সপ্তাশ্চর্য
সপ্তাশ্চর্য
প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন বিস্ময়কর স্থানের তালিকা তৈরী হয়ে আসছে। সাধারণত মানুষের তৈরী স্থাপনাগুলোই এই তালিকায় স্থান পেত। তবে ২০০১ সালে The New 7 Wonders Foundation নামের একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান নতুন করে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন করতে শুরু করেছে। তাদের এই উদ্যোগ অনেক দেশ সাদরে গ্রহণ করলেও, বেশ কিছু দেশই নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যে সমস্ত দেশে এই নির্বাচনকে নিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালানো হয়েছিল, সেসব দেশ থেকেই মূলত নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচিত হয়েছে।
প্রাচীনকালে গ্রীকরা ভূমধ্যসাগরের আশে পাশের অঞ্চলের মনুষ্য নির্মিত বিষ্ময়কর স্থাপনা নিয়ে সর্বপ্রথম সপ্তাশ্চর্য তালিকা তৈরী করেছিল বলে ধারণা করা হয়। আশ্চর্য বাছাই করার জন্য তালিকাতে কেন ৭টি বিষয় কে বাছাই করার কারণ হল, ৭ সংখ্যা টিকে গ্রীকরা নিখুঁত এব পর্যাপ্ত বলে মনে করত। তৎকালীন সময়ের উচ্চমানের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোই ছিল সপ্তাশ্চর্যের অংশ। গ্রিক ভাষায় এগুলোকে বলা হত ‘থাউমাতা’ যার অর্থ ‘দর্শনীয় বস্তু’। সে হিসেবে গ্রিকদের তালিকাটি ছিল সাতটি দর্শনীয় বস্তুর তালিকা। এরপরও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাজের মানুষ নিজেদের খেয়াল খুশিমত সপ্তাশ্চর্যের তালিকা প্রস্তুত করেছে। সেজন্য সপ্তাশ্চর্যগুলোকে মোটাদাগে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন: ১. প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্য ২. মধ্য যুগের সপ্তাশ্চর্য এবং ৩. নতুন সপ্তাশ্চর্য। যুগ ভেদে এসব তালিকা নিয়েও যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে। তবে এই স্থাপনাগুলোর প্রায় সবই ছিল একই সাথে ঐতিহাসিক এবং বিষ্ময়কর। প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে ছিল: ১. গিজার মহাপিরামিড ২. ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান ৩. আর্টেমিসের মন্দির ৪. আলিম্পিয়ার জিউসের মূর্তি ৫. রোডসের মূর্তি ৬. আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর এবং ৭. হ্যালিকারনেসাসের সমাধি মন্দির। প্রাচীনকালের এসব স্থাপনার বেশির ভাগেরই কোন অস্তিত্ব নেই। শুধুমাত্র মিশরের পিরামিডই একমাত্র প্রাচীন সপ্তাশ্চর্য, যা আজও টিকে আছে। এরপর মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে ছিল: ১. ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জ ২. চীনের মহাপ্রাচীর ৩. আলেকজান্দ্রিয়ার ভূগর্ভস্থ সমাধি ৪. রোমের কলোসিয়াম ৫. নানকিংয়ের চিনা মাটির মিনার ৬. আগ্রার তাজমহল এবং ৭. তুরষ্কের হায়া সোফিয়া মসজিদ। এই তালিকার সবগুলো মধ্যযুগে নির্মিত নয়, তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এগুলো ছিল মধ্যযুগের বিষ্ময়। অনেকে মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্যে আগ্রার তাজমহল কে বাদ দিয়ে পিসার হেলানো মিনারকে অন্তর্ভূক্ত করেছে। যদিও গঠন ও বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে তাজমহল পিসার হেলানো মিনার থেকেও অনেক উন্নত এবং বিষ্ময়কর স্থাপনা। এরপর আসা যাক আধুনিক কালের সপ্তাশ্চর্য সম্পর্কে। বর্তমান পৃথিবীর নতুন সপ্তাশ্চর্যগুলো হল ১. চীনের মহাপ্রাচীর ২. জর্ডানের পেত্রা ৩. ইতালির কলোসিয়াম ৪. মেক্সিকোর চিচেন ইৎজা ৫. পেরুর মাচু পিচু ৬. ভারতের তাজমহল এবং ৭. ব্রাজিলের ক্রাইস্ট দি রিডিমার। এই তালিকায় ৭টি সপ্তাশ্চর্যের বাইরে মিশরের পিরামিডকে সম্মানজনক স্থান দেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে মিশরের পিরামিড কে অষ্টম আশ্চর্য বলা যায়।
