স্বর্ণের অন্ধকার দিক

maxresdefault (24)
কি কেন কিভাবে

স্বর্ণের অন্ধকার দিক

ভূমিকা

হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের কাছে ক্ষমতা, ঐশ্বর্য আর সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে আছে স্বর্ণ বা সোনা। রাজাদের মুকুট থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের গহনা, মূল্যবান স্থাপনা থেকে শুরু করে ব্যাংকের ভল্টে থাকা গোল্ড বার, সবখানেই সোনার রাজত্ব। শুধু সৌন্দর্য নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও স্বর্ণ এক ধরনের নিরাপদ আশ্রয়। যখনই যুদ্ধ, মহামারি বা মুদ্রার দাম পড়ে যায়, মানুষ ছুটে যায় সোনার দিকে।

স্বর্ণের যেমন আভিজাত্য আছে, তেমনি আছে অনেক অন্ধকার, রহস্যময় অধ্যায়। সোনার বাজারের পিছনে লুকিয়ে আছে যুদ্ধ, শিশুশ্রম, মানবাধিকার লঙ্ঘন আর দুর্নীতির গল্প।

স্বর্ণের পেছনে লুকিয়ে থাকা কালো অধ্যায় !

বৈধ বনাম অবৈধ স্বর্ণ

সুন্দর এই ঝলমলে ধাতুর পেছনে লুকিয়ে আছে বহু মানুষের রক্ত আর অশ্রুর গল্প। সাধারণত পৃথিবীতে যত স্বর্ণ উত্তোলন হয়, তার একটি বড় অংশই অবৈধ। এই অবৈধ সোনা বিভিন্ন ধাপে দুর্নীতির মাধ্যমে বৈধ করা হয়, যেন বৈধ সোনার সঙ্গে তা সহজেই বাজারে মিশে যেতে পারে।

বৈধ সোনা বলতে সেইসব সোনাকে বোঝানো হয়, যা আইন মেনে, লাইসেন্সপ্রাপ্ত খনি থেকে উত্তোলন করা হয়। এর সঙ্গে থাকে বৈধ নথি, যেখানে উল্লেখ থাকে কোন সোনা কোন খনি থেকে এসেছে, কে রপ্তানি করছে, কোন দেশে যাচ্ছে—এই সব বিস্তারিত তথ্য। এই নথির ভিত্তিতে সোনার ওপর কর, শুল্ক এবং পরিবেশগত শর্ত সবই মেনে চলতে হয়। বৈধ সোনার পুরো প্রক্রিয়াটিই স্বচ্ছ এবং নিয়ন্ত্রিত থাকে।

অন্যদিকে অবৈধ সোনা এর সম্পূর্ণ উল্টো। কোনো সরকারি অনুমোদন ছাড়া, প্রাকৃতিক সংরক্ষিত এলাকা বা জঙ্গল কেটে, নদীর তলা খুঁড়ে, স্থানীয় মানুষের জীবন বিপন্ন করে যে সমস্ত সোনা উত্তোলন করা হয়, সেগুলোকে অবৈধ সোনা বলা হয়। এসব সোনার কোনো বৈধ কাগজপত্র থাকে না। সাধারণত মাদক ব্যবসায়ী, অপরাধী চক্র বা সন্ত্রাসী সংগঠন এই সোনা উত্তোলন এবং বিক্রির সঙ্গে যুক্ত থাকে, যাতে তাদের কালো টাকা সাদা করা যায়। ফলে স্বর্ণের ঝলকের পেছনে লুকিয়ে থাকে এক অন্ধকার অর্থনৈতিক চক্র।

