হজ্জ কি কখনও বন্ধ ছিল
হজ্জ কি কখনও বন্ধ ছিল
ভূমিকা
মুসলিমদের জীবনের এক বিশেষ আধ্যাত্মিক সফর হজ্জ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানব সমাবেশ হিসেবে বিবেচিত। প্রতি বছর পৃথিবীর সকল দেশ থেকে আগত মুসলিমরা হাজার হাজার বছর ধরে হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা পালন করে চলেছেন।
তবে অতীতে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা, মহামারি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হজ্জ পালনে বিঘ্ন ঘটেছে। এমনকি মহানবী (স) প্রথম বার মদিনা থেকে উমরা পালন করতে গিয়েও, রাজনৈতিক কারণে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
প্রথম হজ্জ
ইসলামের ৫টি মূল স্তম্ভের একটি হজ্জ। প্রতি বছর পৃথিবীর প্রায় ৩০ লক্ষ মুসলিম হজ্জ পালন করেন। হযরত মুহাম্মদ (স) মদিনায় হিজরত করার পর, ৬ষ্ট হিজরিতে প্রথমবার উমরা পালন করতে গেলে মক্কার কুরাইশদের দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হন। সেবছর মহানবী (সা) তাঁর ১ হাজার ৪০০ জন সাহাবী কে নিয়ে উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়েছিলেন। মক্কার কুরাইশদের অসহিষ্ণু আচরণের কারণে মুসলিমরা হুদাইবিয়া নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করে। নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে সেবছর উমরা পালন করা সম্ভব হয় না; এবং হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্ত অনুযায়ী মুসলিমরা উমরা না করেই ফিরে আসে। প্রথমবার উমরা পালনে বাঁধা প্রাপ্ত হলেও, তার পরবর্তী বছর থেকে নিয়মিত সেই ধর্মীয় রীতি পালিত হয়ে আসছে। নবম হিজরীতে হজ্জ ফরজ হওয়ার পর থেকে বিশেষ কারণ ছাড়া কখনই এই ইবাদত থেমে থাকেনি।
রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা
৭৩ হিজরী বা ৬৯৩ খ্রিষ্টাব্দে অত্যাচারী খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের নির্দেশনায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কাবা শরীফ অবরোধ করে। এই অবরোধের কারণ ছিল হযরত আবু বকর (রা) এর নাতি আব্দুল্লাহ বিন জোবায়ের (রা) মসজিদুল হারামে আত্মগোপন করেছিলেন। তিনি জালিম শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায়, তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শুধুমাত্র তাঁকে গ্রেফতার করতে, সাময়িক সময়ের জন্য মসজিদুল হারামের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছিল। মসজিদুল হারামে এই আক্রমণের কারণে কাবার বেশ কিছু ক্ষতি সাধিত হয়। দীর্ঘ দিনের অবরোধ এবং মসজিদ পুনঃনির্মানের কারণে কিছু সময়ের জন্য ওমরা পালন বন্ধ ছিল।
আব্বাসি খিলাফতের সময়ও রাজনৈতিক অস্থিরতা হজের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। ১৪৫ হিজরি সনে আলাউইদের নেতৃত্বে হিজাজ ও বসরায় আব্বাসিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে হজের পথে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়; যার ফলে মিসর ও সিরিয়া থেকে কেউ হজে যেতে পারেননি।
৩১৭ হিজরী বা ৯৩০ সালে ঘটে এক ভয়াবহ ঘটনা। বর্তমান বহরাইন অঞ্চলের কারমাতিয়ান গোত্রের লোকেরা হাজিদের উপর আক্রমণ চালায়। আবু তাহির আল জান্নাবীর নেতৃত্বে কারমাতিয়ান সন্ত্রাসীরা, প্রায় ৩০ হাজার হজ্জ যাত্রীকে হত্যা করে এবং তাদের মালামাল ছিনতাই করে নেয়। এই উগ্রপন্থী দল পবিত্র জমজম কূপে হাজিদের লাশ ফেলে দেয় এবং পবিত্র পাথর হাজরে আসওয়াদ লুট করে নিয়ে যায়। অব্যাহত হামলার ফলে, ৩১৭ থেকে ৩২৭ হিজরী পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর হজ্জের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। আর হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর চুরির ২০ বছর পর আবারো পাথরটি তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়।
মক্কা ও মদিনার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে ঘিরে ফাতেমি ও আব্বাসিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণেও, ৪০১ হিজরি বা ১০১১ খ্রিষ্টাব্দে ইরাক, শাম, খোরাসান, এবং মিসর থেকে কেউ হজে যেতে পারেননি। কেবল ইয়েমেনের কিছু লোক এবং মক্কায় বসবাসকারী স্বল্পসংখ্যক স্থানীয় বাসিন্দা হজ পালন করেছিলেন।
