হাওয়াইয়ের দাবানল
হাওয়াইয়ের দাবানল
কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে ভয়াবহ দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। দাবানলে মাউই দ্বীপের ঐতিহাসিক শহর লাহাইনার ৮০ শতাংশ এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রায় শতাধিক লোক মৃত্যুবরণ করেছে, আরো কয়েকশ লোক নিখোঁজ রয়েছে এবং প্রায় দুই হাজারের অধিক ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।
লাহাইনা হল হওয়াই দ্বীপপুঞ্জের বিচ রিসোর্ট সিটি হিসেবে পরিচিত। হাওয়াইয়ের এই দ্বীপটিতে আমেরিকার অনেক ধনী ব্যক্তি বাস করেন যাদের মধ্যে অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসও আছেন। শহরটি এই দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য হিসেবেও পরিচিত ছিল।
সাম্প্রতিক এই দাবানল হাওয়াই রাজ্যের ইতিহাসে তো বটেই, সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসেও সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর একটি।
দাবানল কী?
দাবানল বলতে সাধারণত বনাঞ্চলে সংঘটিত অগ্নিকান্ডকে বোঝায়। দাবানল সৃষ্টি হবার মত শুষ্ক পরিবেশে কোন বনে আগুন লাগলে, তা সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বনের ঝড়া পাতা থেকে শুরু করে ছোট বড় সকল বৃক্ষ এই আগুনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে থাকে। ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম এই আগুন সামনে যা কিছু পায়, সবকিছু পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়। সেকারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দাবানলের আগুন আপন মনে যতক্ষণ খুশি জ্বলতে থাকে। তবে অধিকাংশই সময়ই এই আগুনের সূত্রপাত হয় মানুষের দ্বারা। ইউএস ফরেস্ট সার্ভিসের মতে, আমেরিকার প্রায় ৮৫ শতাংশ দাবানল মানুষের কারণে হয়ে থাকে। অযত্নে ফেলে রাখা ক্যাম্পফায়ারের আগুন বা সিগারেটের আগুন এর মত মানুষের অসতর্ক আগুন থেকে সবচেয়ে বেশি দাবানল সৃষ্টি হয়। কোন কোন গবেষক বলেন, মাত্র ১ শতাংশ দাবানল প্রাকৃতিক আগুন থেকে হয়। এগুলো মধ্যে বজ্রপাত এবং আগ্নেয়গিরির আগুনই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
আমেরিকার বনাঞ্চলে বিভিন্ন উপায়ে বছরে প্রায় এক লক্ষ বার আগুন লাগে। এর ফলে প্রায় ২০ লক্ষ হেক্টর জমি পুড়ে যায়। গত তিরিশ বছরে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন বন, আফ্রিকার কঙ্গোর রেইন ফরেস্ট এলাকা এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের লক্ষ লক্ষ একর এলাকার বনভূমি মানব সৃষ্ট দাবানলে ধ্বংস হয়েছে। চাষাবাদের নতুন জমি সৃষ্টি করার জন্য বনে আগুন দেওয়ার পর, এসব দাবানল সৃষ্টি হয়েছিল।
দাবানলের ক্ষতিকর প্রভাব আক্রান্ত অঞ্চল ছাড়াও আরো বহু দূর ছড়িয়ে পড়ে। দাবানলের আগুন থেকে অগ্নি ঝড়, আগুনে সাইক্লোন বা আগুনের টর্নেডোও তৈরী হতে পারে। যা নদীর মত বাঁধা পার করেও দাবনলকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, দাবানলের ধোাঁয়া ও ছাইও অনেক দূরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
সাইবেরিয়ার তাইগা বনে তৈরী হওয়া দাবানলের ধোঁয়া ৩ হাজার মাইল দূরে জাপানের ওসাকা শহরকে অন্ধকার করে দিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার ব্ল্যাক ফ্রাইডে বুশ-ফায়ারের ছাই ২ হাজার মাইল উড়ে গিয়ে নিউজিল্যান্ডে পড়েছিল।