স্বর্ণের কালো অধ্যায়: রক্ত মেশানো সোনা

বিশ্বের একটি বড় অংশের স্বর্ণের বাজার চলে “আর্টিজানাল মাইনিং” বা ছোট আকারের খননকারীদের মাধ্যমে। এরা প্রায়ই কোনো লাইসেন্স ছাড়াই সোনা তোলে। আর এই সোনাই কালোবাজারে মিশে যায়। মাফিয়া, বিদ্রোহী গোষ্ঠী বা সন্ত্রাসী সংগঠন এভাবে সোনা বিক্রি করে অস্ত্র কেনে, যুদ্ধ চালায়। আফ্রিকার কিছু এলাকায় “রক্ত মেশানো সোনা” নামে পরিচিত এই স্বর্ণই অনেক গৃহযুদ্ধের অর্থের মূল জোগানদাতা।

দক্ষিণ আমেরিকার পেরু, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা এবং আফ্রিকার কঙ্গো, সুদান, ঘানার মতো দেশে অসংখ্য ছোট ছোট খনি রয়েছে, যেখানে মূলত অবৈধভাবে সোনা তোলা হয়। এই খনিগুলোর শ্রমিকরা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কাজ করে। শুধু তাই নয়, ছোট খনিগুলো থেকে সোনা উত্তোলনের সময় পারদ এবং সায়ানাইডের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, যা নদীর পানিতে মিশে গিয়ে ব্যাপক প্রাকৃতিক ও মানবিক বিপর্যয় ঘটায়। ফলে এই সোনার প্রতিটি কণায় লুকিয়ে থাকে মানবিক বিপর্যয়ের গল্প। অনেক সোনা আসে এমন দেশ থেকে, যেখানে খনিগুলোতে কাজ করে শিশু শ্রমিকরা। তারা কখনও স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় না।

অবৈধ সোনার উত্তোলনের কারণে আমাজন বনের বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রতি বছর কয়েক হাজার হেক্টর বনভূমি কেটে ফেলা হচ্ছে নতুন নতুন স্বর্ণের আশায়। সেই সাথে নদী-নালা দূষিত হচ্ছে পারদ এবং অন্যান্য রাসায়নিক দিয়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, পেরুর কিছু নদীতে পারদের মাত্রা আন্তর্জাতিক সীমার প্রায় ১০ গুণ বেশি। সেই নদীর মাছ খেয়ে স্থানীয় জনগণ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। তাদের দেহে পারদের মাত্রা বাড়তে বাড়তে তা ভয়ঙ্কর রোগের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

শুধু পরিবেশ নয়, সমাজের উপরও এর প্রভাব অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। অবৈধ খনিগুলো পরিচালনা করছে ড্রাগ কার্টেল, মাফিয়া বা স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। সোনার খনিতে কাজ করা হত দরিদ্র এসব মানুষ, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যে সামান্য স্বর্ণ খুঁজে পায়, তা থেকেও আবার মাফিয়াদের চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে শ্রমিকদের মারধর বা হত্যা করা একটি সাধারণ ঘটনা। এমনকি লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু জায়গায় সোনার খনির ভেতরে গণকবরের সন্ধানও পাওয়া গেছে।

পৃথিবীর এমন খুব কম সোনাই আছে, যার জন্য কাউকে প্রাণ দিতে হয়নি। অর্থাৎ, আমরা যে মূল্যবান স্বর্ণ ব্যবহার করছি, তার দাম শুধু এর দুষ্প্রাপ্যতার জন্য নয়, বরং এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে কোনো না কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জীবনের মূল্য।

কালো টাকার খেলা আর মানি লন্ডারিং

বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের চাহিদা, সরবরাহ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ, আর ডলারের দামের ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম নির্ধারিত হয়। লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, জুরিখ এবং দুবাই হল স্বর্ণের বৈশ্বিক বাণিজ্যের কেন্দ্র।

বিশ্বে বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার টন স্বর্ণ উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সোনা আসে চীন, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আর সবচেয়ে বেশি সোনা কেনে ভারত আর চীন। ভারতীয় উপমহাদেশে বিয়ে-শাদি, উৎসব-অনুষ্ঠানে সোনার চাহিদা আকাশচুম্বী। আবার বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সোনা কিনে রাখে, যাতে তাদের মুদ্রা বা অর্থনীতি বিপদে পড়লে সোনা বিক্রি করে পরিস্থিতি সামলাতে পারে।

