সাগর তলের বিষ্ময়কর জগৎ দেখতে কেমন
সাগর তলের বিষ্ময়কর জগৎ দেখতে কেমন
মহাবিশ্বের প্রেক্ষিতে আমাদের পৃথিবী একটি নীল গ্রহ। কারণ আমাদের পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশেরও বেশি অংশজুড়ে রয়েছে নীল সমুদ্র। মানুষ এখনও পর্যন্ত মহাকাশে যতকিছু আবিষ্কার করতে পেরেছে, সেই তুলনায় আমাদের বাসস্থান পৃথিবীর সমুদ্রের তলদেশ সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি ন। ধারণা করা হয়, সমুদ্রের তলদেশের প্রায় ৯৫ ভাগ এলাকা সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত মানুষের তেমন কোন ধারণাই নেই।
সমুদ্রের বিশাল জলরাশি তার আচ্ছাদনে লুকিয়ে রেখেছে নানান ভূতাত্ত্বিক বিস্ময়। উত্তাল এই জলরাশির নিচে রয়েছে প্রচন্ড চাপ, কোথাও উত্তপ্ত লাভা, কোথাও বা অদ্ভুত আকৃতির সব প্রাণী। সাগরের যত গভীরে যাওয়া যায়, ততই এমন সব দৃশ্যের দেখা মেলে; যা পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক বিষয় সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের বহু বছরের জ্ঞানের ভিতকেও নাড়িয়ে দেয়।
সামুদ্রিক আগ্নেয়গিরি (Submarine Volcano)
পৃথিবীপৃষ্ঠকে অনেকগুলো টেকটোনিক প্লেটে ভাগ করা হয়, যেগুলো উত্তপ্ত গলিত ম্যাগমা স্তরের উপরে ভেসে আছে। বিভিন্ন টেকটোনিক প্লেটের মাঝের ফাঁকা স্থান দিয়ে উত্তপ্ত এসব ম্যাগমা যখন ভূপৃষ্ঠ চিরে উপরে উঠে আসে তখন তাকে বলা হয় লাভা। আর মাটির এসব চিরকে বলা হয় আগ্নেয়গিরি। মজার ব্যপার হলো পৃথিবীর মোট আগ্নেয়গিরির ৮০ ভাগই রয়েছে সমুদ্রের নিচে। এ ধরনের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে উত্তপ্ত ম্যাগমা আর সমুদ্রের পানির প্রায়ই বিষ্ফোরণধর্মী বিক্রিয়া দেখা যায়। বারবার অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সমুদ্রের নিচেই তৈরি হয় পাথরের পর্বত। সমুদ্রের নিচে ডুবে থাকা পর্বতগুলোই, নিয়মিত অগ্ন্যুতপাতের ফলে ধীরে ধীরে বড় হতে হতে, এক সময় সমুদ্রে বুকে নতুন দ্বীপ হিসেবে আর্বিভূত হয়। সামুদ্রিক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুপাতের সময় আশে পাশের পরিবেশে বিষাক্ত সালফার গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে।
সি মাউন্ট (Sea Mount)
সামুদ্রিক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে তৈরি পাথরের পাহাড়গুলো সবসময় পানির উপরিভাগ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। এ ধরনের বড় আকারের পাহাড় সমুদ্রের পানির স্রোতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। সমুদ্রের একেবারে গভীরের তুলনায় এ ধরনের পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের আলো বেশি পাওয়া যায়। তাছাড়া এখানে পানির এক ধরনের ঘূর্ণন তৈরি হয়। ফলে এখানে বিভিন্ন প্রাণীর খাবারের প্রাচুর্য তৈরী হয়; যার ফলে সাগর তলের পাহাড়গুলোতে জীববৈচিত্র্যের সমাহার দেখা যায়। শুধু মাত্র প্রশান্ত মহাসাগরেই ১০ হাজারের বেশি সি মাউন্ট বা সামুদ্রিক পাহাড় রয়েছে। সেকারণেই অন্য যে কোন সামুদ্রিক অঞ্চলের তুলনায় প্রশান্ত মহাসাগরেই বেশি প্রাণীর সমাবেশ দেখা যায়।
হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট (Hydrothermal Vent)
সমুদ্রের নিচে অনেকসময় আগ্নেয়গিরি থেকে অল্প পরিমাণে লাভা আর সালফার গ্যাস ক্রমাগত বেরিয়ে আসতে থাকে। ফলে সেসব স্থানে পানির তাপমাত্রা ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌছাতে পারে। তাছাড়া গ্যাসসহ লাভা বেরিয়ে আসার কারণে কয়েক মিটার লম্বা পাথুরে চিমনির মতো আকৃতি তৈরী হয়। এ ধরনের চিমনিকে বলা হয় হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, এত উত্তপ্ত এবং বিষাক্ত পরিবেশে হয়ত কোন প্রানী বাঁচতে পারবে না। কিন্তু অবাক করা বিষয় হল, এমন প্রতিকূল পরিবেশেও হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের কাছে অভাবনীয় জীববৈচিত্র্য দেখা যায়। মাত্র ৪০ বছর আগে মানুষ আবিষ্কার করতে পেরেছে যে, সমুদ্রের এমন চরমভাবাপন্ন পরিবেশেও Tube worm, চিংড়ি, কাঁকড়া, শামুক সহ নানান প্রজাতির প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে।
