হিন্দুরা কি নিরাপদ
হিন্দুরা কি নিরাপদ
ভূমিকা
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে হামলার অভিযোগ ওঠে। এই সংবাদ ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম এমন অতিরঞ্জিত করে প্রচার করতে শুরু করে যে, তাতে মনে হয় বাংলাদেশে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে।
ভারতীয় গণমাধ্যম সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ করে বেশ কিছু টুইটার হ্যান্ডেল থেকে প্রচার করা হতে থাকে, শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশে হিন্দুরা নিরাপদ নয়। এবং হাসিনার দেশ ত্যাগের পরপরই হিন্দুদের উপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু হয়েছে।
হামলার ঘটনা
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়। বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রংপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, দিনাজপুরসহ সারা দেশে অন্তত ২৯টি জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। রাজধানী ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের খ্যাতনামা ব্যান্ডদল ‘জলের গান’এর প্রধান গায়ক রাহুল আনন্দের বাড়িতেও দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সারা দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে, গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর ৫২ জেলায় অন্তত ২০৫টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। তবে এই সংখ্যা নিয়ে হিন্দুত্ববাদী আরেকটি সংগঠনেরই যথেষ্ট দ্বিমত আছে। বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও প্রকাশ করে এই বিষয়টি পরিষ্কার করে তুলে ধরেছেন।
হাসিনা সরকার পতনের পর শুধুমাত্র তাদের উপরই হামলা হয়েছে, যারা ছিল স্বৈরাচারের দোসর। আল জাজিরার এটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১১৯ জন ব্যক্তির উপর হামলা হয়েছে, এর মধ্যে মাত্র দুইজন ছিল হিন্দু; যাদের একজন পুলিশ এবং আরেকজন আওয়ামীলীগ নেতা। এই বিষয়টিকেই হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশের যেসব জায়গায় হামলা হয়েছে অধিকাংশ তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে সহিংসতার শিকার হয়েছেন, এর সাথে সংখ্যালঘু পরিচয়ের কোন সম্পর্ক নেই।
কারা হামলা করেছে
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান ছিল দেশের আপামর জনসাধারনের আন্দোলন। এটি ছিল স্বৈরাচার হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলন, এটি কোন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়। বাঙালি হিন্দু পোস্ট নামের ফেসবুক পেজ একটি ছবি প্রকাশ করে বলেছে, আন্দোলনে অংশ নেয়া মেধাবী ছাত্ররা রংপুর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি হারাধন রায় কে পিটিয়ে হত্যা করেছে। অথচ এই লোক ছিল রংপুর মেট্রোপলিটন পশুরাম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থক কিছু হিন্দুত্ববাদী পেজ, ছাত্রদেরকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায় দিয়ে আন্দোলনকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে। অথচ বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের মত বহু হিন্দু এই আন্দোলনে সামিল হয়েছে।
[ভিডিও: একজন মায়ের বক্তব্য]
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে হিন্দুদের উপর নির্যাতনের যে কোনো সম্পর্ক নেই, তা খোদ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোই স্বীকার করছে। বাংলাদেশ সনাতন পার্টি বা বিএসপি নামের একটি সংগঠন সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে বলেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করতে একটি গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও সংখ্যালঘুদের উপর কোন ধরনের হামলা না করার জন্য এবং তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার ছাত্র জনতার প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের বিষয়টি, বাংলাদেশি গণমাধ্যমে যতটা না উঠে আসছে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রচারিত হচ্ছে ভারতীয় গণমাধ্যমে। ভারতের কিছু হলুদ সাংবাদিক প্রচার করছে বাংলাদেশ এখন জঙ্গিদের দখলে। তারা বলছে বিপ্লবের পর জামায়াত শিবির বাংলাদেশ দখল করে নিয়েছে, আর সে কারণেই হিন্দুদের উপর আক্রমণ হচ্ছে।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই জামাত শিবির হিন্দুদের উপর হামলা করেছে, তবুও প্রকৃত সমীকরণ মেলানো অনেক কঠিন হয়ে যায়। কারণ মাত্র কয়েকদিন আগেই আওয়ামী লীগ সরকার জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল। এই মুহূর্তে জামাত-শিবির অবশ্যই চাইবে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে, আবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জনপ্রিয় হতে। এমন সংকটকালীন মুহূর্তে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করলে, জামাত শিবিরের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। তাহলে লাভটা আসলে কাদের?