দাবানল মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক যেভাবেই হোক না কেন, প্রথমত এটি ক্ষতিকর রূপ নিলেও, এ ভেতরে বেশ কিছু কল্যাণকর দিকও আছে। দাবনলের কারণে বনের মৃত ও পচনশীল দ্রব্যাদি পুড়ে গিয়ে পরিবেশ শুদ্ধ হয়, গাছের কাণ্ডে জমে থাকা পুষ্টি, অগ্নিকান্ডের পরে আবার জমিতে ফেরত আসে। এছাড়া যাবতীয় ক্ষতিকর পোকামাকড় এবং রোগশোকের জীবাণুও ধ্বংস হয়ে যায়; যার ফলে নির্দিষ্ট সময় পর বনের বাস্তুসংস্থান আবারো নতুন করে গড়ে ওঠে।
হওয়াই দ্বীপপুঞ্জর দাবানল
আটটি বড় বড় দ্বীপ নিয়ে হওয়াই দ্বীপপুঞ্জ গঠিত। এসব দ্বীপের প্রায় মাঝ বরাবর থাকা একটি দ্বীপ মাউই। এই দ্বীপের লাহাইনা শহরে প্রায় ১৩ হাজার লোক বাস করত। আগষ্ট মাসের শুরু দিকে হাওয়াই দ্বীপের আবহাওয়া পরিস্থিতি নিয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয় হওয়াই এর দ্বীপগুলোতে উচ্চ বাতাস এবং অত্যন্ত শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করবে। সেই সাথে যোগ হয় এবারের গ্রীষ্মের অস্বাভাবিক তাপমাত্রা। সবকিছু মিলিয়ে এই অঞ্চলে দাবানল তৈরী হওয়ার এক মোক্ষম পরিস্থিতি তৈরী হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সেই আবহাওয়া সতর্কবার্তা সরিয়ে নেওয়া হয়। দাবানল শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ বুঝে উঠতে পারেনি যে, কীভাবে এত তীব্র দাবনল শুরু হল। স্বাভাবিক অবস্থায় দাবানল এতটা ধ্বংসাত্নক হওয়ার কথা নয়। হাওয়াই উপকূলের আবহাওয়া অফিস জানায়, হারিকেন ডোরার প্রভাবে, প্রশান্ত মহাসাগর থেকে উচ্চ বায়ু প্রবাহ হাওয়াই অঞ্চলে চলে আসে। এই তীব্র ঝড়ো হাওয়া মাউই দ্বীপের খাড়া পর্বত শ্রেণীর উপরে উঠে যায়, এবং সেখান থেতে তীব্র বেগে নিচে সমুদ্র উপকূলের দিকে ধেয়ে আসে। পাহাড়ের উপর থেকে আসা এই বায়ু প্রবাহই দাবানলের আগুনকে লাহাইনা শহরের মূল জনপদের দিকে প্রবাহিত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, হাওয়াই এর দাবানল এতটা ছড়িয়ে পড়ার আরেকটি কারণ হল, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ এই অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়েছে। এসব বিদেশী ঘাস স্থানীয় ঘাসের তুলনায় বাতাস থেকে অধিক জলীয় বাষ্প শোষণ করে, এর ফলে পরিবেশ আরো বেশি শুষ্ক হয়ে দাবানল সহজে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীবাশ্ন জ্বালানীর অধিক ব্যবহারের কারণে সাধারণ প্রকৃতিক দুর্যোগগুলো এত বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
দাবানলের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখা যায় আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের সময়। আগ্নেয়গিরি হল আমাদের গ্রহের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ভৌগলিক প্রক্রিয়া। মাটির নিচে থাকা উত্তপ্ত গলিত পাথর, ছাই এবং গ্যাস যে পথে বেরিয়ে আসে, সেগুলোই মূলত আগ্নেয়গিরি হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় দেড় হাজার সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আছে। এবং প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০ থেকে ৭০ টি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটে।