সাকার ফিশ
সাকার ফিশ
একুরিয়ামে পালন করা মাছের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি মাছ হল সাকার ফিশ। নিতান্তই শখের বসে পালন করা এই মাছ বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বাস্তুসংস্থানের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। সাকার মাছ বাংলাদেশের পুকুর, নদ-নদী সহ সকল ধরনের প্রাকৃতিক জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এরা দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ এবং বড় মাছের পোনা খেয়ে ফেলে। তাই সাকার মাছ বাংলাদেশের মৎস সম্পদের জন্য এক বিশাল হুমকি। সেকারণে বাংলাদেশে এই মাছ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সাকার ফিশের আসল নাম সাকার মাউথ ক্যাটফিশ। এর বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকাসটোমাস। এটি প্লেকো নামেও পরিচিত। বুড়িগঙ্গার আশে পাশের অনেকে এক চগবগে মাছও বলে। অ্যাকুয়ারিয়ামের কাচের সঙ্গে লেগে থাকা শেওলা ও ময়লা পরিষ্কার করার জন্য, আশির দশকে বিদেশ থেকে এই মাছ আনা হয়েছিল। এই মাছ কোস্টারিকা, পানামা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। তবে কয়েক বছর ধরে তা ভারত, চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের জলাশয়ে দেখা যাচ্ছে।
সাকার মাছের পিঠের ওপরে বড় ও ধারালো পাখনা আছে। দুই পাশেও রয়েছে একই রকমের দুটি পাখনা। এর মাথার নিচের দিকে থাকা দাঁতও বেশ ধারালো। সাধারণত জলাশয়ের আগাছা, জলজ পোকামাকড় ও ছোট মাছ এদের প্রধান খাবার। যেসব পানিতে দূষণের কারণে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, সেখানে অন্য মাছ বাঁচতে পারে না, তবে এই মাছ পারে। পানি ছাড়াও মাছটি ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
পথমদিকে কোনভাবে একুরিয়াম থেকে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছটি ছড়িয়ে পড়েছিল। তারপর থেকে খুব দ্রুত সারা দেশে সাকার মাছ ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ জেলার নদ-নদীতে এ মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি বুড়িগঙ্গার মতো দূষিত পানিতেও সাকার মাছ ব্যাপকহারে বংশ বৃদ্ধি করছে। সেই সাথে মানুষ যেহেতু এই মাছ খায় না, তাই এর সংখ্যাও কমছে না। আগে বর্ষাকালে বুড়িগঙ্গা নদীতে বেশ কিছু দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন বুড়িগঙ্গায় জাল ফেললেই, ঝাঁকে ঝাঁকে শুধু সাকার ফিশ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি এক জালে দুই থেকে চার মণ পর্যন্ত সাকার মাছ পরিমাণ উটছে। স্থানীয় অনেকেই বুড়িগঙ্গায় গোসল করতেন, তারাও এখন সাকার ফিশের ভয়ে পানিতে নামেন না। কারণ অনেকের গায়ে সাকার মাছের ধারালো পাখনার আঘাত লেগে, শরীরে পচন ধরার খবর পাওয়া গেছে।
মৎস্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, সাকার ফিশ দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু খেয়ে মাছের বংশবিস্তারে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এ মাছ যেকোনো পরিবেশে বাঁচতে পারে এবং দ্রুত বংশবৃদ্ধির কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছের সঙ্গে খাদ্য ও বাসস্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। তাই হয় দেশীয় ছোট মাছ সাকার মাছের খাদ্যে পরিণত হয়, অথবা বড় মাছগুলো সাকার ফিশের কারণে প্রয়োজনীয় খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। সেকারণে দেশীয় ছোট এবং বড় সকল প্রজাতির মাছ সাকার ফিশের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের উন্মুক্ত জলাশয়ে সাকার মাছের বিস্তার বন্ধ করা না গেলে, সকল ধরনের দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বিশ্বের অনেক দেশে সাকার মাছ খাওয়া হলেও, বাংলাদেশে এই মাছ খাওয়ার তেমন প্রচলন নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অনেকেই সাকার মাছ খাওয়া শুরু করেছেন। ইউটিউবে সাকার মাছ রান্নার বেশ কিছু রেসিপিও রয়েছে। এই মাছ খাওয়ার প্রধান অন্তরায় হল সাকার ফিশের মাথা পাথরের মত শক্ত এবং এর শরীরের আবরণও সহজে কাটা যায় না। বিদঘুটে চেহারা এবং শক্ত গড়নের কারণে অনেকে একে শয়তান মাছও বলে। সাকার ফিশের মাথা সহ শরীরের অন্যান্য অংশ ফেলে দিলে মাছের মাত্র ৩০ শতাংশ অবশিষ্ট থাকে। তবে বাংলাদেশের সাকার মাছ খাওয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন। কারণ বেশ কয়েক জায়গার নমুনা পর্যবেক্ষণ করে এই মাছের শরীরে ক্ষতিকর ভারি পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া এ মাছ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে।
বিগত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে সাকার ফিশ নিষিদ্ধ করেছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশে চূড়ান্তভাবে সাকার মাছ নিষিদ্ধ করা হয়। মাছটি আমদানি, প্রজনন, পরিবহন, বিক্রি, অ্যাকুয়ারিয়ামে পালন, সংরক্ষণ এবং প্রদর্শন করা সম্পূর্ন নিষেধ। সাকার মাছ পেলেই তা সাথে সাথে মেরে ফেলতে হবে। অনেকে জলাশয় থেকে সাকার মাছ ধরলে, তা আবার পুনরায় পানিতে ছেড়ে দেয়। এটি মোটেও ঠিক নয়। একে সরাসরি মাটি চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে হবে। চাষের পুকুরে সাকার মাছ থাকলে, পুকুরের পানি শুকিয়ে এই মাছ মেরে ফেলতে হবে। সাকার মাছের প্রতি এই মুহেুর্তে কঠোর না হলে, এটি আমাদের দেশীয় সকল মাছ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে ফেলবে।