সান্তা ক্লজ আসলে কে

maxresdefault (57)
কি কেন কিভাবে

সান্তা ক্লজ আসলে কে

ভূমিকা

পৃথিবীর অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব হলো ক্রিসমাস বা বড়দিন। এই উৎসবের দুটি প্রধান প্রতীক হল ক্রিসমাস ট্রি এবং সান্তা ক্লজ। খ্রিস্টান সম্প্রদায় বিশ্বাস করেন, ২৫ ডিসেম্বর যিশু খ্রিস্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই এই দিনটি তারা যিশুর প্রতি সম্মান জানিয়ে উদযাপন করেন। তবে বর্তমান ক্রিসমাসের উদযাপন দেখে মনে হয়, যিশুর বদলে যেন সান্তা ক্লজই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

সান্তা ক্লজ আসলে কে ?

ক্রিসমাস

ক্রিসমাস কে যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন বলা হলেও, খ্রিষ্টের জন্মেরও বহু আগে থেকে ক্রিসমাস উৎযাপন করা হত। প্রাচীনকালে উত্তর গোলার্ধে ‘উইন্টার সলিস্টিস’ নামে উৎযাপিত বিভিন্ন উৎসবই কালক্রমে ক্রিসমাসে রূপান্তরিত হয়েছে।  

উত্তর গোলার্ধের অঞ্চলগুলোতে শীতকালে খুব অল্প সময় দিনের আলো পাওয়া যায়। এমনকি এই সমস্ত এলাকায় শীতকালে প্রায় ২৪ ঘন্টাও রাতের অন্ধকার থাকতে পারে। তাই প্রাচীনকালে শীত মৌসুমে এসব এলাকার বহু লোক মারাত্নক অসুস্থ হয়ে পড়ত এবং প্রায় প্রতিটি পরিবারেই কেউ না কেউ মারা যেত। শীত শেষে আবারো যখন সূর্যের উদয় হত, তখন তারা সূর্যকে জীবনদায়ী শক্তিরূপে পূজা করত। সেই সাথে সূর্যের আগমন কে উৎযাপন করতে নানা ধরনের উৎসব আয়োজন করা হত। সর্ব উত্তরের দিকে আয়োজন করা হত, ‘ফিস্ট অব দ্যা টুয়েলভ নাইটস’, যা ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে শুরু হয়ে জানুয়ারির ৬ তারিখ পর্যন্ত চলত। প্রাচীন গ্রীসে ক্রিড়া এবং মদের দেবতা ব্যাকাসের উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হত ‘ব্যাকানালিয়া’ উৎসব।

প্রাচীন রোমানরা তাদের সূর্যের দেবতা স্যাটার্নের নামে আয়োজন করত ‘স্যাটরানালিয়া’। রোমান সাম্রাজ্যের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং রোমান সৈনিকেরা মিথরা নামের আরেকজনকে সূর্য দেবতা হিসেবে মানত। এই মিথরার জন্মদিন হল ২৫ ডিসেম্বর, তাই তারা এই দিনটিকে বছরের সবচেয়ে পবিত্র দিন মনে করত। এবং ২৫ ডিসেম্বরে তারা ‘সোল ইনভিক্টাস’ উৎসবের মাধ্যমে মিথরার জন্মদিন উৎযাপন করত।

ক্রিসমাস ট্রি

ক্রিসমাস বা বড় দিনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত দুটি প্রতীক হল ক্রিসমাস ট্রি এবং সান্তা ক্লজ। এই দুটি বিষয়ের সাথেও প্রকৃতি পূজারি প্যাগানদের যোগসূত্র রয়েছে। প্রাচীনকালে উত্তর গোলার্ধের মানুষ একটি বিষয় খেয়াল করে যে, তীব্র ঠান্ডায়ও এক প্রজাতির গাছ সম্পূর্ণ সজীব থাকে। এই গাছের নাম ফার ট্রি।

তারা মনে করতে শুরু করে এই গাছের মধ্যে জীবনদানকারী শক্তি আছে। তাই তারা নিজেদের বাড়িতে এই গাছ রাখতে শুরু করে। এবং এসব গাছের সাথে বিভিন্ন তাবিজ কবজ বেঁধে রাখতে থাকে। অনেক সময় তারা ফার ট্রি উপর আলো জ্বালিয়ে রাখত অথবা এসব গাছে আগুন ধরিয়ে দিত। তারা মনে করত এসব তাবিজ এবং ফার ট্রি তাদেরকে শীতের তীব্রতা এবং শীতকালের নানা ধরনের বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে। সেখান থেকেই আধুনিক ক্রিসমাস ট্রির বিবর্তন ঘটে।

