ভারত পাকিস্তান কিভাবে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌছাল

ভারত-পাকিস্তান কিভাবে যুদ্ধের মুখে
কি কেন কিভাবে

ভারত পাকিস্তান কিভাবে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌছাল

সূচনা

ভারত-পাকিস্তানের মত দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ, এমন এক উত্তেজনার মুখোমুখি হয়েছে, যা বিশ্বকে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কাশ্মীরের পহেলগামে জঙ্গি হামলার পর, দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে। ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করেছে, যাকে পাকিস্তান “যুদ্ধের উসকানি” হিসেবে দেখছে। পাকিস্তান পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ঘোষণা দিয়েছে, আর ভারত ইতোমধ্যেই নৌবাহিনীর মাধ্যমে মিসাইল ধ্বংসের পরীক্ষাও চালিয়েছে। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় দুই দেশের মধ্যে (LoC) গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। দুই দেশের পাল্টাপাল্টি হুমকি, কূটনীতিক বহিষ্কার, আকাশসীমা বন্ধ, এবং সামরিক শক্তি প্রদর্শন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে।

পটভূমি

কাশ্মীর দীর্ঘদিন ধরেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর থেকে এই অঞ্চল নিয়ে ভারত-পাকিস্তান তিনটি যুদ্ধে জড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ২০১৯ সালে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর, উত্তেজনা আরও বেড়েছে। আর পেহেলগাম হামলা সেই উত্তেজনার সর্বশেষ অধ্যায়।

২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে জঙ্গি হামলায় ২৫ জন ভারতীয় নাগরিক এবং ১ জন নেপালি নাগরিক নিহত হয়েছে। যা ২০০৮ সালের মুম্বই হামলার পর ভারতে সবচেয়ে মারাত্মক সন্ত্রাসী আক্রমণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই হামলার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, সেই সাথে সন্দেহভাজন ২ জন পাকিস্তানিকে গ্রেফতার করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে একে “ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন” বলে দাবি করেছে। লশ্কর-এ-তৈয়্যবার একটি শাখা “কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স” নামের একটি গ্রুপ, প্রথমে এই হামলার দায় স্বীকার করলেও, পরবর্তীতে তারা দ্বায় অস্বীকার করে, একে ভারতীয় গোয়েন্দাদের কারসাজি হিসেবে উল্লেখ করেছে।

উত্তেজনার দ্রুত বৃদ্ধি

হামলার পর ভারত দ্রুত পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পদক্ষেপ নেয়। ২৩ এপ্রিল, ভারত ঐতিহাসিক ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’ স্থগিত করার ঘোষণা দেয়, যা দুই দেশের মধ্যে পানি ভাগাভাগির গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ছিল। একই দিনে ভারত পাকিস্তানিদের জন্য ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ সুবিধা বাতিল করে এবং পাঞ্জাবের আত্তারি সীমান্ত পারাপার পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়।

পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানও কঠোর পদক্ষেপ নেয়। তারা ভারতীয় বিমানগুলোর জন্য আকাশপথ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে, যার ফলে ভারতীয় বিমানগুলোকে বড়সড় লোকসানের মুেখে পড়তে হয়। তাছাড়া পাকিস্তান দুই দেশের মধ্যে চলমান সব ধরনের বাণিজ্য কার্যক্রমও স্থগিত করে দেয় এবং ভারতীয় কূটনীতিকদের দেশত্যাগে বাধ্য করে।

এরপর, ২৪ এপ্রিল, পাকিস্তান দুই দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্দেশ্যে করা ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। পাশাপাশি প্রতিদিন আত্তারি-ওয়াগাহ সীমান্তে যে প্রতীকী ‘হাত মেলানো’ ও সৌহার্দ্য বিনিময়ের আয়োজন হতো, সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

২০২৫ সালের ২৪ ও ২৫ এপ্রিল থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) বরাবর শুরু হয় টানা গোলাগুলি, যা থেমে থেমে ২৯ এপ্রিলের রাত পর্যন্ত চলে। সংঘর্ষের উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তান একটি ভারতীয় ড্রোন নিষ্ক্রিয় করে বলে দাবি করে, অন্যদিকে ভারত নৌবাহিনীর মাধ্যমে একটি মিসাইল ধ্বংসের সফল পরীক্ষা চালায়, যা সামরিক সক্ষমতার বার্তা দেয়।

২৭ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাফ জানিয়ে দেন, “আতঙ্কবাদী আশ্রয়স্থল ধ্বংস” এবং “গুরুতর শাস্তি” আসন্ন। তার এই বক্তব্যে সামরিক প্রতিশোধের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর পরদিন, ২৮ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাওয়াজা আসিফ অভিযোগ করেন যে, আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ভারত সরাসরি হামলা চালাতে পারে বলে গোয়েন্দা সূত্রে তারা ধারণা করছে।

