সাদা পাথর
সাদা পাথর
ভূমিকা
বাংলাদেশের সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ এলাকায়, ধলাই নদীর তীরজুড়ে বিস্তৃত ছিল মনোমুগ্ধকর সাদা পাথরের রাজ্য। কিন্তু বিগত এক বছরেরও বেশি সময় জুড়ে এখানকার পাথর লুট করা হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে, ভোলাগঞ্জ এলাকা থেকে প্রায় ২ লাখ ঘনফুট সাদা পাথর লুট করা হয়েছে, যার বাজার মূল্য আনুমানিক ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা। একই সঙ্গে প্রায় ৬ লাখ ঘনফুট বালুও লুটপাট হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৪০ কোটি টাকা। এই ভয়াবহ লুটপাট শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতির দিক থেকে নয়, পরিবেশগত দিক থেকেও মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাহাড়ে পাথর কীভাবে তৈরি হয়
সিলেট অঞ্চলের পাথরের বেশিরভাগই আসলে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা শিলাখণ্ড। এসব পাথর শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়, বরং এগুলো বহু প্রাচীন ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের নিদর্শন। এসব পাথর কয়েক কোটি বছরের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে।
পাহাড় গঠিত হয় মূলত গ্রানাইট, স্যান্ডস্টোন বা অন্য কোন ধরনের শক্ত শিলা দিয়ে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত কিংবা পাহাড় ধ্বসে এসব শিলা আস্তে আস্তে আলগা হয়ে যায়। যখন ভারী বৃষ্টিপাত হয় বা পাহাড়ে ভূমিধস নামে, তখন নদীর স্রোত সেগুলোকে ভাসিয়ে আনে। তাই সিলেটের পাথর আসলে কোটি বছরের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের নিদর্শন।
মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ধলাই, পিয়াইন বা ডাউকি নদীর মতো সীমান্তবর্তী নদীগুলোতে বর্ষার সময় প্রচণ্ড স্রোত নামে। ছোট ছোট কংকর বা মাঝারি আকারের পাথর সহজেই স্রোতের সাথে ভেসে আসে।
এসব নদীর ভেতর কিংবা নদীর তীরে অনেক বিশাল শিলাখণ্ডও দেখা যায়। আমরা অনেকেই মনে করি এসব পাথরেরও প্রাণ আছে। এবং এরা সময়ের সাথে সাথে বড় হয়। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। পাথর জড় পদার্থ এবং এগুলো বড় হয় না। বরং সময়ের সাথে সাথে নদীর স্রোতে বা ঘর্ষনে পাথর ছোট হয়ে যায় অথবা বালুতে পরিণত হয়।
বড় আকারের পাথরগুলো এত ভারী যে, স্রোতের সাথে দীর্ঘ পথ চলতে পারে না। এজন্য বড় পাথরগুলো অনেক সময় পাহাড় থেকে যেভাবে ভেঙে পড়ে, প্রায় তেমন আকারেই নদীর তীরে এসে জমা হয়।
সিলেটের পাথর উত্তোলন এলাকা
মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা পাথর সিলেটের বিভিন্ন দিক দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসব অঞ্চল থেকে অতীতে নিয়মিত পাথর উত্তোলন করা হত। যেসব জায়গা থেকে পাথর উত্তোলন করা হয়, সেসব জায়গাকে বলা হয় পাথর কোয়ারি। Quarry ইংরেজি শব্দ, যার অর্থ খনি। অগভীর বা উন্মুক্ত খনি বোঝাতে কোয়ারি শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কারণ পাথরের মত খনিজ সম্পদ উত্তোলন করার জন্য সাধারণত খনন করার দরকার পড়ে না।
সিলেট এলাকায় ভারতীয় পাহাড়ি নদীগুলোর প্রবাহ থেকে সময়ের সাথে সাথে বিপুল পরিমাণে পাথর নদীতে জমেছে, এবং এ থেকেই গঠিত হয়েছে জাফলং, ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, লোভাছড়ার মত পাথর কোয়ারিগুলো।
প্রথমদিকে পেশাদারভাবেই এই কোয়ারিগুলো থেকে পাথর উত্তোলন চলছিল। তবে পরিবেশ বিপর্যয় ও জনস্বাস্থ্যহানি ঠেকাতে, আদালতের রিটের প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে ক্রাশার বা বোমা মেশিনের মত যন্ত্র ব্যবহার করে পাথর তোলার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে, ২০১৬ সালে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সিলেটের সকল কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে।
২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সিলেটের আটটি পাথর কোয়ারিতে ইজারা দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো খুলে দেওয়ার জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও ট্রাক মালিকরা বারবার দাবি জানাতে থাকে।
দীর্ঘদিন পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে পাথরের ব্যাপক লুটপাট শুরু হয়। গত বছর আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত সিলেটের কোয়ারিগুলো থেকে হাজার কোটি টাকার পাথর লুটের অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসনের নিয়মিত অভিযান সত্ত্বেও লুটপাট বন্ধ হয়নি।
