সর্বজনীন পেনশন স্কিম কতটা কার্যকর হবে

maxresdefault (52)
বাংলাদেশ

সর্বজনীন পেনশন স্কিম কতটা কার্যকর হবে

বাংলাদেশের নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে, দেশে প্রথমবারের মত সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। ১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কেউ নিয়মিত চাঁদা দিয়ে এই পেনশনের আওতায় আসতে পারবেন। প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা- এই চার নামে চার শ্রেণির মানুষের জন্য আলাদা স্কিম চালু করা হয়েছে। পরবর্তীতে সুবিধাজনক সময়ে শ্রমিক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আরও দুটি স্কিম চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পেনশন কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেড় হাজারেরও বেশি নাগরিক ৮৭ লাখ টাকার বেশি জমা দিয়েছেন। 

সর্বজনীন পেনশন স্কিম  নিয়ে মানুষের মাঝে যেমন ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, তেমনিভাবে এই স্কিম কতটা কার্যকর এবং ঝামেলামুক্ত হবে সেই প্রশ্নও করছেন অনেকে। অর্থনীতিবিদ এবং গবেষকদের চোখে পেনশন স্কিমের বেশ কিছু দুর্বলতাও চোখে পড়েছে।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম কতটা কার্যকর হবে ?

সর্বজনীন পেনশন স্কিম

বাংলাদেশের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে অর্থ বিভাগের আওতাধীন ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ’। পেনশন তহবিলের সঠিক ব্যবহার ও বিনিয়োগের জন্য খুব শিঘ্রই ‘পেনশন ফান্ড ম্যানেজমেন্ট অথরিটি’ নামে আরেকটি সংস্থা গড়ে তোলা হবে।

পেনশন স্কিমে অংশ নিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে। এই পেনশন কর্মসূচির সামগ্রীক বিষয় বর্ণনা করতে, অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা’ জারি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্রধারী ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সকল বাংলাদেশি নাগরিক নিজেদের জন্য প্রযোজ্য স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। বিশেষ বিবেচনায় ৫০ বছরের বেশি বয়সীরাও পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।

চারটি স্কিমের মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য রাখা হয়েছে প্রবাস স্কিম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবীদের জন্য রয়েছে প্রগতি স্কিম। কৃষক, রিকশাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে বা তাঁতিদের মত অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিরা সুরক্ষা স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। যাদের বাৎসরিক আয় ৬০ হাজার টাকার কম বা দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী স্বল্প আয়ের ব্যক্তিদের জন্য রাখা হয়েছে সমতা স্কিম।

এসব স্কিমের চাঁদার কিস্তি পছন্দ অনুযায়ী মাসিক, ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক ভিত্তিতে পরিশোধ করা যাবে। চাঁদা দেওয়ার সময়ের ভিত্তিতে চারটি স্কিমের জন্যই মাসিক চাঁদার পরিমাণ এবং পেনশনের পরিমাণ আলাদা আলাদাভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। চারটি স্কিম অনুযায়ী ১০ থেকে ৪২ বছর চাঁদা দেওয়ার পর সর্বনিম্ন ১ হাজার ৫৩০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক পেনশন পাওয়া যাবে।

পেনশন স্কিমে যুক্ত হয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে চাঁদা দিয়ে গেলে ৬০ বছর বয়স থেকে আজীবন পেনশন মিলবে। ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কেউ মারা গেলে তার নমিনি মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ হওয়ার বাকি সময় মাসিক ভিত্তিতে পেনশন পাবেন। ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে কেউ মারা গেলে জমা হওয়া অর্থ মুনাফাসহ ফেরত পাবেন নমিনি। পেনশনের অর্থ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে এবং মাসিক পেনশনের অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। কারো যদি পেনশনে জমাকৃত অর্থ কোন এক পর্যায়ে উত্তোলনের দরকার হয়, তাহলে তার মোট জমার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ অর্থ তিনি আবেদনের প্রেক্ষিতে ঋণ হিসেবে নিতে পারবেন। পরবর্তীতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুদ সহ সেই অর্থ ফেরত দিতে হবে।

স্কিমের দৃর্বলতা

অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, এখনও পর্যন্ত কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো না থাকায়, প্রথম কয়েক বছর এই স্কিম অনেকটা ‘নাম সর্বস্ব’ হতে পারে। অনেকে মনে করছেন নির্বাচনকে সামনে রেখে হয়ত তাড়াহুড়ো করে এটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এখনও এই স্কিমের বেশ কিছু দুর্বলতা রয়েছে, যা ঠিক হতে আরো ৫ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পেনশনের কিস্তি জমা দেওয়ার স্কিমগুলো নির্দিষ্ট অঙ্কের না করে, আয়ের সাথে সম্পর্কিত হতে হবে। যেমন কারো মাসিক আয় যদি দশ লাখ টাকা হয়, তাহলে সে কেন মাত্র দশ হাজার টাকা জমা দেবে? বিভিন্ন চাঁদার হার ও চাঁদার সময়কালের ওপর মাসিক পেনশনের যে হার নির্ধারণ করা হয়েছে তেমন উদাহরণ পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।