হামলার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার দুদিন পরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের আমির ডক্টর শফিকুর রহমান ধাকেশ্বরি মন্দির পরিদর্শন করেন। সেখানে হিন্দু নেতারা নিজ মুখে স্বীকার করেন জামাতের কর্মীরা তাদের মন্দির পাহারা দিয়েছে।
হামলা কেন হল
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে, দেশের সাধারণ জনগণ যখন ব্যাপক সাড়া দিচ্ছিল, তখন আওয়ামী লীগ সরকার একে জামাত শিবির এবং বিএনপির অপ -রাজনীতি হিসেবে আখ্যা দেয়। তারা ছাত্র আন্দোলনের যৌক্তিক দাবিগুলোকে বিবেচনা না করে, একে জামাত শিবিরের জঙ্গি অপততপরতার তকমা দেওয়ার চেষ্টা করে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবনতির দায় এড়াতে, আওয়ামী লীগ সরকার অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে জামাত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করে। এর মাধ্যমে তারা বহির্বিশ্বে দেখাতে চেয়েছে যে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং শেখ হাসিনা সরকার সেই জঙ্গিবাদকে নির্মূল করতেই বিক্ষুব্ধ জনতার উপর গুলি চালানোর মতো কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত নজিরবিহীন গণ অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা যখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়; তখনো আওয়ামী লীগ তাদের ঘৃণ্য অপরাজনীতির অংশ হিসেবে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার নীল নকশা বাস্তবায়ন করে। পুরো জুলাই মাস জুড়ে চলমান আন্দোলনের মধ্যে, কোথাও কোন ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বা দাঙ্গার খবর শোনা যায়নি। তাহলে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর সাথে সাথেই কেন হিন্দুদের উপর হামলা হবে? কারণ আওয়ামী লীগ প্রমাণ করতে চেয়েছে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার সাথে সাথে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এই অনিশ্চয়তার শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নয় বরং দেশের সকল শ্রেণীর মানুষই এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সারাদেশেই চুরি ছিনতাই ডাকাতি এবং অপহরণের মত ঘটনা বেড়েছে।
ভারতীয় মিডিয়া
ভারতীয় কিছু মিডিয়া বলছে, পাকিস্তানী এবং চীনের গোয়েন্দা সংস্থার মদদপুষ্ট গণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গীরা ক্ষমতায় এসেছে। শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙ্গার ঘটনাকে আফগানিস্তানের বৌদ্ধ মূর্তি ভাঙার সাথে তুলনা করা হচ্ছে। তারমানে বাংলায় তালেবানের মত শাসন কায়েম হচ্ছে। তারা অতীতের কিছু ছবি দিয়ে, তা বর্তমানের বলে প্রচার করছে। বেশ কিছু আওয়ামীলীগ নেতার উপর হামলার ভিডিও দেখিয়ে বলা হচ্ছে, এটা হিন্দুদের উপর হামলা। এমন কি বেশ কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম আওয়ামী লীগের এমপি ক্রিকেটার মাশরাফির বাড়িতে দেওয়া আগুনকে, লিটন দাশের বাড়িতে হামলা বলে প্রচার করেছে।
আরো বলা হচ্ছে সাম্প্রতিক এই দাঙ্গার কারণে বাংলাদেশ থেকে এক কোটি হিন্দু ভারতে আশ্রয় নিতে পারে। এই ধরনের মিথ্যা তথ্য প্রচারে সহায়তা করার জন্য, লালমনিরহাটের এক আওয়ামীলীগ নেতা স্থানীয় হিন্দুদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে হাতিবান্ধা সীমান্তের কাছে জড়ো করে। এসব হিন্দুদের বলা হয়েছিল যে, ভারতীয় নেতারা সীমান্তের ওপাড় থেকে তাদের সাথে কথা বলবেন। উদ্দেশ্য ছিল সীমান্তের কাছে জড়ো হওয়া ব্যক্তিদের ভিডিও করে আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় মিডিয়ায় প্রচার করা।
ভারতীয় যে সকল মিডিয়া অপপ্রচারে লিপ্ত তাদের মধ্যে, রিপাবলিক বাংলা নামের একটি চ্যানেল সবচেয়ে বেশি মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। এই মিডিয়ার মালিক হল ভারতীয় শীর্ষ দালাল সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামী এবং বিজেপির এক বিধায়ক। ওদের অপপ্রচার দেখলে, অপনি নিজ চোখে যা দেখেছেন তাও অবিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন। গুজবের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে যে, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ পর্যন্ত ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ নিয়ে গুজব ছড়ালে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অতীতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর এর চেয়েও বড় আকারের বেশকিছু আন্দোলন হলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে এতটা সরব দেখা যায়নি। যেকোনো যৌক্তিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিকেরই রয়েছে। তবে দেশে একটি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবার সাথে সাথে, তারা তাদের দাপ্তরিক কার্যক্রম ঠিকভাবে বুঝে ওঠার আগেই, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রাজধানীর শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সরকার কে তাদের কয়েক দফা দাবি বাস্তবায়নের আল্টিমেটাম দেওয়া, রাজনৈতিক বিচারে কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য, এর পেছনে বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের সরাসরি ইন্ধন থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
হিন্দুরা কি নিরাপদ?
হিন্দুদের উপর নির্যাতন এবং মন্দিরে হামলার গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মন্দির পাহারা দিয়েছে। এমনকি জামাত শিবিরের বহু কর্মীরাও সংখ্যালঘুদের ঘর -বাড়ির নিরাপত্তা বিধানসহ বহু জায়গায় মন্দির পাহারা দিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে আমরা এরকম বেশ কিছু ছবি ভাইরাল হতে দেখেছি। অনেক হিন্দু নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়ায় কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বেশ প্রশংসা করেছেন।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হয়েছে তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। তবে এই হামলার ঘটনা অতটাও বৃহৎ পরিসরে ঘটেনি যেভাবে একে প্রচার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা নিঃসন্দেহে বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় সামাজিক সম্প্রীতিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছেন। বিশেষ করে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমরা যেভাবে দিনের পর দিন নির্যাতিত হচ্ছেন, সেই তুলনায় বাংলাদেশী হিন্দুরা অনেকটাই নিরাপদ।
সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ নিঃসন্দেহে একটি মারাত্মক অপরাধ। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সংখ্যালঘুদের উপর হামলার বরাবরই প্রতিবাদ করেছে। এবং ভবিষ্যতেও আমাদের সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে, বাংলাদেশের যেন সংখ্যালগুদের উপর আর একটিও হামলার ঘটনা না ঘটে।