হিন্দুদের ৮ দফা দাবি

maxresdefault (53)
কি কেন কিভাবে রাজনীতি

হিন্দুদের ৮ দফা দাবি

আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর থেকে হিন্দুদের অধিকার আদায়ের জন্য সারা দেশে বেশ কিছু হিন্দুত্ববাদী দল আত্নপ্রকাশ করেছে। সনাতন অধিকার মঞ্চ, সম্মিলিত সনাতনী সমাজ, সনাতনী অধিকার আন্দোলন এর মত আরো বেশ কিছু গোষ্ঠী। এসব হিন্দুত্ববাদী দলগুলোর দাবি দেওয়া মোটামুটি একই। তারা তাদের দাবিগুলোকে মোটাদাগে আটটি দফায় উপস্থাপন করেছে।

হিন্দুদের ৮ দফা দাবি তে কী আছে ?

দাবির প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কে হিন্দু কে মুসলিম সে হিসেবে কাউকে বিচার করা হয় না। অসাধু দুর্নীতিবাজদের কোন ধর্ম নেই; সেই বিচারেই আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের বিক্ষুব্ধ জনতা; আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বাড়িঘরে হামলা করে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে।

৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়েছে বলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যে খবর প্রচার করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১১৯ জন ব্যক্তির উপর হামলা হয়েছে, এর মধ্যে মাত্র দুইজন ছিল হিন্দু; যাদের একজন পুলিশ এবং আরেকজন আওয়ামীলীগ নেতা। এই বিষয়টিকেই হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের বিষয়টি, বাংলাদেশি গণমাধ্যমে যতটা না উঠে এসেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রচারিত হয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যমে। যার অধিকাংশ ছবি এবং ভিডিও অতীতের সাম্প্রদায়িক হামলার হলেও, সেগুলোকে ৫ আগস্টের বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। খোদ হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ প্রামাণিক সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর হামলার বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন।

৮ দফা দাবি

হাসিনা সরকার পতনের মাত্র ৩ দিন পরেই কয়েক হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী রাজধানীর শাহবাগে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তখন সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বন্ধ এবং সংখ্যালঘু সুরক্ষা কমিশন গঠন সহ ৪ দফা দাবি তোলা হয়। এরপর প্রায় নিয়মিত সমগ্র দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশ অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে।

তবে হিন্দুদের আয়োজিত সবচেয়ে বড় সমাবেশটি হয়েছিল চলতি বছরের ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে। সেই সমাবেশের ব্যাপক লোকসামগম, হিন্দুত্ববাদী নেতাদের বক্তব্য এবং পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে ঢাকা অবরোধের ঘোষণাকে ঘিরে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা। আলোচিত এই সমাবেশেই চিন্ময় কৃষ্ণ দাস জাতীয় পতাকা অবমাননার ঘটনা ঘটিয়েছিল।

তার আগেও বহুবার বহু জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দল তাদের দাবিদাওয়াগুলো মোটাদাগে ৮ টি দফায় পেশ করেছে। কিন্তু লালদিঘি ময়দানের ওই সমাবেশে সনাতন জাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকেই দাবিগুলো সবচেয়ে বেশি পরিষ্কারভাবে উঠে আসে।

যে আট দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো হলো:

১. সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা।

২. ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করা।

৩. সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা।

৪. সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা।

৫. দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন কার্যকর করা।

৬. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপাসনালয় নির্মাণ এবং হোস্টেলে প্রার্থনার জন্য স্থান বরাদ্দ করা।

৭. হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে ফাউন্ডেশনে উন্নীত করা। এবং

৮. দুর্গাপূজায় পাঁচ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা।

৮ দফা দাবির সবগুলোই কমবেশি যৌক্তিক। কিন্তু এর মধ্যে শুধু দুর্গাপূজায় পাঁচ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা ছাড়া বাকি কোন দাবিই রাতারাতি বাস্তবায়ন যোগ্য নয়। কিন্তু এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার কার্যক্রম করার জন্য মাত্র ৩ মাসে তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত আন্দোলন করেছে।

ট্রাইবুনাল গঠন করা, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা, আইন প্রণয়ন করা বা মন্ত্রণালয় গঠন করার জন্য যৌক্তিক সময় দিতে হবে। একটি নির্বাচিত সরকার তার ৫ বছরের মেয়াদেও এত কিছু একসাথে করা প্রায় অসম্ভব। সেখানে বিপ্লব পরবর্তী বিশৃঙ্খল একটি দেশে, বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের মত রাজনৈতিকভাবে অনভিজ্ঞ একটি উপদেষ্টা পরিষদ কিভাবে ক্ষমতাগ্রহণের ৩ মাসের মাথায় এত কিছু করে ফেলবে?

বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশে দুই ইদে সরকারি ছুটি থাকে মাত্র ৩ দিন। সেখানে মাত্র ৮ শতাংশ হিন্দুদের জন্য দুর্গাপুজায় ৫ দিন ছুটি নির্ধারণ করা কতটা যৌক্তিক। তাছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলিমদের জন্যই কোন নামাজের ব্যবস্থা নেই। এমনকি নামাজের সময় কোন ধরনের বিরতিও দেওয়া হয় না। সেখানে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিন্দুদের উপাসনালয় নির্মাণ এবং হোস্টেলে প্রার্থনার জন্য জায়গা বরাদ্দ করা কতটুকু যৌক্তিক?

তারচেয়েও বড় বাস্তবতা হল, বাংলাদেশের প্রধান সারির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোরআনের মাহফিল করার অনুমতি দেওয়া হয় না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে জাকজমকভাবে প্রতিবছর স্বরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয়। তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় বিচারে প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা?

হিন্দুরা সত্যিই কী সংখ্যালঘু

নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করা দোষের কিছু না। কিন্তু বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশে এর চেয়েও অনেক বেশি এবং বৃহৎ পরিসরে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হামলার সবচেয়ে বড় ৩টি ঘটনা হল;

১. ২০১২ সালে কক্সবাজারে রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ

২. ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু মন্দির ও বাড়িঘরে আক্রমণ এবং

৩. ২০২১ সালে কুমিল্লায় দুর্গাপুজার মন্ডপে কোরআন অবমাননার অভিযোগে মন্দিরে হামলার ঘটনা

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সবচেয়ে বড় ৩টি হামলার ঘটনাই ঘটেছে আওয়ামীলীগের আমলে। শুধু তাই নয়, মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০২২ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকার সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর প্রায় সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি ছোট-খাটো হামলার ঘটনা ঘটেছে। তখন সনাতন জাগরণ মঞ্চ কোথায় ছিল, কিংবা ভারত সরকারের এত বিবৃতিই বা কোথায় ছিল?

লালদিঘি ময়দানে সনাতন জাগরণ মঞ্চের নেতারা বলেন, গত ৫৩ বছরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হওয়া সহিংসতা ও নিপীড়নের একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। বিগত ৫৩ বছরের বিচার কি অন্তবর্তী সরকারের পক্ষে মাত্র ৩ মাসে করা সম্ভব?

ওই সমাবেশের প্রধান বক্তা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বলেন, শুধু হিন্দু বলে অনেককে নাকি চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার আর হতেই পারেনা। কারণ এই অভিযোগটি করা হয়েছিল, পুলিশ একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার মাত্র এক মাস আগে ২৫২ জন শিক্ষানবিশ উপ-পরিদর্শক বা এসআই কে চাকরি থেকে অব্যহতি দেওয়া বিষয়ে। শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখিয়ে এদের বহিষ্কার করা হলেও, এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে। কারণ আওয়ামীলীগ সরকার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ঢালাওভাবে এসআই পদে চাকরি দেওয়ার বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। তাই এমন অবৈধভাবে চাকরি পাওয়াদের বাদ দেওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।

৪০তম ব্যাচের ৮০১ জন শিক্ষানবিশ পুলিশের মধ্যে মাত্র ২৫২ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই ২৫২ জনের মধ্যে আবার ৯১ জন হিন্দু এবং ১৬১ জন মুসলমান। ৯১ জন হিন্দুকে বাদ দেওয়াটা যদি ধর্মীয় কারণে হয়ে থাকে, তাহলে ১৬১ জন কে তো মুসলিম হওয়ার জন্য বাদ দেওয়া হয়েছে।

৮ দফা নেপথ্যে

বাংলাদেশে অওয়ামীলীগের শাসনামলে বহু হিন্দু নেতার দাপটে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্তেও ভয়ে কথা বলতে পারত না। আওয়ামীলীগের দীর্ঘ দেড় যুগের ক্ষমতার সময় স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতা থেকে শুরু করে দুর্নীতিবাজ এমপি মন্ত্রীদের অনেকেই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের।

চালের বাজারে অস্থিরতার মূল হোতা নওগঁার গডফাদার সাধন চন্দ্র মজুমদার, বরগুনার গডফাদার ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, মাগুরার বিরেন শিকদার, দিনাজপুরের মনোরঞ্জন শীল, সাতক্ষীরার ননী গোপাল মন্ডল, বরিশালের পঙ্কজ নাথ, নেত্রকোনার অসীম কুমার উকিল এর মত বহু দুর্নীতিবাদ হিন্দু নেতা একাধিকবার জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছে। ক্ষমতা হারানোর পর এদের সাঙ্গপাঙ্গদের উপর বিক্ষুব্ধ জনতা যখন হামলা করেছে, তখন এরা সংখ্যালঘু সেজেছে।

আদালতের আদেশ অমান্য করে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ফজলে নুর তাপস যখন হরিজন পল্লীর হিন্দুদের উচ্ছেদ করেছে, কিংবা যখন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ গোপালগঞ্জের হিন্দুদের হাজার হাজার একর জমি দখল করে রিসোর্ট গড়ে তুলেছে তখন চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মত হিন্দু দরদী নেতারা কোথায় ছিল? এর বাইরেও আওয়ামীলীগের বহু এমপি এবং স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের দ্বারা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এছাড়া বিএনপির গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কিংবা নিপুন রায়ের মত হিন্দু নেতারা যখন হামলার শিকার হয়েছেন তখন বাংলাদেশের সনাতনীরা একটি কথাও বলেনি।

হিন্দুরা অতীতে প্রতিবাদ না করার বিষয়টি এমনও হতে পারে যে, তারাও হয়ত স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পেয়েছে। কিন্তু আওয়ামীলীগ সরকার তো ভারতের অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিল, তাহলে তখন ভারত কেন সামান্য বিবৃতি দিয়েও হলেও হিন্দুদের সুরক্ষার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়নি?

এর কারণ মুলত একটাই, বাংলাদেশ থেকে আওয়ামীলীগ বিদায় হওয়াতে ভারত এবং ভারতের দালাল হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু নেতারা দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরী করতে চাইছে। যে আওয়ামীলীগ হিন্দুদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কথা না বলে, অন্তবর্তী সরকারকে দুর্বল পেয়ে, ভিকটিম কার্ড প্লে করে তারা দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।