সাধারণত জনগনের টাকা নিয়ে কর্তৃপক্ষ লগ্নি করে এবং সেখান থেকে যে মুনাফা আসে তার ভিত্তিতে পেনশন দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিলে নির্দিষ্ট পরিমাণ পেনশন দেওয়ার বিষয়টি বাস্তব সম্মত কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। তাছাড়া মুদ্রাস্ফীতির বিষয়টিও এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আজকে পেনশনার যে টাকা জমা দিচ্ছে, ৪০ বছর পর তার পেনশন গ্রহণের সময় সেই টাকার মান অনেক কমে যেতে পারে। তখন নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পেনশনগ্রহীতার জন্য লাভজনক নাও হতে পারে। সমতা স্কিমের একজন ব্যক্তি ২৫ বছর চাঁদা দেওয়ার পর মাসিক পেনশন পাবেন মাত্র ৭ হাজার ৯৫৫ টাকা। এই পরিমাণ টাকা দিয়ে বর্তমান সময়েই একজন বয়স্ক ব্যক্তির মাসিক খরচ মেটানো সম্ভব নয়। সেখানে ভবিষ্যতে এই পরিমাণ টাকা পেনশনগ্রহীতাদের কতটুকু সুরক্ষা দিতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

একদিকে মাত্র ১০ বছর অর্থ জমা দিয়ে পেনশনার হওয়ার সুযোগ আছে। অন্যদিকে ৬০ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তি বা তার উত্তরাধিকার পেনশন পাবে না। সেকারণে এই স্কিমে টাকা জমা দেওয়া অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জানা যায়, পেনশন স্কিমের দুর্বল দিকগুলোর ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণ করা হবে। পরামর্শগুলো বিবেচনায় নিয়ে ধারাবাহিক সংস্কারের মধ্য দিয়েই এই উদ্যোগ পরিপূর্ণতা পাবে।

ইসলামি চিন্তাবিদরা মনে করছেন, সরকার ঘোষিত সর্বজনীন পেনশন অনেকটাই প্রচলিত বীমার মত। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দিয়ে সেই অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত অর্থ পাওয়ার যে চুক্তি, তা সুদের আওতায় পড়ে। যা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ইসলামে সুদ হারাম হবার কারণে, বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। এমনকি দেশের ব্যাংকিং খাতের অধিকাংশ মূলধন ইসলামী ব্যাংকগুলোতেই রয়েছে। গ্রহকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে, সাধারণ সুদ ভিত্তিক ব্যাংকগুলোও, তাদের মূল কার্যক্রমের পাশাপাশি ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রমের আলাদা স্কিম শুরু করছে। একইভাবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যদি, সাধারণ স্কিমের পাশাপাশি সুদমুক্ত একটি স্কিম চালু করা যায়, তাহলে দেশের সর্বস্তরের জনগণ এই পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী হবে।

ভোগান্তির আশঙ্কা

বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা পাওয়ার বিষয়ে নাগরিকদের একধরনের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। এর কারণ আমরা সবাই জানি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে গেলে সাধারণ জনগণকে নানা ভাবে ভোগান্তির শিকার হতে হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘুষ ছাড়া কোন কাজ হয় না। কোটি কোটি মানুষের নামে পৃথক হিসাব খোলা, সেটি স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করা এবং ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত কিস্তি দিয়ে কোন ঝামেলা ছাড়াই পেনশন পাওয়া যাবে কি, সে বিষয়ে অনেকেরই সংশয় আছে। বিশেষ করে সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনের টাকা নিয়ে হয়রানির নজির কম নয়। নতুন পেনশন স্কিমে সেই দুর্ভোগের পুনরাবৃত্তি হয় কিনা, সেই চিন্তাও একবোরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সরকারি পেনশন পেতে হয়রানি দূর করতে ‘পেনশন সহজীকরণ নীতিমালা-২০২০’ নামে আলাদা একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, ভোগান্তি যাতে না হয় সেই ব্যবস্থা করা হবে। গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টটি পেনশন দেয়ার উপযুক্ত হলে সেই অ্যাকাউন্টে পেনশনের টাকা অটোমেটিক চলে যাবে। এ জন্য কোথাও আলাদা করে যোগাযোগ করার দরকার হবে না।

বিনিয়োগে ঝুঁকির আশঙ্কা

নাগরিকদের পেনশনের টাকা সংগ্রহ করে তা সঠিকভাবে বিনিয়োগ করা হবে কিনা, সে বিষয়েও গ্রাহকদের সন্দেহ থাকতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, ‘পেনশন ফান্ড ম্যানেজমেন্ট অথরিটি’ দেশের লাভজনক বড় বড় অবকাঠামোতে পেনশন তহবিলের টাকা বিনিয়োগ করবে। প্রাথমিকভাবে, এই তহবিল সরকারি বন্ড বা ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগের কথা রয়েছে। যেসব বিনিয়োগে ঝুঁকি কম সেখানেই বিনিযোগ করা হবে। যদি ফান্ড আরও বড় হয় তাহলে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হতে পারে। যেমন, দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে করা হয়েছে। ঠিক এ ধরনের লাভজনক বড় বড় প্রকল্পে পেনশন তহবিলের টাকা ব্যবহার করা হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কম ঝুঁকিপূর্ণ খাত গুলোতে মুনাফা কম হয়। সেক্ষেত্রে গ্রাহকদের যে বাড়তি অর্থ দেয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা রাজস্ব খাত থেকে সরকারকে পরিশোধ করতে হতে পারে। যা সরকারের ওপর আরেকটি নতুন বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সর্বজনীন পেনশন স্কিমের জন্য এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র সোনালী ব্যাংককে লেনদেনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সকল ব্যাংককে এই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করলে গ্রাহকদের হিসাব চালাতে যেমন সুবিধা হবে। তেমনিভাবে কোন একক ব্যাংকের উপর নির্ভরতা তৈরী হবে না এবং একটি ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার অনৈতিক সুবিধা নেয়ার সুযোগ বন্ধ হবে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।