সান্তা ক্লজ

সান্তা ক্লজের সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত গল্প হল, শিশুরা যেসব উপহার চায়, বড়দিনে সান্তা ক্লজ শিশুদের সেসব মনের আশা পূরণ করেন। ক্রিসমাসে সান্তা ক্লজ লাল কোট পড়ে ব্যাগ ভর্তি উপহার নিয়ে প্রতিটি বাড়ির চিমনী দিয়ে ঘরে ঢোকে। তারপর বাড়ির ক্রিসমাস ট্রির নিচে অথবা মুজায় ভরে শিশুদের জন্য উপহার রেখে দিয়ে চলে যায়।

বলা হয়ে থাকে এই সান্তা ক্লজের আসল নাম হল, সেন্ট নিকোলাস। তিনি ছিলেন চতুর্থ শতাব্দীর একজন খ্রিস্টান পাদ্রি। যিনি তুরস্কের মাইরাতে বাস করতেন। সেন্ট নিকোলাস দানশীলতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন এবং বিশেষ করে শিশুদের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ও সহানুভূতির কারণে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি দরিদ্রদের গোপনে সাহায্য করতেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী উপহার দিতেন।

তার এই দানশীলতার গল্প ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে তিনি খ্রিস্টানদের মধ্যে এক জনপ্রিয় চরিত্র হয়ে ওঠেন। মধ্যযুগে সেন্ট নিকোলাসের প্রতি ভক্তি প্রকাশ করার জন্য তার স্মরণে একটি বিশেষ দিন পালন করা হতো। পরে, এই চরিত্রটি বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে আধুনিক সান্তা ক্লজের রূপ ধারণ করে।

১৭শ শতাব্দীতে ডাচ অভিবাসীরা সেন্ট নিকোলাসের গল্প আমেরিকায় নিয়ে আসে এবং সেখানে তাকে ‘সিন্টার ক্লাস’ নামে পরিচিত করানো হয়। ধীরে ধীরে এই নামটি পরিবর্তিত হয়ে ‘সান্তা ক্লজ’ হয়ে যায়।

সান্তা ক্লজের আসল চরিত্র

বড়দিনের উৎসবে যিশু খ্রিষ্টের বদলে খ্রিস্ট ধর্মের একজন পাদ্রি কে নিয়ে এত মাতামাতির কারণ কী? সত্যিকার অর্থে সেন্ট নিকোলাসের গল্পটি একটি নিষ্পাপ সংস্করণ মাত্র। সান্তা ক্লজের নিকোলাস নামের পেছনে আরো বেশ কিছু ঘটনা লুকিয়ে আছে; এবং এই নামটিও প্যাগানদের উইন্টার সলিস্টিস উৎসবের মত বহু পুরনো।

প্রাচীনকালে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলে নিক, নিকল বা নিকার শব্দ দ্বারা এক রাক্ষস কে বোঝানো হত। তাকে বলা হত ডেমন অব নর্থ বা উত্তরের রাক্ষস। জার্মানীতে এর নাম ছিল পালজ নিকল; যার অর্থ লোমশ শয়তান।

তৎকালীন সময়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং জার্মান অঞ্চলে, এই নিকোলাসের কথা বলে শিশুদের ভয় দেখানো হত। শীতকালে বাবা মায়েরা তাদের শিশু সন্তানদের বলত, তুমি যদি বাইরে যাও, তাহলে রাক্ষস নিক বা নিকোলাস এসে তোমাকে ব্যাগে ভরে নিয়ে যাবে। কোন কোন অঞ্চলে এই রাক্ষস কে বলা হত, প্রিন্স অব ডার্কনেস, অর্থাৎ অন্ধকারের রাজপুত্র।

আশ্চর্যের বিষয় হল, এই নিকোলাস, গ্রীক দেবতা ব্যাকাস এবং রোমান দেবতা স্যাটার্ন এবং মিথরা সবাইকে উপস্থাপন করতে একই ধরনের চিত্র অঙ্কন করা হত। এই সবগুলো চরিত্র বোঝাতে শিল্পীরা লম্বা দাড়িওয়ালার এক প্রতিকৃতি আঁকতেন। যার সাথে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় সান্তা ক্লজের হুবহু মিল পাওয়া যায়।  

বর্তমানে ক্রিসমাসের প্রতিটি আয়োজনে শুধু সান্তা ক্লজের কথা বলা হয়, অথচ তথাকথিত যার জন্মদিনের উপলক্ষ এই আয়োজন, সেই যিশুর কোথাও নামও নেওয়া হয় না। এর মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিকভাবে রাক্ষস হিসেবে পরিচিত এক চরিত্রকে গৌরবান্বিত করা হয়। এছাড়া সান্তা নামের মধ্যে আরো একটি রহস্য লুকিয়ে আছে। আর তা হল, সান্তা শব্দের অক্ষরগুলো সামান্য পুনবিন্যাস করলে পাওয়া যায় সাতান, যার অর্থ শয়তান।

