স্টারলিংক বাংলাদেশে আসলে লাভ না ক্ষতি
স্টারলিংক বাংলাদেশে আসলে লাভ না ক্ষতি
ভূমিকা
ইলোন মাস্কের রকেট কম্পানি স্পেসএক্স-এর স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক। পৃথিবী নিম্ন কক্ষপথে হাজার হাজার স্যাটেলাইটের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, স্টারলিংক বিশ্বব্যাপী উচ্চ-গতির ইন্টারনেট সরবরাহ করে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও স্টারলিংক তাদের ইন্টারনেট সেবা চালু করার লাইসেন্স পেয়েছে। (নিউজ) বাংলাদেশে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবার অনুমোদন দেশীয় প্রযুক্তি খাতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
স্টারলিংক প্রকল্প
বর্তমানে আমরা যে ইন্টারনেট ব্যবহার করি, তার পুরোটাই সমুদ্রের নিচ দিয়ে স্থাপিত তারের সাহায্যে যুক্ত। এসব তারকে বলা হয় সাবমেরিন কেবল। সাবমেরিন কেবল স্থাপন এবং রক্ষনাবেক্ষণ বেশ ব্যয়বহুল। এবং এসব ক্যাবলে নিয়মিতই নানা সমস্যা দেখা দেয়। তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ন বিষয় হল, পৃথিবীর বহু জায়গায় এসব সাবমেরিন ক্যাবল পৌছানো সম্ভব নয়। সেকারণে বহু দুর্গম এবং অনুনন্নত এলাকা ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত।
বিশ্বের মোট ৭৯০ কোটি মানুষের মধ্যে ৪৬০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তারমানে বর্তমান পথিবীর প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এখনও ইন্টারনেট সেবার আওতার বাইরে রয়েছে। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক লোক ইন্টারনেট বঞ্চিত থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হল, পৃথিবীর সব জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে সহজে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার জন্য, বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলোন মাস্ক তার স্টারলিং ইন্টারনেট কম্পানির যাত্রা শুরু করেছেন। স্টারলিংকের উদ্দেশ্য হল পৃথিবীর নিকট মহাকাশে প্রায় ৪২ হাজার স্যাটেলাইট স্থাপন করে, আমাদের গ্রহের প্রতিটি কোনায় দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করা।
এখনও পর্যন্ত স্টারলিংক প্রায় ৭,০০০টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। তবে এর মধ্যে কিছু স্যাটেলাইট ডি-অরবিট বা নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। বর্তমানে স্টারলিংকের প্রায় ৬,০০০ স্যাটেলাইট কার্যকর অবস্থায় কক্ষপথে রয়েছে।
স্টারলিংক স্যাটেলাইট
অতীতেও বেশ কিছু কম্পানি স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট প্রদান করেছে। এই কাজে ব্যবহৃত স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরের কক্ষপথে স্থাপন করা হত। পৃথিবী থেকে অনেক দূরে হবার কারণে সেগুলোর তথ্য আদান প্রদান ক্ষমতা বেশ দুর্বল ছিল। একে তো ধীর গতির ইন্টারনেট, তার উপর অতীতের স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেটের খরচও ছিল অনেক ব্যয়বহুল। আর এখানেই ব্যবসার নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন, বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলোন মাস্ক। তিনি কম খরচে দ্রুত গতির স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার জন্য ২০১৫ সালে স্টারলিংক প্রজেক্ট শুরু করেছিলেন।