ভারত এরই মধ্যে কাশ্মীর অঞ্চলে ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে। ১,৫০০-রও বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সন্দেহভাজনদের গ্রেফতারের নামে সাধারণ কাশ্মিরী মুসলমানদের উপর জুলুম নির্যাতন ও তাদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, এবং নিরাপত্তার স্বার্থে ৪৮টি পর্যটন এলাকা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

অন্যদিকে পাকিস্তান ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’ স্থগিত করার ভারতীয় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস আরও গভীরতর হয়ে উঠেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

যুদ্ধের আশঙ্কা চরমে পৌঁছার পর, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভারত ও পাকিস্তানকে একযোগে সংযম ও শান্তির আহ্বান জানাতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক মহল বুঝতে পারছে, এই উত্তেজনা যদি পূর্ণাঙ্গ সংঘর্ষে রূপ নেয়, তবে তা শুধু উপমহাদেশ নয়, গোটা বিশ্বে এর প্রতিকূল প্রভাব পড়তে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই দুই দেশের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক শুরু করেছে। এর মাধ্যমে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপের পরিবর্তে কূটনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের দীর্ঘদিনের বাণিজ্য অংশীদার ও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। যাতে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসে এবং পাকিস্তানের প্রতি একতরফা দোষারোপ এড়ানো যায়।

এদিকে ইরান মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে জানিয়েছে, তারা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় সাহায্য করতে প্রস্তুত। একইসঙ্গে সৌদি আরব, তুরস্ক এবং জাতিসংঘ শান্তির পক্ষে অবস্থান নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উপর জোর দিয়েছে।

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মাত্রা কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে, তা বোঝা যায় যখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং চীন পাকিস্তানে অবস্থানরত তাদের কূটনীতিকদের পরিবারবর্গকে সরিয়ে নিতে শুরু করে। এটি কেবল সংকটের বাস্তবতা নয়, বরং একটি সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রতি তাদের প্রস্তুতির পরিষ্কার ইঙ্গিত।

সম্ভাব্য পরিণতি

বর্তমান ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার পরিস্থিতি এমন এক মোড় নিয়েছে, যেখানে ভবিষ্যৎ কয়েকটি ভিন্ন পথে এগোতে পারে। বিশ্লেষক ও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, তিনটি সম্ভাব্য দিক সামনে রয়েছে।

প্রথম সম্ভাবনা হলো পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ। যদিও উভয় দেশই পরমাণু শক্তিধর, তাই পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে তার ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। তবে পারমানবিক শক্তি ব্যবহার ব্যতীত একটি প্রচলিত  যুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। যদি সংঘর্ষ পূর্ণমাত্রায় রূপ নেয়, তাহলে তা শুধু দুই দেশের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বিশ্ব অর্থনীতি, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপরও এর প্রভাব পড়বে। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে, খাদ্য ও জ্বালানির ঘাটতি দেখা দিতে পারে, এবং সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে মানবিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো সীমিত সংঘাত। এটি হতে পারে সীমান্তে গোলাগুলি, ক্ষুদ্র আকারের হামলা, কিংবা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতো সামরিক অভিযান, যা ২০১৯ সালে পুলওয়ামা ঘটনার পর দেখা গিয়েছিল। এ ধরনের সংঘাত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের মতো ধ্বংসাত্মক না হলেও, তা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও দুর্বল করে দিতে পারে।

তৃতীয় সম্ভাবনা, যা অনেকেই কামনা করছে, সেটি হলো কূটনৈতিক সমাধান। আন্তর্জাতিক চাপ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের হস্তক্ষেপ, এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যদি দুই দেশ আলোচনায় বসে, তবে উত্তেজনা ধীরে ধীরে প্রশমিত হতে পারে। যদিও অবিশ্বাসের দেয়াল অনেক উঁচু, তবুও আলোচনাই হতে পারে দীর্ঘমেয়াদে শান্তির একমাত্র পথ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দুই দেশের পরমাণু অস্ত্র ভান্ডার এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর চাপের কারণে পুরোপুরি যুদ্ধের সম্ভাবনা এখনো কম। তবে সীমিত সংঘাত, উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থা এবং দফায় দফায় সামরিক অভিযানের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। সেইসাথে কাশ্মীরে দমন-পীড়ন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ ও সামরিক প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে এ উত্তেজনা দীর্ঘমেয়াদেও চলতে পারে।

ভারত পাকিস্তান কি যুদ্ধ করবে ?


Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।