খ্রিষ্টান ধর্মে আত্তীকরণ

চতুর্থ শতাব্দীতে রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তখন থেকে খ্রিষ্টধর্ম রোমান সাম্রাজ্যের মূল ধর্মে পরিণত হয়। কিন্তু তখনও সেখানকার বহু মানুষ প্রকৃতি পূজা বা প্যাগান প্রথা পালন করত। তাই রোমান চার্চ প্যাগানদের খ্রিষ্টধর্মে আকৃষ্ট করার জন্য, প্যাগান উৎসবগুলোর সঙ্গে খ্রিষ্টধর্মের রীতিনীতিতে কিছু পরিবর্তন আনে।

প্যাগানরা তাদের সূর্য দেবতা মিথরার জন্মদিন হিসেবে, ২৫ ডিসেম্বর ‘সোল ইনভিক্টাস’ নামে এক উৎসব ঘটা করে পালন করত। তাই তখন রোমান চার্চ ২৫ ডিসেম্বরকে যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন ঘোষণা করে। যাতে করে প্যাগানরা খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও, একই দিনে তাদের উৎসব চালিয়ে যেতে পারে।

তখন অতীতের ফার ট্রি বাড়ির আঙিনার বদলে তারা ঘরের ভেতরে স্থাপন করতে শুরু করে। সেই সাথে আগের তাবিজ কবজের বদলে, তারা আপেল ঝুলিয়ে দেয়। যা কালক্রমে ক্রিসমাস ট্রি অর্নামেন্টে পরিণত হয়। অতীতে ফ্রান্সের নটর ডেম ক্যাথিড্রাল এবং ইংলান্ডের সলসবারি ক্যাথিড্রালে এই আয়োজনকে বলা হত ক্রাইস্ট মাস। যা পরবর্তীতে মানুষের মুখে মুখে হয়ে যায় ক্রিসমাস।

মধ্যযুগের চার্চ অব ইংল্যান্ড তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে বিশুদ্ধবাদী খ্রিষ্টান ধারার চর্চা করত। তারা খুব ভালো মতই বুঝতে পারে যে, ক্রিসমাসের নামে সরাসরি প্যাগান রীতিনীতির চর্চা হচ্ছে। তাই ১৬৪৭ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডে ক্রিসমাস উৎযাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।

আধুনিক ক্রিসমাস

বর্তমানে ক্রিসমাসের যে রেওয়াজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, তা শুরু হয়েছিল আমেরিকায়। এবং সান্তা ক্লজের যে জনপ্রিয় বাহ্যিক বৈশিষ্ট, সেটি তৈরী করেছিলেন আমেরিকান কার্টুনের জনক হিসেবে পরিচিত থমাস নাস্ট।

ব্রিটেনের সাথে যুদ্ধ করে আমেরিকানরা স্বাধীনতা অর্জন করার পর, তারা সকল ব্রিটিশ রীতিনীতি পরিহার করে। এমনকি অতীতে ক্রিসমাসের ছুটির ঘোষনা সরাসরি বিট্রিশ রাজার কাছ থেকে আসত বলে, আমেরিকা স্বাধীন হবার পর একটানা ৬৭ বছর তারা ক্রিসমাসের ছুটিও পালন করেনি।

একটা সময় আমেরিকানরা ভাবতে শুরু করে, সমগ্র দেশবাসী একসাথে উৎযাপন করার মত, তাদের কোন বাৎসরিক ছুটির দিন নেই। তখন তারা ইংল্যান্ডের ক্রিসমাস থেকে আলাদা, এবং সম্পূর্ণ ধমীয় প্রভাব মুক্ত নতুন ক্রিসমাস উৎসবের সূচনা করে। পরবর্তীতে আমেরিকানদের ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত ক্রিসমাস প্রথাই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। যার মাধ্যমে ধর্মীয় অনুশাসনের পরিবর্তে ব্যাপক বানিজ্যিকীকরণ এবং ভোগবাদ মূখ্য হয়ে উঠেছে।

বর্তমানে ক্রিসমাসের সাথে এমনিতেও কোন ধর্মীয় উৎসবের সম্পর্ক নেই। ক্রিসমাস উৎযাপনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধরন হল, নাইট ক্লাব অথবা বারে মদ পান করে নাচানাচি এবং  উন্মত্ত রাত্রি জীবন উপভোগ করা। পশ্চিমাদের এসব অন্ধ অনুকরণে, বাংলাদেশের মত দেশে ডিজে পার্টি আয়োজন করাই ক্রিসমাস উৎযাপনের সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি। এই যদি হয় একজন নবীর জন্মদিন পালনের আয়োজন, তাহলে তা আর যাই হোক ধর্মীয় উৎসব হতে পারে না।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।