সেরা মার্কিন যুদ্ধ বিমান F-22 Raptor
সেরা মার্কিন যুদ্ধ বিমান F-22 Raptor
ভূমিকা
আশির দশকে স্নায়ুযুদ্ধ যখন উত্তেজনার তুঙ্গে, আমেরিকার বিমান বাহিনী তখন এমন কিছুর খোঁজে ছিল, যা দিয়ে তারা আকাশসীমায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর সেখান থেকেই আসে ইতিহাস বদলে দেওয়া আমেরিকান ফাইটার জেট F-22 Raptor। আমেরিকার তো বটেই, এটি বিশ্বের প্রথম পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার জেট। ১৯৯৬ সালে এর উৎপাদন শুরু হয় আর আমেরিকার সামরিক বহরে যুক্ত হয় ২০০৫ সালে। এসব একেকটি F-22 বিমান তৈরী করতে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়। এখনও পর্যন্ত মোট ১৯৫টি F-22 Raptor তৈরি হয়েছে। অন্যকোন দেশ যাতে আমেরিকার মত এমন সেরা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অর্জন করতে না পরে, সেকারণে ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইন পাশ করে F-22 বিমান বিদেশে রপ্তানি নিষিদ্ধ করে।
F-22 Raptor এর সূচনা
১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট সর্বাধুনিক ফাইটার জেট তৈরি করার জন্য Advanced Tactical Fighter বা ATF প্রোগ্রাম শুরু করে। ATF প্রোগ্রামের অধীনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিমান ডিজাইনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অনেকগুলো প্রোটোটাইপের মধ্য থেকে YF-22 এবং YF-23 – এ দুটিকে বাছাই করা হয়। ১৯৯০ সালে দুটি বিমানই আকাশে তাদের সক্ষমতার পরীক্ষা দেয়। পরের বছর আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর Lockheed Martin এবং Boeing কোম্পানির তৈরি YF-22 বিমানটিকেই চূড়ান্ত বিজয়ী করা হয়।
F-22 এর প্রধান লক্ষ্যই ছিল আকাশে আমেরিকার আধিপত্য ধরে রাখা। আধুনিক যুদ্ধে আকাশ প্রতিরক্ষা যুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে এ বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর ১৯৬৭ সালে আরব-ইজরাইলের ‘Six Day War’ তো চোখে আঙুল দিয়েই আকাশ প্রতিরক্ষার গুরুত্ব দেখিয়ে দেয়। এজন্যই স্নায়ুযুদ্ধে পরাশক্তির লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে F-22 এর মতো শক্তিশালী ফাইটার জেটের বিকল্প ছিল না।
৬২ ফুট লম্বা এবং ৪৪.৫ ফুট চওড়া F-22 বিমানটি সর্বোচ্চ ৩৮,০০০ কেজি ওজন নিয়ে উড়াল দিতে পারে। F-22 Raptor এ রয়েছে দুটি Pratt & Whitney F119 Turbofan ইঞ্জিন। এতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় কেরোসিন জাতীয় এক ধরনের জ্বালানি যার নাম Jet Propallent 8 (JP8)। এ ইঞ্জিনে রয়েছে ৩ স্টেজের ফ্যান যা বাইরে থেকে প্রচণ্ড বেগে বাতাস টেনে আনে। এ বাতাসকে হাই প্রেশার কম্প্রেসারের দ্বারা সংকুচিত করে টার্বাইনে পাঠানো হয়। তাছাড়া এতে রয়েছে দ্বিমাত্রিক (2D) থ্রাস্ট ভেক্টরিং যার সাহায্যে নজেলকে ২০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঘোরানো সম্ভব, যা বিমানটির ম্যানুভারেবিলিটি বাড়ায়। অর্থাৎ এর শক্তিশালী ইঞ্জিনের কারণে এটি আচমকাই দিক পরিবর্তন করতে পারে, যুদ্ধবিমানের ডগফাইটে যা শক্তিমত্তার অন্যতম পরিচায়ক।
সুপারসনিক গতি
পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার জেটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো Supercruise করার ক্ষমতা, মানে আফটারবার্নার ছাড়াই সুপারসনিক গতিতে চলতে পারার ক্ষমতা। আগের ফাইটার জেটগুলো শব্দের চেয়ে বেশি গতিতে উড়তে চাইলে আফটারবার্নার ব্যবহার করতে হতো। তবে শক্তিশালী ইঞ্জিনের কারণে F-22 আফটারবার্নার ছাড়াই শব্দের গতি অতিক্রম করতে পারে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গতি Mach 1.8 অর্থাৎ শব্দের গতির ১.৮ গুণ পর্যন্ত হতে পারে। তবে F-22 চাইলে আফটারবার্নার ব্যবহার করতে পারে, তখন এর গতিবেগ মাক ২.২৫ পর্যন্ত হতে পারে।
বিশেষ ডিজাইনের কারণে এই বিমানের রাডার ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি। F-22 এর Radar Cross Section বা RCS মাত্র ০.০০০১ বর্গমিটার, রাডারের চোখে যা একটি লোহার মার্বেলের সমান! বিমানটির উপরে প্রথমে Radar Absorbent Material বা RAM এর একটি প্রলেপ (Base Coat) দেওয়া হয়। এর উপরে আরও একটি বিশেষ প্রলেপ (Top Coat) থাকে যা ইনফ্রারেড রশ্মিও শোষণ করতে সক্ষম। রাডারের রেডিও তরঙ্গ যখন F-22 এর উপর পড়ে তখন Radar Absorbent Material তা প্রতিফলন করে না। বরং RAM এর অণুগুলো এ তরঙ্গ শোষণ করে তাপশক্তিতে পরিণত করে।
শত্রু বিমানকে শনাক্ত করতে F-22 এর সামনের দিকে রয়েছে একটি AN/APG-77 AESA Radar। অত্যন্ত দ্রুত সামনের ১২০ ডিগ্রি এলাকা স্ক্যান করতে সক্ষম এ রাডার। এমনকি শত্রু বিমান ৫০০ কিলোমিটার দূরে থাকলেও এটি তা শনাক্ত করতে পারে। এছাড়াও শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য ইলেকট্রনিক যুদ্ধের ব্যবস্থাও রয়েছে এই বিমানে।
ককপিট ও রণকৌশল
F-22 বিমানের ককপিট সাজানো হয়েছে উন্নত সব প্রযুক্তির সমন্বয়ে। এতে রয়েছে Heads Up Display (HUD) এবং Multi Function Display (MFD)। উপরের দিকে থাকা HUD এ বিমানের বেগ, উচ্চতাসহ টার্গেটের তথ্য দেখা যায়। আর মাল্টিফাংশন ডিসপ্লেতে দেখা যায় উড্ডয়ন এলাকার ম্যাপ, বিভিন্ন সেন্সর থেকে প্রাপ্ত ডেটা ইত্যাদি। বিমানের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাইলটের এক হাতে থাকে থ্রটল আর অন্য হাতে স্টিক। থ্রটলের সাহায্যে ইঞ্জিনের শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে বিমানের গতি বাড়ানো-কমানো যায়। আর স্টিকের কাজ হলো বিমানকে ডানে-বামে কিংবা উপরে-নিচে ম্যানুভার করা।
বিভিন্ন ধরনের ম্যানুভারের সময় বিমানটির পাইলট 9g পর্যন্ত বল অনুভব করতে পারে। আমরা পৃথিবীতে স্বাভাবিক অবস্থায় কেবল 1g অনুভব করতে পারি। কিন্তু ফাইটার জেটের উচ্চ ত্বরণের কারণে পাইলট অভিকর্ষ বলের চেয়ে ৯গুণ পরিমাণ বলের সম্মুখীন হন। যেকোনো সাধারণ মানুষ এ পরিস্থিতিতে পড়লে নিশ্চিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। তবে পাইলটদের রয়েছে দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষণ আর কঠোর পরিশ্রমের অভিজ্ঞতা। তাছাড়া তারা g-suit নামক এক বিশেষ ধরনের পোশাক পরেন যা তাদের এমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে সাহায্য করে।
শত্রু মোকাবেলা করার জন্য F-22 Raptor বিমানে রয়েছে নানা ধরনের অস্ত্রসম্ভার। এতে আছে মিনিটে ৬০০০ হাজার রাউণ্ড ফায়ার করার ক্ষমতাসম্পন্ন M61A2 Vulcan Gun। F-22 বহনকৃত মিসাইলের মধ্যে রয়েছে AIM-120 এবং AIM-9। এগুলো হলো এয়ার টু এয়ার মিসাইল। এছাড়াও রয়েছে GBU-32 JDAM Bombs যা ভূমিতে আক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এসব মিসাইল রাখার জন্য এতে রয়েছে তিনটি Internal Weapon Bay যা শত্রু রাডার ফাঁকি দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও রয়েছে countermeasure bay যাতে আতশবাজির মত Flare থাকে। এগুলো দিয়ে শত্রু পক্ষের মিসাইলকে ধোঁকা দেওয়া যায়।