স্পেস এলিভেটর মহাকাশে যাওয়ার ভবিষ্যৎ সিঁড়ি
স্পেস এলিভেটর মহাকাশে যাওয়ার ভবিষ্যৎ সিঁড়ি
ভূমিকা
স্পেস এলিভেটর বা মহাকাশ লিফট হলো এমন একটি কাল্পনিক প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে হয়ত রকেট ছাড়াই মহাকাশে যাওয়া যেতে পারে। উঁচু বিল্ডিংয়ে সহজে ওঠার জন্য আমরা যেমন সিঁড়ির বদলে লিফট ব্যবহার করি, ঠিক তেমনি, এই স্পেস এলিভেটর ব্যবহার করে রকেটের বিপুল পরিমাণ জ্বালানী না পুড়িয়েই, অত্যন্ত কম খরচে পৃথিবী থেকে মহাকাশে পৌঁছানো যেতে পারে।
বর্তমানে রকেটে চড়ে মহাকাশে যাওয়ার সময় পৃথিবীর অভিকর্ষ বল রকেটকে নিচের দিকে টেনে রাখে। এই টান কাটিয়ে মহাকাশে পৌঁছাতে রকেটের যে শক্তি উৎপন্ন করতে হয়, তাতে খরচ হয় হাজার হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু যদি এমন একটি বৈদ্যুতিক লিফট বানানো যায়, যার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে মহাকাশে বারবার ওঠা নামা করা যাবে, তাহলে মহাকাশযাত্রা হবে অনেক সহজ, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী। স্পেস এলিভেটর ধারণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সেই স্বপ্নই দেখছেন। এমন যন্ত্র এখনও বাস্তবে বানানো সম্ভব হয়নি। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতির ফলে মহাকাশ লিফট ঘিরে আশার আলো দিন দিন বাড়ছে। ভবিষ্যতের একদিন হয়তো সত্যিই আমরা লিফটে চড়ে মহাকাশে ভ্রমণে যেতে পারব!
স্পেস এলিভেটরের ধারণা
স্পেস এলিভেটরের ধারণা কিন্তু একেবারে নতুন নয়। ১৮৯৫ সালে রাশিয়ান মহাকাশ বিজ্ঞানী কন্সট্যানটিন সাওকোভস্কি তাঁর Dreams of Earth and Sky বইতে একটি কাল্পনিক টাওয়ারের কথা লিখেছিলেন, যা ৩৬ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ। যদিও তিনি এ ব্যপারে বিস্তারিত কোনো আলোচনা বা হিসাব-নিকাশ দেখাননি। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে আরেক রাশিয়ান বিজ্ঞানী তাঁর এক লেখায় (To the Cosmos by Electric Train) একটি স্যাটেলাইটের কথা বলেন। সে স্যাটেলাইট থেকে একটি লম্বা তার পৃথিবীর দিকে আসবে এবং অন্য একটি তার মহাকাশের দিকে যাবে। এ তার বেয়ে মহাকাশযান ভ্রমণ করবে। তাঁর কাছে বিষয়টা ছিল একটি ‘মহাকাশীয় রেলগাড়ি’র মতো।
একটি স্পেস এলিভেটর তৈরি হবে চারটি মূল অংশ নিয়ে- ১. Tether/cable ২. Anchor ৩. Counterweight এবং ৪. Climbers।
Tether বা cable হল লম্বা তারের মতো অংশ। এটি বেশ শক্তিশালী পদার্থ দ্বারা তৈরি হতে হবে। Anchor হল জাহাজ যেমন নোঙর করা থাকে তেমনি স্পেস এলিভেটরটিও পৃথিবীর একটি স্থানে মাটির সাথে খুবই দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত থাকবে। Counterweight অংশটি তারের অপরপ্রান্তে যুক্ত থাকবে। যেখানে থাকবে একটি স্পেস স্টেশন। এটি মহাকাশযান উড্ডয়নের স্টেশন হিসেবে কাজ করবে। এখান থেকেই মহাকাশযান বা স্যাটেলাইট মহাশূন্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। এবং সবশেষে Climbers পৃথিবীতে থাকা অ্যাঙ্কর থেকে উপরের স্টেশন পর্যন্ত যাওয়ার জন্য কাজ করবে। একে তুলনা করা যেতে পারে বর্তমানের বিল্ডিংয়ে থাকা লিফটের সাথে।