প্রচলিত ইন্টারনেট স্যাটেলাইটগুলোর তুলনায় স্টারলিংকের স্যাটেলাইট পৃথিবীর প্রায় ৬৫ গুণ কাছাকাছি অবস্থান করে। স্টারলিংকে স্যাটলাইটগুলো তিনশ থেকে এক হাজার কিলোমিটারের মধ্যে থাকা কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। এত কাছে থাকার কারণে এদের ইন্টারনেটের গতিও অনেক বেশি। এছাড়াও এসব স্যাটেলাইটের অধিক সংখ্যার কারণে পৃথিবীর সব জায়গায়, সবসময় দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা দেওয়া সম্ভব।
স্টারলিংকের স্যাটেলাইটগুলো লেজারের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। এর ফলে স্যাটেলাইটগুলো আলোর গতিতে তথ্য আদান প্রদান করতে পারে। স্টারলিংকের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, তাদের ইন্টারনেটের সংযোগে প্রায় ১০০ থেকে ২০০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট পাওয়া যায়।
স্টারলিংক কিভাবে কাজ করে
গ্রাহককে স্টারলিংক ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য এক ধরনের ট্রান্সসিবার বা এন্টেনা ব্যবহার করতে হয়। এদেরকে বলা হয় স্টারলিংক টার্মিনাল। এগুলো স্যাটেলাইট টেলিভিশনের ডিশ এন্টেনার মত কাজ করে। এসব এন্টেনার তার একটি ওয়াইফাই রাউটারের সাথে যুক্ত করতে হয়। এরপর সেই রাউটার থেকে স্টারলিংক ইন্টারনেটের দ্রুতগতির সংযোগ পাওয়া সম্ভব। স্টারলিংক টার্মিনাল খোলা আকাশের নিচে স্থাপন করতে হয়। যাতে সরাসরি মহাকাশে থাকা স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। টার্মিনালের সাথে বিশেষ ধরনের মোটর লাগানো থাকে, যার সাহায্যে টার্মিনাল নিজে নিজেই স্যাটেলাইটের অবস্থানের সাথে সাথে রিসিভারের দিক পরিবর্তন করতে পারে।
স্টারলিংকের ওয়েবসাইটে বলা আছে, এই ইন্টারনেট সেবা নিতে স্টারলিংক কিট কিনতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে একটি রিসিভার বা অ্যানটেনা, কিকস্ট্যান্ড, রাউটার, তার ও বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা বা পাওয়ার সাপ্লাই। এর মূল্য ৩৪৯ থেকে ৫৯৯ ডলার পর্যন্ত বা ৪২ হাজার থেকে ৭২ হাজার টাকার মধ্যে। আবাসিক গ্রাহকদের জন্য স্টারলিংকের মাসিক সর্বনিম্ন ফি ১২০ ডলার; বা প্রায় ১৫ হাজার টাকা। তবে করপোরেট গ্রাহকদের জন্য স্টারলিংক কিটের দাম ও মাসিক ফি দ্বিগুণের বেশি।
পর্যাক্রমে ১২ হাজার স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো হলে, স্টারলিংক পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় ইন্টারনেট সেবা দিতে পারবে। এবং স্টারলিংকের ইন্টারনটে সেবা সর্বোচ্চ সুবিধাজনক পর্যায়ে পৌছাবে, যখন তারা ৪২ হাজার স্যাটেলাইট মহাকাশে স্থাপন করতে পারবে। তখন হয়ত স্টারলিংক ইন্টারনেট সবামেরিন কেবলের চেয়েও দ্রুতগতির সংযোগ প্রদান করবে।
২০১৯ সালের অক্টোবরে ইলোন মাস্ক সর্বপ্রথম স্টারলিংক ইন্টারনেট ব্যবহার করে একটি টুইট করেন। তার পরের বছর ২০২০ সালের অক্টোবরে স্টারলিংক পরীক্ষামূলকভাবে তাদের গ্রাহকদের সেবা প্রদান শুরু করে।
বাংলাদেশে স্টারলিংক
বাংলাদেশে স্টারলিংক পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালানোর পর, ১৭০-২২০ এমবিপিএস পর্যন্ত গতির ইন্টারনেট পাওয়া গেছে। (নিউজ) স্টারলিংকের স্যাটেলাইট-ভিত্তিক প্রযুক্তি পাহাড়ি, দ্বীপ, চর, ও গ্রামীণ এলাকায় উচ্চ-গতির ইন্টারনেট পৌঁছে দেবে, যেখানে ফাইবার অপটিক বা মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছানো কঠিন। এটি ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, এবং ই-কমার্স খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে, বিশেষ করে গ্রামীণ উদ্যোক্তা ও ফ্রিল্যান্সারদের জন্য। তাছাড়া দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বা লোডশেডিংয়ের সময় নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ নিশ্চিত করবে, যা ব্যবসা ও জরুরি সেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