প্রাচীন এবং মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্য কোন আনুষ্ঠানিক তালিকা ছিল না। অতীতে মানুষের মুখে মুখে এসব বিষ্ময়কর স্থাপনার কথা আলোচিত হত। কিন্তু আধুনিক কালে সুইজারল্যান্ডে একটি প্রতিষ্ঠান এই তালিকা তৈরী করেছে। The New 7 Wonders Foundation নামের এই প্রতিষ্ঠান ২০০০ সাল থেকে নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের জন্য প্রচারনা শুরু করে। সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২০০ টি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে মনোনয়ন দেওয়া হয়। নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের জন্য ওয়েবসাইট এবং টেলিফোনের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হয়। ২০০৬ সালে একদল বিশেষজ্ঞ প্যানেল প্রাথমিকভাবে মনোনীত ২০০ টি স্থান থেকে ৭৭টি স্থান কে নির্বাচন করে। এরপর সেখান থেকে বাছাইকৃত ২১ টি ঐতিহাসিক স্থানের মধ্যে ভোটাভুটি হয়। যার মধ্য থেকে সর্বশেষ নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচিত হয়। নতুন সপ্তাশ্চর্যের ফলাফল ঘোষণা করা হয় ৭/৭/২০০৭ তারিখে, অর্থাৎ ২০০৭ সালের জুলাই মাসের ৭ তারিখে। কিন্তু অনেকেই এই ভোট গ্রহন পদ্ধতিকে অবৈজ্ঞানিক মনে করেন। কারণ এই পদ্ধতিতে একজন ব্যক্তি যত খুশি তত ভোট দিতে পেরেছে। সেজন্য সত্যিকার অর্থে এটি জনপ্রিয়তা যাচাই হয়নি। যাদের সামর্থ আছে তারা বেশি ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের জায়গাকে এগিয়ে রেখেছে। সঠিক নির্বাচন পদ্ধতি না থাকার কারণে, এই উদ্যোগ নিয়ে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বেশ কিছু দেশ এটি সাদরে গ্রহণ করেছে, আবার কিছু দেশ নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের বিষয়টিকেই প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতি সংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো, প্রথম দিকে সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন তালিকা তৈরী করতে সাহায্য করলেও; পরবর্তীতে ইউনেস্কো তাদের নীতি অনুযায়ী সপ্তাশ্চর্য বাছাই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে। কারণ আইনত ইউনেস্কো মনে করে, সকল বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান সমমর্যাদার অধিকারী।
The New 7 Wonders Foundation এর দাবি অনুযায়ী তারা একটি অলাভজনক সংগঠন। এবং নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন করতে গিয়ে তারা কোন ধরনের লাভ করেনি। বরং এই প্রতিযোগীতা আয়োজন করতে গিয়ে তাদের যত টাকা খরচ হয়েছে, সেই টাকাও উঠে আসেনি। The New 7 Wonders Foundation তৈরী করেছে The New Open World Corporation নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা যদিও সম্পূর্ণ বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন করতে যত স্পন্সর এসেছে, তার সমস্ত টাকা পয়সা গ্রহণ করেছে The New Open World Corporation। তাছাড়া তারা এসব অনুষ্ঠানের সম্প্রচার সত্ত্ব বিক্রি করেও অর্থ উপার্জন করেছে। পরবর্তীতে তারা আরো দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতার আয়োজন করেছে। একটি হল ২০১১ সালে আয়োজিত New 7 Wonders of Nature বা নতুন প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য এবং আরেকটি হল ২০১৪ সালে আয়োজিত New 7 Wonders Cities বা নতুন সপ্তাশ্চর্য শহর। প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য হিসেবে নির্বাচিত জায়গা গুলো হল: ১. দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশের মধ্যে থাকা মহাবন আমাজন ২. ভিয়েতামের হা লং বে ৩. দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপ ৪. ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মধ্যে থাকা ইগুয়াজু জলপ্রপাত ৫. ফিলিপাইনের ভূগর্ভস্থ নদী পুয়ের্তো প্রিন্সিয়া ৬. ইন্দোনেশিয়ার কমোডো দ্বীপ এবং ৭. দক্ষিন আফ্রিকার টেবিল মাউন্টেন। অন্যদিকে The New 7 Wonders Foundation নির্বাচিত সপ্তাশ্চর্য শহরগুলো হল: ১. লেবাননের বৈরুত ২. কাতারের দোহা ৩. দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান ৪. কিউবার হাভানা ৫. মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর ৬. বলিভিয়ার লাপাজ এবং ৭. ফিলিপাইনের ভিগান। এর বাইরেও আমেরিকার প্রকৌশলিদের সংগঠন American Society of Civil Engineers আধুনিক বিশ্বের বিষ্ময়কর সাতটি স্থাপনার একটি তালিকা তৈরী করেছে। সেই তালিকায় আছে: ১. পানামা খাল ২. ইংলিশ চ্যানেলের নিচ দিয়ে তৈরী সুরঙ্গ চ্যানেল টানেল ৩. যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং ৪. যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট ব্রিজ ৫. কানাডার টরন্টোর সিএন টাওয়ার ৬. নেদারল্যান্ডসের বিস্তৃত বাঁধ প্রকল্প ডেল্টা ওয়ার্কস এবং ৭. ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ের মধ্যবর্তী ইতাইপু বাঁধ। এছাড়া পৃথিবীর সমুদ্রতলের সাতটি বিষ্ময় এবং শিল্প জগতের সাতটি বিষ্ময় সহ এরকম বহু সপ্তাশ্চর্যের তালিকা এখনও পর্যন্ত তৈরী করা হয়েছে।