স্পেস এলিভেটর কল্পনা
স্পেস এলিভেটর কেমন হবে তা কল্পনা করা কিন্তু খুব বেশি কঠিন নয়। মনে করুন একটি শিশু তার একটি খেলনার এক মাথায় এক টুকরো সুতা বেঁধে,সুতার অন্য মাথা ধরে ঘুরাতে শুরু করল। এবার একটি পিঁপড়া শিশুর হাত থেকে সুতা বেয়ে খেলনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটিই হল ছোট্ট একটি স্পেস এলিভেটর। শিশুর হাতে শক্ত করে যে সুতাটি ধরে রেখেছে সেটা এক্ষেত্রে অ্যাঙ্কর বা নোঙর হিসেবে কাজ করছে। সুতাটি হলো ক্যাবল আর খেলনাটি হল স্পেস স্টেশন।
সত্যিকারের স্পেস এলিভেটর তৈরিতে আরও কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। সুতা দিয়ে খেলনা ঘুরানোর সময় শিশুটি তার ইচ্ছামতো ঘুরিয়েছে। কিন্তু স্পেস এলিভেটরকে তো আর আমরা হাত দিয়ে ঘুরাবো না, বরং একে ঘুরানো হবে পৃথিবীর ঘূর্ণনের মাধ্যমে। এখানেও রয়েছে কিছুটা জটিলতা। পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকে ঘুরাতে চাইলে হবে না। স্পেস এলিভেটরের নোঙর স্থাপন করতে হবে পৃথিবীর বিষুব রেখা বরাবর। আর যেহেতু এর জন্য বিশাল জায়গার প্রয়োজন, তাই এটি তৈরি করা হবে আটলান্টিক মহাসাগরে।
ঘুরন্ত অবস্থায় যদি হঠাৎ সুতাটি ছিঁড়ে যায় তাহলে কী হবে? নিশ্চয়ই খেলনাটি ছিটকে পড়ে যাবে। খেলনাটি কিন্তু ঘোরার সময় সর্বদাই এভাবে ছিটকে যেতে চায় কিন্তু সুতার কারণে তা পারে না। ঠিক তেমনি পৃথিবীর বাইরে কোনোকিছু ঘুরলে সেটারও এরকম ছিটকে চলে যাওয়ার প্রবণতা (জড়তা) থাকে যদিও পৃথিবীর আকর্ষণের কারণে তা আর সম্ভব হয় না।
পৃথিবীর চারদিকে আবর্তনশীল কোনো বস্তুর কৌণিক বেগ যদি পৃথিবীর সমান হয় তবে বস্তুটি পৃথিবী থেকে ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার দূরে বস্তুটির ছিটকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ দূরত্বে পৃথিবীর চারদিকে একটি বৃত্তাকার পথ কল্পনা করা হয় যাকে বলা ভূস্থির কক্ষপথ। কারণ এখানে কোনো স্যাটেলাইট থাকলে তা থেকে সর্বদাই পৃথিবীর একই স্থান দেখা যায়। এ অবস্থায় সে স্যাটেলাইটের উপর কোনো বল থাকে না। এখন এ দূরত্বে আমদের স্পেস স্টেশন থাকলে ক্যাবলে কোনোই টান পড়বে না। কিন্তু ক্যাবলটিকে টানটান রাখতে হলে স্পেস স্টেশনটিকে ভূস্থির কক্ষপথ থেকে আরও দূরে রাখতে হবে। এ দূরত্ব হতে পারে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ কিলোমিটার।
স্পেস এলিভেটরের ক্যাবল
স্পেস এলিভেটর নির্মাণ করা সম্ভব হলে নিঃসন্দেহে এটি হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপনা; যার বিস্তৃতি হবে ভূমি থেকে দিগন্তের আকাশ ছাড়িয়ে আরও উপরে। কিন্তু এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এখনও বেশ কিছু বাঁধা রয়েছে। স্পেস এলিভেটরের ৪ টি অংশের মধ্যে ক্যাবল ছাড়া অন্য সবগুলোই কোনো না কোনোভাবে তৈরি করা সম্ভব। দুটি স্পেস স্টেশনও বর্তমানে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। ক্লাইম্বার কিংবা অ্যাঙ্কর কোনোটিই বিজ্ঞানীদের খুব বেশি মাথাব্যথার কারণ নয়। তবে একটি মহাকাশযানকে পৃথিবী থেকে স্পেস স্টেশন পর্যন্ত পৌছাতে যে শক্তিশালী আর দীর্ঘ ক্যাবল প্রয়োজন তা তৈরি করাই এখন মূল ভাবনা। পৃথিবীর আকর্ষণ বলের তারতম্যের কারণে স্পেস এলিভেটরের ক্যাবলটি পৃথিবীর তুলনায় স্পেস স্টেশনের কাছে বেশি শক্তিশালী হতে হবে। অর্থাৎ পৃথিবীর কাছে ক্যাবল যতটা মোটা, স্পেস স্টেশনের কাছে তার চাইতে বেশি মোটা হতে হবে।