স্বর্ণের বাজার শুধু যুদ্ধ বা শিশুশ্রম নয়, জড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর অর্থপাচারের সাথে। বিশ্বের বড় মুদ্রা পাচারের একটি উপায় হলো সোনা। কেননা, সোনা ছোট জায়গায় অনেক বেশি মূল্য ধারণ করতে পারে। তাই কর ফাঁকি এবং মানি লন্ডারিং এর এক মোক্ষম হািতয়ার হল সোনা পাচার।

মায়ামি, দুবাই, সিঙ্গাপুর এবং হংকং এর মত কিছু শহরে গোল্ড “রিফাইনিং” বা পরিশোধনের নামে কালোবাজারের সোনা বৈধ হয়ে যায়। অবৈধ সোনা গলিয়ে বৈধ সোনার সাথে মিশিয়ে দিলে আর বোঝার কোন উপায় থাকে না যে, কোন সোনা কোথা থেকে এসেছে। এভাবে পাচারকৃত সোনা সহজেই বৈধ বাজারে ঢুকে যায়।

World Gold Council

বিশ্বের কোথায় সোনা উৎপাদন হচ্ছে, কোন দেশে সোনার চাহিদা বেশি, বিশ্ব বাজারে স্বর্ণের দাম কত হবে, এসব বিষয় নিয়ে কাজ করে World Gold Council বা সংক্ষেপে WGC।

১৯৮৭ সালে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর সদর দপ্তর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। WGC মূলত বিশ্বব্যাপী স্বর্ণ শিল্পের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। সহজভাবে বললে, স্বর্ণের বাজার নিয়ে গবেষণা, ডাটা সংগ্রহ, বিশ্লেষণ আর স্বর্ণের চাহিদা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়াই তাদের কাজ।

WGC প্রতি বছর বিশাল বিশাল রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাদের Gold Demand Trends Report এ কোন দেশে কত সোনা কিনছে, শিল্প-কারখানায় কত সোনা ব্যবহার হচ্ছে, বিনিয়োগের ধরণ কীভাবে বদলাচ্ছে এইসব তথ্য থাকে। সাংবাদিক, বিনিয়োগকারী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এবং সরকারের কাছে এই রিপোর্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ।

WGC চায়, মানুষ শুধু গহনার জন্য নয়, বিনিয়োগ হিসেবেও সোনায় আগ্রহী হোক। তাই তারা বিভিন্ন দেশে স্বর্ণ-নির্ভর ফাইন্যান্সিয়াল প্রোডাক্ট তৈরি করতে সাহায্য করে। যেমন—গোল্ড ETF বা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগযোগ্য এক ধরনের সোনা, ডিজিটাল গোল্ড, বা গোল্ড সেভিং স্কিম। তাদের উদ্দেশ্য হল মানুষকে বোঝানো যে, সোনা শুধু অলঙ্কার নয়, বরং অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

সোনার মান নিয়ে যাতে বিশ্বজুড়ে কোনো বিভ্রান্তি না থাকে, সেজন্য WGC বিভিন্ন মানদণ্ড তৈরি করে। যেমন—Responsible Gold Mining Principles, যেখানে বলা আছে, কীভাবে সোনা তোলা হবে যাতে মানুষ, প্রকৃতি আর সমাজের ক্ষতি না হয়।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল রেসপনসিবল গোল্ড মাইনিং প্রিন্সিপলস (Responsible Gold Mining Principles) নামের একটি প্রোগ্রাম চালু করেছে। এর মাধ্যমে তারা পরিবেশবান্ধব উপায়ে, শিশু শ্রম ছাড়া এবং মানবাধিকার রক্ষা করে সোনা উত্তোলন নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। তবে তাদের এই উদ্যোগ এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। তাই এখনও বিশ্বব্যাপী মানুষের স্বর্ণের চাহিদা মেটানোর জন্য কোথাও না কোথাও, কাউকে না কাউকে প্রান দিতে হচ্ছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।