রাজনৈতিক সংঘাতের পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতাও হজ বন্ধের একটি প্রধান কারণ ছিল। হজের জন্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজিদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হতো, যা প্রায়ই বিপজ্জনক ছিল। ডাকাত, লুটেরা এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো হজের পথে হামলা চালাত, যা হজ পালনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলত।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে পানির অভাব, হজের ইতিহাসে বারবার বাধা সৃষ্টি করেছে। হজের জন্য হাজিদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হতো, আরব উপদ্বীপের মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাওয়া এই পথে পানির অভাব একটি মারাত্মক সমস্যা ছিল। ৩৬৩ হিজরিতে ইরাক থেকে আগত হাজিরা সুমাইরায় পৌঁছে দেখেন যে পথে পানি নেই। ফলে তাঁরা মদিনায় ফিরে যান এবং সে বছর তাঁরা হজ পালন করতে পারেননি।
৪০৬ হিজরিতে বহু হজ্জ যাত্রী পানির অভাবে অনেকে পিপাসায় মারা যান। ধারণা করা হয় সেবছর ২০ হাজার হাজির মধ্যে মাত্র ৬ হাজার জন বেঁচে ফিরতে পারেন।
১০৩৮ হিজরী বা ১৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় ব্যাপক বন্যা হয়। এর ফলে কাবা শরীফের দেয়াল ভেঙে পড়ে। তখন কাবা পুনঃনির্মানে জন্য কিছুটা সময় লাগে। তাই সেবছর উসমানীয় সুলতান চতুর্থ মুরাদের নির্দেশে হজ্জ ও উমরার কার্যক্রম বন্ধ করা হয়।
বিধ্বংসী কলেরা মহামারীর কারণে একাধিকবার পবিত্র হজ্জ পালনে ব্যাঘাত ঘটেছে। ১৮৩০ থেকে ১৯৩০ সালের ভেতর মাত্র ১০০ বছরে, হজ্জ যাত্রীদের মধ্যে ২৭ বার কলেরা রোগের বিস্তার ঘটে। ১৮৩৭ এবং ১৮৪৬ সালের হজ্জ কলেরা মহামারীর কারণে সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়েছিল। ১৮৬৫ সালে সৌদি আরবের হেজাজ অঞ্চলে আবারো মহামারি ছড়িয়ে পড়লে হজ্জের আয়োজন সীমিত করা হয়। সেসময় হেজাজ এবং সিনাই এলাকায় কোয়ারেন্টাইন বন্দর স্থাপন করা হয়েছিল।
সামরিক প্রতিবন্ধকতা
১৯৭৯ সালে প্রায় ৫০০ সদস্যের এক সশস্ত্র দল মসজিদুল হারামে আক্রমণ চালায়। এই হামলার নেতৃত্ব দেয় সাবেক সৌদি \ সৌদি রাজ পরিবারের দূর্নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এই গোষ্ঠী দাবি করে, তাদের মধ্যকার এক জন ইমাম মাহাদী হিসেবে আর্বির্ভূত হয়েছে। হজ্জ পালন করার সময়ে সন্ত্রাসীরা হাজার হাজার মুসলিমকে বন্দী করে। পরবর্তীতে ফ্রান্সের যৌথ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে সৌদি বিশেষ বাহিনী কাবা শরীফ পুনঃদখলের জন্য যুদ্ধ করে। এই সশস্ত্র লড়াইয়ের ফলে কয়েকশ জঙ্গি, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং হাজী নিহত হয়। এই সংঘাতের কারণে প্রায় ২ সপ্তাহ মসজিদুল হারাম বন্ধ ছিল।
এছাড়া অতীতে একাধিক সাম্রাজ্যের দ্বন্দ, যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক কারণে ইরাক, মিশর, সিরিয়া সহ আরো বেশ কিছু অঞ্চলের হাজিরা হজ্জে অংশগ্রহণ করতে বাঁধা প্রাপ্ত হয়। ২০১৪ সালে ইবোলা মহামারির কারণে গিনি, লাইবেরিয়া এবং সিয়েরা লিয়নের নাগরিকদের হজ্জ পালনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সৌদি কর্তৃপক্ষ। বিশ্ব ব্যাপী করোনাভাইরাসের বিস্তারের কারণে, ২০২০ সালে সৌদি আরবের বাইরের দেশ থেকে ওমরা পালনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এছাড়া সেবছর হজ্জ পালনকালে কালো পাথর এবং কাবা শরীফে চুম্বন করাও নিষেধ করা হয়েছিল। এমনকি তাওয়াফ করার সময়ও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হয়।
তাওয়াফ
অতীতের বিভিন্ন সময়ে হজ্জের আনুষ্ঠানিকতায় বাঁধা আসলেও, প্রকৃতপক্ষে হজ্জ যে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে, বিষয়টি মোটেও সেরকম নয়। করোনা মহামারির সময়েও বাইরের মুসল্লিদের জন্য দরজা বন্ধ থাকলেও, মসজিদুল হারামের কর্মকর্তা কর্মচারী ও খাদেমরা মিলে, জামাতের সাথে নামাজ আদায় করতে থাকে। এমনকি হজ্জের গুরুতপূর্ণ অংশ পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করাও কখনও বন্ধ হয়নি। এমনকি অতীতে বন্যার সময়ও মানুষ সাতার কেটে পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করেছেন।
২০২০ সালে মহামারির নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও সৌভাগ্যবান কিছু মুসলিম তাওয়াফ করার সুযোগ পায়। মসজিদুল হারামের ভেতর ও ছাদের উপর দিয়ে সীমিত সংখ্যক লোক কাবা কে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। সে বছর কাবা শরীফে মানুষের পদচারণা কমে যাওয়ার পর, হঠাৎ করেই দেখা যায় আশ্চর্য এক ঘটনা। এক ঝাঁক পাখি কাবা ঘরের চারদিকে তাওয়াফ করতে থাকে। উপস্থিত কেউ একজন তা ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করলে, ভিডিওটি ইন্টারনেটে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।