সি প্লেনে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ
সি প্লেনে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ
সেন্ট মার্টিনে বিধি নিষেধ
বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যটন গন্তব্য সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। প্রতিবছর প্রায় দেড় লাখেরও বেশি লোক এই দ্বীপে ভ্রমণ করে। তবে এখন থেকে চাইলেই পর্যটকরা সেন্টমার্টিন দ্বীপে যেতে পারবেন না। দ্বীপটিতে ভ্রমণের আগে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া দ্বীপে যাওয়ার জন্য সরকারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফিও দিতে হবে। সেই সাথে জারি করা হয়েছে বেশ কিছু নতুন নিয়ম-কানুন। তবে সারাবছর যাতে পর্যটকেরা এই দ্বীপটিতে ভ্রমণ করতে পারে, সেজন্য কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিনে যাতায়াতের জন্য সি প্লেনের ব্যবস্থা করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
অতীতেও সেন্ট মার্টিন নিয়ে অনেক বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তবে তার কোনটিই শতভাগ বাস্তবায়ন করা যায়নি।
অনলাইন রেজিস্ট্রেশন
ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটকেরা ভিড়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ একটু একটু করে তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দ্বীপকে রক্ষায় নড়েচড়ে বসেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পর্যটকদের সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ করতে হলে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এছাড়া দ্বীপে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ফিও দিতে হবে। এমনকি কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন দ্বীপের সঠিক ধারণক্ষমতা অনুযায়ী পর্যটকের সংখ্যা নিশ্চিত করবে ।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা কউক জানিয়েছে, সেন্টমার্টিনকে মালদ্বীপের আদলে গড়ে তোলার জন্য মাস্টার প্ল্যান করা হচ্ছে। সেন্টমার্টিনে পরিবেশবান্ধব স্থাপনা এবং টেকসই পর্যটন গড়ে তোলার জন্য মালদ্বীপের রিসোর্ট গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে কারিগরি পরামর্শ নিয়ে সেন্টমার্টিনকে আকর্ষণীয় করে সাজানো হবে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বছরে মাত্র চার থেকে পাঁচ মাস পর্যটকদের জন্য খোলা থাকে। সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সাগর বেশ শান্ত থাকে। তাই এই সময়টা সেন্ট মার্টিনে যাতায়াতের জন্য কক্সবাজার এবং টেকনাফ থেকে বেশ কিছু জাহাজ এবং সিট্রাক চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। বছরের বাকি সময় সমুদ্র উত্তাল থাকার অযুহাতে, এসব জলযান চলতে দেওয়া হয় না। ফলে বছরের বাকি সময় পর্যটকেরা চাইলেও সেন্ট মার্টিন যেতে পারেন না। তবে কিছু কিছু দুঃসাহসিক পর্যটক, বছরের অন্যান্য সময়, ট্রলার এবং স্পিডবোটে করে সেন্ট মার্টিন যান। যদিও এই ব্যবস্থাটি অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ এবং সকল পর্যটকেরা জন্য উপযোগী নয়। তবে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, এখন থেকে সীমিত পর্যায়ে হলেও সারাবছরই সেন্টমার্টিন যাওয়া যাবে। এর জন্য সি-প্লেন এবং সি ক্রুজ চালু করা হবে।
এর বাইরেও, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দেশের সবচেয়ে বড় মহাপরিকল্পনা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র কেন্দ্রিক পর্যটন ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য, কক্সবাজার টু মহেশখালী এবং কক্সবাজার টু টেকনাফ ক্যাবল কার স্থাপন, সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে বিশাল আন্ডার-সি অ্যাকুরিয়াম, সার্কুলার বাস টার্মিনাল, মেরিনা বে রিসোর্ট, খুরুশকুল স্মার্ট সিটি, থিম পার্ক, ইকো রিসোর্ট সহ নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
কতৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পর্যটন ব্যবস্থা নিয়ে প্রজ্ঞাপনটি জারি করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রজ্ঞাপনের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করার মূল দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে। তাদের কাজে সহযোগিতা করবে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। তবে জেলা প্রশাসন বলছে, এ ব্যাপারে এখনও কোনো আলোচনা হয়নি।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সেন্ট মার্টিন কেন্দ্রিক মহাপরিকল্পনার অন্যতম সরকারি সংস্থা হলেও, নতুন নীতিমালা বাস্তবায়নে তাদের ভূমিকা স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে ট্যুরিস্ট পুলিশ বলছে, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সবার সঙ্গে আলাপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বিলুপ্তি ঠেকাতে ২০২২ সালেও পরিবেশ মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। সেই সাথে বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ‘সেন্ট মার্টিন মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া’হিসেবে ঘোষণা করেছিল সরকার। তারও আগে ১৯৯৯ সালে, সেন্টমার্টিনকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বা Ecologically Critical Area হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এত এত প্রজ্ঞাপন আর জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও সেন্টমার্টিন দ্বীপের ধ্বংস ঠেকানো যায়নি। পর্যটন সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে অনুমোদনহীনভাবে গড়ে উঠেছে শতাধিক হোটেল। এসব দালান গড়ে তুলতে দ্বীপের প্রবাল পাথর ব্যবহারের মত গুরুতর অভিযোগও রয়েছে। পাঁচ বছর আগে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, দ্বীপে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ১০৪টি আবাসিক হোটেল ভেঙে ফেলার কথা ছিল। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, নতুন করে আরো প্রায় অর্ধশতাধিক পাকা দালানকোঠা গড়ে উঠেছে।
সেন্টমার্টিন কে কেন্দ্র করে নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করার বিষয়টি পর্যটন ব্যবসায়ীরা ভালোভাবে দেখছেন না। তাদের মতে, সেন্টমার্টিনে যেতে বাধ্যতামূলক অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ও ফি’র বিষয় নিয়ে জটিলতা রয়েছে। এটা যেহেতু হঠাৎ করে গ্রহণ করা সিদ্ধান্ত, তাই হুট করে প্রয়োগ করাটা ঠিক হবে না। ভ্রমণকারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে পর্যায়ক্রমে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া নিবন্ধনের মাধ্যমে যদি সেন্টমার্টিনে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে কক্সবাজারের পুরো পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সিেপ্লন কি আদৌ সম্ভব?
বছরের ১২ মাস পর্যটকেরা যাতে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ করতে পারে, সেজন্য কক্সবাজার সেন্ট মার্টিন রুটে সি-প্লেন চালুর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সিপ্লেনে যাতায়াতের বিষয়টি বেশ ব্যয়বহুল। একটি সিপ্লেনে সাধারণত দশ বারো জন যাত্রী ভ্রমণ করতে পারে। সিপ্লেনের আকার এবং অবস্থাভেদে কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিনের সম পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করতে, একটি সিপ্লেনের প্রায় ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘন্টার মত সময় লাগতে পারে। এই দূরত্বে মালদ্বীপের সিপ্লেনগুলোতে যাওয়া আসার জন্য, জনপ্রতি প্রায় ৩০ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। তবে মালদ্বীপে এই ব্যবস্থাটি বেশ জনপ্রিয়, তাই তাদের পরিচালন ব্যয়ও অনেক কম। বাংলাদেশে সিপ্লেন ব্যবস্থা চালু হলে, স্বাভাবিকভাবেই মালদ্বীপের চেয়ে এর ভাড়া অনেক বেশি হবে। তাছাড়া শুধু দূরত্বের বিচারেই নয়, সিপ্লেনের ধরন, বয়স এবং অবস্থা, জ্বালানি দক্ষতা, রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, পাইলটের বেতন এবং অন্যান্য অপারেশনাল খরচ সহ নানা বিষয়ের সাথে সিপ্লেনের ভাড়া সম্পর্কিত।
