলা। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় একটি সন্ত্রাসী হামলায় ৪০ জন সিআরপিএফ বা কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বাহিনীর জওয়ান নিহত হন।
বলেন, গোয়েন্দা সূত্রে হামলার হুমকির খবর পাওয়ার পর, সিআরপিএফ জওয়ানদের জম্মু থেকে শ্রীনগরে স্থানান্তরের জন্য বিমানের অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে, ফলে জওয়ানদের সড়কপথে যেতে হয়, যা শেষ পর্যন্ত হামলার শিকার হয়। এই বিষয়টি সত্য পাল মালিক নরেন্দ্র মোদিকে জানালে, মোদি তাকে “চুপ থাকতে” বলেন। এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালও তাকে এই বিষয়ে নীরব থাকার পরামর্শ দেন।
সেই হামলাটি চালাতে ৩০০ কেজি বিস্ফোরক বহনকারী একটি গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা প্রশ্ন তোলেন, কাশ্মীরের মতো উচ্চ নিরাপত্তা অঞ্চলে এত বিপুল বিষ্ফোরকবাহী গাড়ি কিভাবে সিআরপিএফ জওয়ানদের কনভয়ের কাছে পৌঁছাল।
পুলওয়ামা হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। এর মাধ্যমে নরেন্দ্র েমাদি সরকারের নিরাপত্তা ব্যার্থতা নিয়ে আলোচনার বদলে, ভারতীয় গণমাধ্যমে মোদিকে শক্তিশালী নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা হতে থাকে।
পুলওয়ামা হামলার কয়েক মাস পরই ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং নরেন্দ্র মোদি জয়লাভ করেন। ভারতীয় বিরোধী দলগুলো সেসময় পুলওয়ামা হামলাকে “ভোট পাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র” হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। এবং এত বছর পরও পুলওয়ামা হামলার সঠিক কোন তদন্ত রিপোর্ট ভারত সরকার প্রকাশ করেনি।