এখন অনেকেই মনে করবে এই শক্তিশালী ক্যাবলটি স্টিল দিয়ে তৈরি করা হবে। কিন্তু না, শক্তিমত্তার তুলনায় স্টিলের ভর এতই বেশি যে, তা দিয়ে এ ক্যাবল তৈরি করা অসম্ভব। এজন্য বিজ্ঞানীরা বিকল্প পদার্থের সন্ধানে রয়েছেন। কেভলার, গ্রাফিন কিংবা কার্বন ন্যানোটিউব সহ বিভিন্ন পদার্থ নিয়ে গবেষণা চলমান রয়েছে। তবে ক্যাবল তৈরির জন্য বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে আশা দেখছেন কার্বন ন্যানোটিউবে। এটি কার্বনের তৈরি একটি পদার্থ যার শক্তি স্টিলের চাইতে ১০০ গুণ বেশি। পাশাপাশি এটি ওজনে অনেক হালকা এবং উচ্চতাপ সহ্য করতে পারে। বিপত্তিটা হলো, এখন পর্যন্ত খুব বেশি লম্বা কার্বন ন্যানোটিউব তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সর্বোচ্চ যেটি তৈরি হয়েছে তারও দৈর্ঘ্য মাত্র ৫০ সেন্টিমিটার। স্পেস এলিভেটরের জন্য যে বিপুল পরিমাণ কার্বন ন্যানোটিউব প্রয়োজন তার যোগান দিতে এখনো অনেক পথ বাকি।
স্পেস এলিভেটর তৈরির পথে বাঁধা
ভবিষ্যতে যদি ক্যাবল তৈরি সম্ভবও হয়, তবুও স্পেস এলিভেটর তৈরির পথে বাঁধা রয়েছে। কারণ আমাদের পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য Space Junk বা মহাকাশ বর্জ্য। এগুলো হলো বিভিন্ন পুরাতন স্যাটেলাইট আর রকেটের ধ্বংসাবশেষ। মহাকাশে থাকা ১ সেন্টিমিটারের চাইতে ছোট এমন টুকরার সংখ্যা ১২০ মিলিয়ন! স্পেস এলিভেটর তৈরি হলে এর ক্যাবল কিংবা স্পেস স্টেশনে প্রতিনিয়ত এসব জাঙ্ক আঘাত করবে। তাছাড়া পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে যত উপরের দিকে যাওয়া যায় ততই রেডিয়েশনের প্রভাব বাড়তে থাকে। এর কারণেও ক্যাবলটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কোনো কারণে এ ক্যাবল ছিঁড়ে গেলে যে পৃথিবীর উপর মহাদুর্যোগ নেমে আসবে তা বলাই বাহুল্য। এ সমস্যা মোকাবেলার উপায় বিজ্ঞানীদের খুঁজে বের করতে হবে। আবার ক্যাবল বেয়ে যে ক্লাইম্বার ভ্রমণ করবে তার জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল পরিমাণ শক্তির। এ শক্তির যোগান কোথা থেকে আসবে সেটাও একটা ভাবনার বিষয়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়ার কিংবা সৌরশক্তির কথা ভাবছেন।
রকেটে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম মহাকাশে পাঠানো হয়, এগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় পে-লোড। এই পে-লোড যত ভারী হয়, রকেটের জ্বালানিও তত বেশি লাগে। বর্তমান সময়েও বেশিরভাগ রকেট একবার ব্যবহার করেই ফেলে দিতে হয়। তাই মহাকাশ ভ্রমণ এখনো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যদি বাস্তবেই স্পেস এলিভেটর তৈরি করা সম্ভব হয়, তাহলে মহাকাশযানে প্রতি কেজি পে-লোড বহনের খরচ ২০ হাজার ডলার থেকে কমে হবে মাত্র ২০০ ডলার!