এখানকার প্রাণীরা বেঁচে থাকার জন্য ব্যাকটেরিয়ার মত বিভিন্ন ধরনের অণুজীবের উপর নির্ভর করে। সাধারণত জলজ অণুজীব ফাইটোপ্লাঙ্কটন সূর্যের আলোতে সালোকসংশ্লেষণ বা ফটোসিন্থেসিসের মাধ্যমে তাদের খাবার প্রস্তুত করে। কিন্তু গভীর সমুদ্রে সূর্যের আলো পৌছাতে না পারার কারণে, এখানকার অণুজীবরা নতুন এক পদ্ধতি অবলম্বন করে, যাকে বলা হয় কেমোসিন্থেসিস। যার অর্থ হল, এরা সমুদ্রের তলদেশ থেকে আসা সালফারসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থের রাসায়নিক শক্তি ব্যবহার করে খাদ্য প্রস্তুত করে।
কোল্ড সিপ (Cold Seeps)
সমুদ্রের তলদেশ থেকে অনেকক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের হাইড্রোকার্বন যেমন মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি ধীরে ধীরে পানিতে মিশে যায়। ফলে এখানেও তৈরি হয় এক বিশেষ ধরনের বাস্তুতন্ত্র যা সচরাচর দেখা যায় না। একেই বলা হয় কোল্ড সিপ। হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের সাথে এর মূল পার্থক্য হলো এখানে উচ্চ তাপমাত্রা থাকে না। সাধারণত Continental Margin বা মহাদেশ ও সমুদ্রের সংযোগস্থলে কোল্ড সিপ দেখা যায়। এখানেও বিভিন্ন কেমোসিনথেটিক ব্যাকটেরিয়ার দেখা মেলে; যাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে শামুক, ঝিনুক বা Tube Worm এর মত নানা প্রাণী সম্বলিত এক অনন্য বাস্তুতন্ত্র।
ব্রাইন পুল (Brine Pool)
সমুদ্রের নিচে গিয়েও যদি এ ধরনের পুকুর দেখতে পান, তাহলে নিশ্চই অবাক হবেন! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, সাগরের একদম তলদেশে এ ধরনের পুকুরের দেখা পাওয়া যায়। এদেরকে বলা হয় ব্রাইন পুল। খুবই ঘন লবণের দ্রবণকে ব্রাইন বলা হয়, যার ঘনত্ব সাগরের পানির চাইতেও কয়েকগুণ বেশি। আর তা যখন এক জায়গায় জমে যায়, তখন দেখতে মনে হয় যেন সাগরের পানির নিচেই যেন পুকুর তৈরী হয়েছে। সাগরের পানি এবং এসব ব্রাইনের ঘণত্বের পার্থক্য এতই বেশি যে এরা কখনোই মিশে যায় না। এমনকি ব্রাইন পুলে আলাদা ঢেউ পর্যন্ত তৈরি হয়।
অতিরিক্ত লবণাক্ততা আর অক্সিজেনের অভাবে ব্রাইন পুলে তেমন কোনো প্রানের অস্তিত্ব দেখা যায় না। তবে কিছু ব্যাকটেরিয়া কেমোসিন্থেসিসের মাধ্যমে এই চরম পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। সাধারণত মেক্সিকো উপসাগর, ভূমধ্য সাগর এবং লোহিত সাগরের তলে ব্রাইন পুল দেখা যায়।
সাগরের বিষ্ময়কর জগৎ
পৃথিবীর মহাদেশগুলো যে পৃথিবীপৃষ্ঠের উপর স্থান পরিবর্তন করতে পারে, অতীতে বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। পরবর্তীতে সমুদ্রের তলদেশে টেকটোনিক প্লেটের অবস্থান এবং সমুদ্র তলদেশের বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার মাধ্যমে, বিজ্ঞানীরা পৃথিবীপৃষ্ঠের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে নতুন করে ধারণা লাভ করেন। অতীতে মনে করা হত, সমুদ্রের গভীরে সূর্যের আলোর অনুপস্থিতির কারণে হয়ত, সেখানে কোন প্রানীই বাঁচতে পারে না। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, কেমোসিন্থেসিসের মাধ্যমে সমুদ্রের গভীরেও প্রানীরা সূর্যের আলো ছাড়াও বেঁচে থাকতে পারে।
সামুদ্রিক যেসব বিপর্যয় স্থলভাগেও মারাত্নক প্রভাব ফেলে, তেমন প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর একটি হল সুনামি। সাধারণত সমুদ্রের নিচে তৈরী হওয়া ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে সুনামি হয়ে থাকে। তবে এসবের বাইরেও সুনামির আরেকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। আর তা হল, সমুদ্রের নিচে ডুবে থাকা পাহাড়ের ভূমিধ্বস। অনেকসময় ভূমিকম্পের পরে সি মাউন্টে ভূমিধ্বস দেখা দিতে পারে, যা থেকে হতে পারে বিরাট আকারের সুনামি।
এখনও পর্যন্ত মানুষ সমুদ্রজগতের মাত্র ৫ শতাংশ সম্পর্কে জানতে পেরেছে। পৃথিবীর মোট বাস্তুতন্ত্রের ৯৯ শতাংশই ধারণ করে আছে সাগর-মহাসাগরগুলো। ধারণা করা হয়, সমুদ্রের গভীরে আরো প্রায় ৩০ লক্ষ অজানা প্রজাতির জীব থাকতে পারে, যাদের সম্পর্কে মানুষের কোন ধারণাই নেই। সবকিছু মিলিয়ে সমুদ্রের বিশালতাকে আমরা যতই কল্পনা করতে চাই, ততই যেন তা আমাদের কাছে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। মানুষের সেই অজানাকে জানার তৃষ্ণা নিবারণ করতে, বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত সমুদ্রের গভীরে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন; এর ফলে আমাদের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে পৃথিবী ও প্রাণ সম্পর্কে নতুন নতুন সব তথ্য ভান্ডার।