সরকার থেকে জানানো হয়, সিলেটের খনিগুলো থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন চলতে থাকলেও, সরকার এখান থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছিল। সে কারণে প্রায় আট বছর বন্ধ থাকার পর, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোর উপর থেকে সকল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তারপর থেকে সিলেটসহ সারাদেশে বন্ধ থাকা সকল পাথর ও বালু মহাল থেকে অবাধে পাথর, বালু ও সাদামাটি উত্তোলন শুরু হয়।
পাথর উত্তেলান করা যেমন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, একইভাবে দীর্ঘদিন পাথর উত্তােলন না করাও ক্ষতিকর। সেক্ষেত্রে নদীর নাব্যতা কমে যায়। পাথর ব্যবসায়ীদের অভিমত হল, কয়েক বছর কোয়ারি বন্ধ থাকা ও পাথর উত্তোলন না করার কারণে, নদীর প্রবেশমুখে স্তূপাকারে পাথর আটকে আছে। এতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে।
কিন্তু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অসাধু চক্র, প্রাকৃতিক ভারসাম্যের কোন তোয়াক্কা না করে, সাদা পাথরের প্রায় শতভাগ পাথর লুট করেছে। শুধু সাদা পাথর বা বড় বড় কোয়ারিগুলোই নয়, এর বাইরে ছোট খাট প্রায় সমস্ত জায়গা থেকে নির্বিচারে পাথর উত্তোলন করা হয়েছে।
জানা যায় অতীতে, ভারত থেকে আসা এসব পাথর আবার ভারতের কাছেই বিক্রি করতে বাংলাদেশ। সিলেটের পাথর ব্যবসায়ীদের দাবি, পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকার কারণে ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণ পাথর আমদানি করতে হচ্ছে। এতে দেশে ডলার সংকট আরও বাড়ছে। তবে সামান্য কিছু বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে গিয়ে, পাথর লুটের অবাধ বানিজ্যে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।
পাথর কি আবার ফিরে আসবে?
সিলেটের কোয়ারিগুলো থেকে পাথর উত্তোলনের জন্য বোমা মেশিন নামে পরিচিত এরকম বড় বড় যন্ত্র ব্যবহার করা হতো। এসব যন্ত্র মাটির অনেক গভীর থেকে পাথর তুলে আনতে পারে। ফলে যেসব এলাকায় এসব মেশিন দিয়ে পাথর তোলা হয় সেসব স্থানে তৈরি হয় বড় বড় গর্ত। যার ফলে কোয়ারি তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশের পাশাপাশি মানব জীবনও বিপন্ন হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার হিসেব মতে, বেপরোয়া পাথর উত্তোলনে সিলেটে ২০০৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০৬ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে পাথর লুটের বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর প্রশাসনের টনক নড়ে। হাইকোর্টের একটি রিটের পর থেকে দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনা করে, কয়েক হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এসব পাথর পুনঃস্থাপন করলেও প্রকৃতির ক্ষতি পোষানো যাবে না।
ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরকে ঘিরে মানুষের মনে এখন বড় প্রশ্ন, এত বিপুল পরিমাণ পাথর যে লুটপাট হয়ে গেল, সেগুলো কি আবার প্রাকৃতিকভাবে ফিরে আসবে? উত্তরটা পুরোপুরি ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত।
সাধারণত গাছপালা, প্রাণী বা পানি চক্রের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ গুলো নবায়নযোগ্য হয়ে থাকে। কিন্তু পাথর সেই অর্থে নবায়নযোগ্য নয়। এগুলো কোটি কোটি বছরের ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়। পাহাড় থেকে ধসে যাওয়া শিলা নদীর স্রোতে নেমে আসে, কিন্তু এর গতি এত ধীর যে মানুষের জীবদ্দশায় নতুন করে বিশাল পাথরের স্তূপ জমে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
নদী প্রতি বছর পাহাড় থেকে পাথর বয়ে আনলেও সেটা প্রকৃতির এক স্বাভাবিক ভারসাম্যের অংশ। কিন্তু যখন মানুষ একসাথে লাখ লাখ ঘনফুট পাথর সরিয়ে ফেলে, তখন প্রাকৃতিক ভারসাম্য স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যায়। প্রকৃতি খুব ধীরে ধীরে ক্ষতিপূরণ দেয়, কিন্তু মানুষ যেমন দ্রুত লুট করেছে, তেমন গতিতে নতুন পাথর কখনোই ফিরতে পারবে না।
আগামী বর্ষা মৌসুমগুলোতে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ধলাই নদীতে নতুন শিলা ও ছোট পাথর আবারো নেমে আসবে। তবে সেই পরিমাণ একেবারেই নগণ্য। এবং আগের মতো কয়েক লাখ ঘনফুট পাথরের সাম্রাজ্য গড়ে উঠতে হয়ত হাজার হাজার বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ, যে পাথর লুট হয়ে গেছে, তা আর আমাদের জীবদ্দশায় ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়।