শুধু যাতায়াতের জন্য এত টাকা সিপ্লেনের ভাড়া দেওয়া বাংলাদেশের সাধারণ পর্যটকদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারমানে এই ব্যবস্থা থেকে শুধু দেশের উচ্চবিত্ত পর্যটকেরা লাভবান হতে পারেন। তাছাড়া, যারা এতটাকা সিপ্লেন ভাড়া দিয়ে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার সামর্থ্য রাখেন, তাদের জন্য নিশ্চই অত্যন্ত বিলাসবহুল আবাসনের দরকার হবে। সেই ধরনের হোটেল রিসোর্ট সেন্ট মার্টিনে এখনও গড়ে ওঠেনি। তার উপর, দ্বীপের চারপাশে সৈকত লাগোয়া জমিগুলোতে, অপরিকল্পিতভাবে এত পরিমাণ অবকাঠামো গড়ে উঠেছে যে, নতুন করে বিশ্বমানের হোটেল রিসোর্ট গড়ে তোলার জন্য সেন্ট মার্টিনে পর্যাপ্ত যায়গা নেই। তারমানে প্রধান পর্যটন মৌসুমের বাইরে অন্যান্য সময়ে, সিপ্লেনে সেন্ট মার্টিন যাওয়া অনেক ব্যয়বহুল হবে, এবং যাদের যাওয়ার সামর্থ্য থাকবে তাদের উপযোগী সুযোগ সুবিধা দ্বীপটিতে নেই এবং অদূর ভবিষ্যতে গড়ে ওঠার সম্ভবনাও কম। তারচেয়েও বড় কথা হল, দেশের ভেতর ভ্রমণ করতেই যদি এত টাকা খরচ হয়, তাহলে জনগণ সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। বরং তখন সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে যে খরচ হবে, সেই টাকা দিয়ে দেশের বাইরে এমনকি মালদ্বীপেও ট্যুর করে আসা সম্ভব হবে।
মাত্র কয়েক বছর আগে সেন্ট মার্টিনে পর্যটন মৌসুমে পর্যটকদের যাতায়াতের একমাত্র ব্যবস্থা ছিল টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন রুটের জাহাজগুলো। পরবর্তীতে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি সেন্ট মার্টিন জাহাজ চালু হবার পর ভাবা হয়েছিল দ্বীপে ভ্রমণের বিষয়টি হয়ত আগের চেয়ে অনেক সহজ হবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে এর উল্টোটা। চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিনগামী র্কণফুলী এক্সপ্রেস এবং বে ওয়ানে জাহাজ দুটি পরিচালনা করে, কর্নফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড। কর্নফুলী শিপ বিল্ডার্সের জাহাজ দুটি অত্যন্ত নিম্নমানের যাত্রী সেবা দেওয়ার জন্য কুখ্যাত। এই জাহাজ দুটিতে প্রায় নিয়মিত ইঞ্জিন বিকল হওয়ার মত ঘটনা ঘটে। এমনকি বিলাসবহুল জাহাজ হিসেবে প্রচার করা বে ওয়ান তার প্রথম যাত্রাতেই সাগরের মাঝে বিকল হয়ে পড়েছিল।
গত বছর মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা এবং নাফ নদীর নব্যতা সঙ্কট কে দায়ী করে সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণের মৌসুমেও টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল। পর্যটন খাত সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, গত বছর মৌসুমের প্রথম দিকে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার অন্যকোন উপায় না থাকার সুযোগ নিয়ে, কর্নফুলী কম্পানি পর্যটকদের চরম হয়রানি করেছে। এমনকি অনেক পর্যটন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন যে, এই একটি কম্পানিকে এক চেটিয়া ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই গত বছরের শুরুর দিকে অন্যান্য জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল।
কক্সবাজার এবং সেন্ট মার্টিন এর পর্যটনকে কেন্দ্র করে সরকারের মহাপরিকল্পনা নিশ্চই একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এই প্রকল্পগুলো যেন অতীতের মত নাম সর্বস্ব না হয়। পরিকল্পনার বাস্তব সম্মত প্রয়োগ ঘটাতে পারলে দেশের পর্যটন শিল্প এবং বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ উভই লাভবান হবে।