সিরিয়ার স্বৈরাচার আসাদের পতন হল কিভাবে

maxresdefault (54)
কি কেন কিভাবে

সিরিয়ার স্বৈরাচার আসাদের পতন হল কিভাবে

ভূমিকা

সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের পতন হয়েছে। বাশার আল আসাদের সাথে শেখ হাসিনার উত্থান পতনের ইতিহাস অনেকটাই মিলে যায়।

হাসিনা যেমন দেশটাকে তার বাবার সম্পত্তি মনে করত, বাশারও তার বাবা হাফিজ আল অসাদের গড়ে তোলা স্বৈরাচারী সাম্রাজ্যে রাজত্ব করেছে।

শেখ হাসিনা যেমন ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে, ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন; বাশার আল আসাদও একই রকমভাবে রাশিয়ার কাছে দেশ বিক্রি করে, লোক দেখানো নির্বাচনের মাধ্যমে ২৪ বছর সিরিয়ার ক্ষমতায় ছিল।

বাশার আল আসাদ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে, সিরিয়ায় ১৩ বছর গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছিল। যাতে প্রায় ৫ লক্ষেরও বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটেছে এবং এক কোটিরও বেশি লোক ঘরবাড়ি হারিয়েছে। বর্তমানে সিরিয়ার ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে।

হাসিনা যেমন ক্ষমতাচূত হয়ে তার প্রভুদেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। বাশার আল আসাদও একইভাবে ক্ষমতাচ্যূত হয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে।

সিরিয়ার স্বৈরাচার বাশার আল আসাদের পতন হল কিভাবে ?

হাফিজ আল আসাদের উত্থান

সম্প্রতি সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যূত স্বৈরশাসক, বাশার আল আসাদের বাবা হাফিজ আল আসাদ সিরিয়ার ইতিহাসে অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত এক নেতা। তিনি আধুনিক সিরিয়ার স্থপতি হিসেবে পরিচিত। হাফিজ আল আসাদ ১৯৫৫ সালে সিরিয়ার বিমান বাহিনীতে পাইলট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪০ এবং ১৯৫০-এর দশকে সিরিয়ায় আরব জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রের উত্থান ঘটেছিল। সে সময় হাফিজ বাথ পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। এই দলটি আরব জাতীয়তাবাদ এবং আরব বিশ্বের ঐক্যের পক্ষে কাজ করত।

১৯৬৩ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাথ পার্টি সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করে। এই অভ্যুত্থানে হাফিজ আল আসাদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেকারণে তাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। ১৯৬৬ সালে বাথ পার্টির ভেতরে আরেকটি অভ্যুত্থান হয়। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাফিজ এবং তাঁর সহযোগীরা দলের উদারপন্থী গোষ্ঠীকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়।

১৯৭০ সালে হাফিজ তার রাজনৈতিক গুরু সালাহ আল-জাদিদ কে সরিয়ে সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর ১৯৭১ সালে হাফিজ আল আসাদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি, একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে সিরিয়ার বাথ পার্টি দেশটির একচ্ছত্র শাসকগোষ্ঠী হয়ে ওঠে। সেই সাথে হাফিজ আল আসাদ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়াকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।

২০০০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৯ বছর হাফিজ আল আসাদ সিরিয়া শাসন করেছে। তাঁর শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন, বাকস্বাধীনতা দমন এবং সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে সিরিয়ানদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।

বাশার আল আসাদের উত্থান

হাফিজ আল আসাদ তাঁর বড় ছেলে বাসিল আল আসাদকে উত্তরসূরি হিসেবে প্রস্তুত করছিলেন। বাসিল ছিলেন ক্যারিশম্যাটিক, প্রভাবশালী এবং সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে প্রতিশ্রুতিশীল। কিন্তু ১৯৯৪ সালে একটি দুর্ঘটনায় বাসিল মারা যায়। তখন হাফিজ আল আসাদের ছোট ছেলে বাশারকে উত্তরসূরি হিসেবে প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাশার সেসময় লন্ডনে চক্ষু চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য অধ্যয়নরত ছিলেন। তাঁকে সিরিয়ায় ফিরিয়ে এনে সামরিক ও প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০০০ সালে বাবা হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর পর বাশার প্রেসিডেন্ট হন।

তৎকালীন সময়ে সিরিয়ার সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের সর্বনিম্ন বয়সসীমা ছিল ৪০ বছর। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর বাশার আল আসাদের বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। এ জন্য সংবিধানের বয়স-সংক্রান্ত বিধান পরিবর্তন করে, প্রেসিডেন্টের বয়সসীমার ৩৪ করা হয়, যাতে বাশার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসতে পারে।

প্রথমদিকে বাশার সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। তিনি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন, শিক্ষা খাতে সংস্কার এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দেন। তবে খুব শীঘ্রই তিনি তাঁর বাবার শাসনের মতো কর্তৃত্ববাদী আচরণ করতে শুরু করেন। বিরোধীদের প্রতি দমনপীড়ন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস তাঁর শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। যার ফলে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি​​। বাশার আল আসাদের শাসনামলেই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং তাঁর শাসনকে বিভিন্ন গোষ্ঠী চ্যালেঞ্জ করতে থাকে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ

২০১১ সালে আরব বসন্তের প্রভাবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ২০১১ সালে তিউনিসিয়া, মিশর এবং লিবিয়ায় স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে সিরিয়াতেও এর প্রভাব পড়ে। তখন সিরিয়ার জনগণ বাশার আল আসাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে।

সিরিয়ায় আন্দোলন শুরু হয় দারায়া শহরের একটি ছোট্ট ঘটনার মধ্য দিয়ে। সেখানে কিছু স্কুলশিক্ষার্থী দেয়ালে সরকার বিরোধী স্লোগান লেখার পর, পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে নির্যাতন চালায়। এই ঘটনার ফলে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয় এবং তা বিশাল বিক্ষোভে রূপ নেয়।

প্রথমদিকে এই বিক্ষোভ ছিল শান্তিপূর্ণ। তবে সরকার এই আন্দোলন দমনে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালালে বহু মানুষ নিহত হয়। এর ফলে আন্দোলন আরো সহিংস হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে তা একটি গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়।

তখন সিরিয়ার কয়েকটি জাগতিগত গোষ্ঠী, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সমর্থক এবং একাধিক ইসলামপন্থী দল বাশার সরকারের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের কারণে এই সংঘাত আরও জটিল হয়ে ওঠে। ইরান এবং রাশিয়া বাশারের পক্ষে সমর্থন দেয়, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক এবং সৌদি আরব বিদ্রোহীদের সহায়তা করতে থাকে। তখন থেকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ একটি দীর্ঘস্থায়ী মানবিক সংকট তৈরি করে। যার ফলে প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় এক কোটির বেশি সিরিয়ান শরণার্থী হিসেবে ঘরবাড়ি এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।

জোলানি কে

বাশার আল আসাদের পতনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করছে আবু মুহাম্মদ আল-জোলানি। তিনি হায়াত তাহিরর আল-শাম বা HTS নামক একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রধান। জোলানি অতীতে আল-কায়েদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন, পরবর্তীতে তিনি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অন্যতম প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন। তাঁর নেতৃত্বে HTS সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী দলে পরিণত হয়।

জোলানি মূলত সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্রোহীদের সংগঠিত করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা সরকারের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং আসাদ সরকারের সামরিক অবস্থানগুলোতে আক্রমণ চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জোলানীর নেতৃত্বেই বিদ্রোহীরা আলেপ্পো এবং দামেস্কের মতো শহর দখল করতে সক্ষম হয়।

বাশার আল আসাদের পতন

বাশার আল আসাদের ক্ষমতার পতন, সিরিয়ার দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘর্ষের একটি চূড়ান্ত ফল। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে বিদ্রোহীরা এমন এক সুনির্দিষ্ট কৌশল গ্রহণ করেছিল, যার ফলে মাত্র ১২ দিনের মধ্যে আসাদ সরকারের পতন ঘটে।

বিদ্রোহীরা তাদের অভিযান শুরু করেছিল সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো থেকে। চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর বিদ্রোহীরা আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ নেয়, যা ছিল একটি প্রতীকী বিজয়। এই বিজয়ের পর বিদ্রোহীরা অতি দ্রুত অগ্রসর হয়ে একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। ৩০ নভেম্বর, তারা হোমস শহর এবং পরে হামা শহর দখল করে।

বিদ্রোহীদের এই দ্রুত অগ্রগতির পেছনে তাদের কৌশলগত দক্ষতা এবং সরকারের দুর্বল প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আসাদ বাহিনী বিদ্রোহীদের থামানোর জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হয়। বিদ্রোহীরা মূলত সরকারি বাহিনীর মধ্যকার সমন্বয়ের অভাবকে কাজে লাগিয়ে তাদের মনোবল দুর্বল করে দেয়। অবশেষে ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহীরা সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের দখল নিতে সক্ষম হয়।

বাশারের রাশিয়ায় আশ্রয়

বিদ্রোহীরা রাজধানী দামেস্কে প্রবেশ করার ঠিক আগে বাশার আল আসাদ একটি ব্যক্তিগত বিমানে সিরিয়া থেকে পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নেয়। বাশার সরকারের দীর্ঘ দিনের সবচেয়ে ঘনিষ্ট মিত্র ছিল রাশিয়া। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় রাশিয়া আসাদকে সামরিক এবং রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে ব্যাপক সহায়তা করেছে। রাশিয়ার এ ধরনের সমর্থনের পেছনে ছিল মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কৌশলগত স্বার্থ এবং সিরিয়ায় নিজেদের সামরিক ঘাঁটির সুরক্ষা।

সিরিয়ানদের কাছে বাশার আল আসাদ ছিলেন একজন ক্ষমতালোভী দুর্বল শাসক। যিনি নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য পুরো দেশটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছেন। তবে আসাদ পরিবারের দীর্ঘ ৫৪ বছরের সাম্রাজ্যের পতন এবং বিদ্রোহীদের বিজয়ের পরও সিরিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।