দেশের বাজারে স্টারলিংক প্রবেশের পর স্থানীয় আইএসপি বা ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের ইন্টারনেট সেবার দাম কয়েক ধাপে কমানো হয়েছে। (নিউজ) তারপরও স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা এই খাতে জড়িত ২০ লক্ষ মানুষের জীবিকার জন্য হুমকি হতে পারে।
স্টারলিংকের সবচেয়ে বড় যে সুবিধার কথা বলা হচ্ছে যে, এখন আর কোন সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করতে পারবে না। এই ধারণাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। বিটিআরসি’র খসড়া নির্দেশিকা অনুযায়ী, স্টারলিংককে বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে ব্যবহার করেই ব্যান্ডউইথ রাউট করতে হবে। এরফলে সরকার যদি কখনো ইন্টারনেট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে স্টারলিংকের রুটও বন্ধ হয়ে যাবে।
আর যদি স্টারলিংক বাংলাদেশের গেটওয়ে ব্যবহার না করে, তাহলেও সমস্যা; কারণ সেক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব বেটিং সাইট, পর্নোগ্রাফিক সাইট, ক্যাসিনো সাইট ও ডার্ক ওয়েব ব্লক করে রাখা হয়েছে, সেগুলো স্টারলিংকের সাথে উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
স্টারলিংকের আরেকটি বড় সুবিধা হিসেবে দেখানো হয়েছে যে, এর মাধ্যমে দেশে নতুন বিনিয়োগ আসবে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে উল্টো। স্টারলিংক বরং দেশের টাকা বিদেশে নিয়ে যাবে। কারণ স্টারলিংক বাংলাদেশে কোনো স্যাটেলাইট তৈরি করবে না, উৎক্ষেপণও করবে না। সেই সাথে যারা স্টারলিংকের বাংলাদেশী ডিস্ট্রিবিউটর হবে, তাদেরকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ স্টারলিংককে পরিশোধ করতে হবে। তাছাড়া স্টারলিংকের ব্যবহারকারীদের প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিতে হবে। যদিও দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে স্টারলিংকের ইন্টারনেট নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা হল অধিকাংশ সাধারণ গ্রাহকেরই স্টারলিংকের ইন্টারনেট ব্যবহার করার সামর্থ নেই। সেক্ষেত্রে দেশের ব্যাংকিং এবং কর্পোরেট সেক্টর হয়ত তাদের নিরবচ্ছিন্ন সংযোগের চাহিদার কারণে উচ্চমূল্যের বিনিময়েও স্টারলিংকের প্রধান গ্রাহক হয়ে উঠতে পারে।
যেহেতু স্টারলিংকের কোন টাওয়ার নেই; তাই এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশে কোন কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হবে না। তারমানে এতদিন ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য যে অর্থ আমরা খরচ করতাম তার পুরোটাই বিদেশে চলে যাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ এলাকাতেই উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সংযোগ রয়েছে। এই অবকাঠামো সম্পূর্ণ দেশীয় বিনিয়োগের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে। সরকারি হিসাবে দেশে দেড় কোটি ব্রডব্যান্ড সংযোগ রয়েছে, তবে বাংলাদেশের আইএসপি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে প্রকৃত ব্রডব্যান্ড সংযোগের সংখ্যা ৪ কোটির কম নয়। ধারণা করা হয় দেশীয় আইএসপিগুলো প্রতি মাসে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা বা বাৎসরিক ২৪,০০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে। এত বিপুল পরিমাণ অর্থের যদি একটি অংশও বিদেশে চলে যায়, তবে তা দেশের অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক হবে।